‘লকডাউন কী?’, করোনা মোকাবেলায় সুইডেনে উল্টো চিত্র

মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ইউরোপের বিরাট অংশ যখন লকডাউনে, তখন উল্টো চিত্র ওই মহাদেশটিরই আরেকটি দেশে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2020, 11:09 AM
Updated : 31 March 2020, 11:32 AM

কোভিড-১৯ এ সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি আক্রান্ত এবং শতাধিক মৃত্যুর পরও সুইডেনের জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক বলে জানাচ্ছে বিবিসি।

দীর্ঘ শীতের পর দেশটির রাজধানী স্টকহোমে বাড়ির বাইরে বসার মতো উষ্ণ আবহাওয়ার দেখা মিলেছে; মানুষজনও তার সদ্ব্যবহারই করছে।

মারিয়াটোরগেট স্কয়ারের ভাইকিং গড থরের বিশাল মূর্তির পাদদেশে অনেকগুলো পরিবার আইসক্রিমে জিভ ছোয়াচ্ছে; খানিকটা দূরে ফুটপাতে বসে তরুণরা বাতাসে বুদবুদ তৈরি করে আনন্দময় মুহুর্ত উপভোগ করছে।

শহরটির অন্যত্র নাইটক্লাবগুলোও চলতি সপ্তাহে খোলা রয়েছে, তবে রোববার থেকে সেগুলোতে ৫০ জনের বেশি জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ।

পার্শ্ববর্তী ডেনমার্ক কিংবা ইউরোপেরই অন্য দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তুলনা করলে একেবারেই একেবারেই উল্টো চিত্র মনে হবে।

ডেনমার্কে ১০ জনের বেশি জমায়েতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আর যুক্তরাজ্যে তো ঘরের বাইরে বেরিয়ে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া অনেকটাই অসম্ভব।

বিবিসি বলছে, বিভিন্ন এলাকায় লোকজনের দেখা মিললেও সুইডেনের রাস্তাঘাট স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক শান্ত। স্টকহোমের গণপরিবহনের দায়িত্বে থাকা এসএল কোম্পানি গত সপ্তাহে সাবওয়ে ও কমিউটার ট্রেনগুলোতে যাত্রীর সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছে।

অথচ স্টকহোমের প্রায় অর্ধেক বাসিন্দাই দূরের এলাকাগুলোতে কাজ করেন বলে বিভিন্ন জরিপে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত কোম্পানি স্টকহোম বিজনেস রিজিওনের ধারণা রাজধানীর বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৯০ শতাংশই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে; প্রযুক্তিবান্ধব ও নমনীয় ব্যবসায়িক সংস্কৃতির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে বলেও পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

“প্রতিটি কোম্পানি, যাদের সে ধরনের সুযোগ রয়েছে এরকম করার, সেটা তারা করছেন এবং এটা কাজ করছে,” বলেছেন স্টকহোম বিজনেস রিজিওনের প্রধান নির্বাহী স্তেফান ইংভারসন।

সুইডেনের সরকার অবশ্য করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ‘নিজের দায়িত্ব নিজেকে নেয়ার’ কৌশল হাজির করেছে। জনস্বাস্থ্যের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ ও রাজনীতিকরাও কঠোর পদক্ষেপ ছাড়াই কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের গতি কমাতে পারবেন বলে আশা করছেন।

অবশ্য সুইডেনের সরকার যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় একেবারেই হাত গুটিয়ে বসে আছে, তা নয়। অসুস্থ ও বৃদ্ধদের বাড়িতে থাকতে, নিয়মিত হাত পরিষ্কার করতে, অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে ও সম্ভব হলে বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশনাগুলো দিয়ে রেখেছে তারা।

“যারা আমরা প্রাপ্তবয়স্ক, তাদের প্রাপ্তবয়স্কই থাকা প্রয়োজন। আতঙ্ক বা গুজব ছড়ানো যাবে না। এই সংকটের মুহুর্তে কেউই একা নয়, কিন্তু প্রত্যেকেরই ব্যাপক দায়িত্ব রয়েছে,” কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে এমনটাই বলেছেন সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্তেফান লোফভেন।

তার এ বক্তব্যে বেশিরভাগ সুইডিশেরই সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছে জরিপ সংস্থা নোভাস।

দেশটিতে সরকারি কর্তৃপক্ষের উপর জনসাধারণের আস্থাও প্রবল; কর্তৃপক্ষ তাদের নির্দেশনা মেনে চলতে স্থানীয়দের বাধ্য করাতে পারবে বলেও মনে করছেন অনেকে।

সুইডেনের জনসংখ্যার ধরনও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশটির এমন পদক্ষেপের অন্যতম কারণ, বলছে বিবিসি। ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য দেশের বাড়িগুলোতে সাধারণত একাধিক প্রজন্ম থাকে; আর সুইডেনের অর্ধেকের বেশি বাড়ি বানানোই হয়েছে একজনের উপযোগী করে; এ কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও তুলনামূলক অনেক কম।

অবশ্য সুইডেনের জনগণের মধ্যে ঘরের বাইরে থাকার প্রবণতা বেশি। কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণকে মানসিক ও শারিরীকভাবে সুস্থ রাখতেই তারা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, যা তাদের ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য করবে।

“আমরা ভাইরাসের সংক্রমণ কম রাখতে এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় সমন্বিত কিছু করার চেষ্টা করছি। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় অন্য দেশগুলোর তুলনায় সুইডেনের সরকারের পদক্ষেপ ও সুইডিশ পদ্ধতিগুলোই বেশি উপযুক্ত বলে এখানকার ব্যবসায়িক মহলও মনে করছে,” বলেছেন স্টকহোম চেম্বার অব কমার্সের প্রধান নির্বাহী আন্দ্রিস হাতজিগরগিউ।

অবশ্য সবাই তার মতো ভাবছেন না। কেউ কেউ প্রাণঘাতী এই ভাইরাস মোকাবেলায় ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় সুইডেনের সরকারের নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন।

“আমার মনে হয়, লোকজন সুপারিশ শুনতে বেশ আগ্রহী, কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে এটাই যথেষ্ট কিনা আমি নিশ্চিত নই,” বলেছেন সুইডেনের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কেরোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজিস্ট ড. এমা ফ্রান্স।

দোকান এবং জিমের মতো জনসমাগমের স্থানগুলোতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সংস্পর্শ নিয়ে কর্তৃপক্ষের আরও ‘সুস্পষ্ট নির্দেশনা’ থাকা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে কাদের রাজনীতিক ও বিজ্ঞানীরা সেরা পদক্ষেপ নিয়েছেন, ইতিহাসই তার বিচার করবে বলেও মন্তব্য করেন এমা।

“কেউই আসলে জানে না, কোন কোন পদক্ষেপগুলো সবচেয়ে কার্যকর হবে। আমি খুশি যে আমাকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে না,” বলেছেন তিনি।