করোনাভাইরাস: বিধিনিষেধে বন্দি পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ

মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপের কারণে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2020, 09:34 AM
Updated : 26 March 2020, 10:31 AM

এরই মধ্যে কভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে সাড়ে চার লাখ পেরিয়ে গেছে; মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২১ হাজার।

চারদিকে আতঙ্ক ছড়ানো এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, একটি সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টাই শুধু পারে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের প্রকোপ থামাতে।

স্কাই নিউজ এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছে, ৪১টি দেশের প্রায় তিনশ কোটি মানুষ করোনাভাইরাসের কারণে জারি করা বিধিনিষেধের আওতায় পড়েছেন। কোথাও কোথাও অফিস করতে হচ্ছে বাড়ি থেকে। কোথাও আবার কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে যানবাহনে, রাশ পড়েছে দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থায়।

যেসব দেশে পুরোপুরি ‘লকডাউন’ করা হয়েছে, অর্থাৎ নাগরিকদের বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে, সেসব দেশের দেড়শ কোটি মানুষ ‍পুরোপুরি বন্দিদশার মধ্যে পড়েছেন।

ইতালির পর স্পেনেও কভিড-১৯ এ মৃত্যুর সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়েছে; তিন মাস আগে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকেই ভাইরাসটি ছড়াতে শুরু করেছিল।

ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সে মৃতের সংখ্যা হাজারের ঘর অতিক্রম করে দেড় হাজারের দিকে ছুটছে। আক্রান্তের সংখ্যায় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, মৃত্যুর সংখ্যায় হাজারের ঘর ছাড়ানো আরেকটি দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা।

ভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত মার্কিন অর্থনীতিকে টেনে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস দুই দশমিক দুই ট্রিলিয়ন ডলারের ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণার পর দেশটির শেয়ারবাজারের অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে।

রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, নিউ ইয়র্কের সামনে কয়েকটি ‘কঠিন সপ্তাহ’ আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাইরাস উপদ্রুত এ অঙ্গরাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে ৩০ হাজার পেরিয়ে গেছে।

যেসব এলাকায় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কম, সেসব এলাকার মানুষ কবে কাজে ফিরতে পারবে, সে বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।

“আমাদের দেশকে ফের সচল করতে চাই। কোনো তাড়াহুড়ো কিংবা জোর করে নয়। ইস্টারের (১২ এপ্রিল) আগেই আমাদের কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এর আগেও হতে পারে,” বলেছেন নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে তার আমলে মার্কিন অর্থনীতির শক্তিশালী অবস্থানের কথা বারবার বলে আসা ট্রাম্প।

জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের জন্য দুই বিলিয়ন ডলারের একটি সহায়তা তহবিল খুলতে গিয়ে বলেছেন, মহামারি মোকাবেলায় সমগ্র বিশ্বকে এক হয়েই লড়তে হবে।

“কভিড-১৯ সমগ্র মানবজাতির জন্য হুমকি, তাই সমগ্র মানবজাতিকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এই মুহুর্তে বৈশ্বিক পদক্ষেপ ও সংহতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচ্ছিন্নভাবে একেকটি দেশের প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট নয়,” বলেছেন তিনি।

ডেইলি মেইলের এক হিসাবে বিশ্বের অন্তত ৮২টি দেশ সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ভারতেরই আছে ১৩০ কোটি মানুষ। তিন সপ্তাহের জন্য লকডাউনে যাওয়া জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ দেশটিকে এখন মানুষের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বুধবার কভিড-১৯ এ আক্রান্ত আরও দুই রোগীর মৃত্যুর খবর দেওয়া রাশিয়াও লকডাউনের পথ ধরতে যাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর।

দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগামী সপ্তাহের সব কার্যদিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছেন, সংবিধান সংশোধনের গণভোট স্থগিত করেছেন। মানুষজনকে কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলারও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

যুক্তরাজ্যেও আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বুধবার ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রিন্স চার্লসের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে; অবশ্য তার সংক্রমণ মৃদু বলে কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন।

সংকট মোকাবেলায় বিশ্ব কী পদক্ষেপ নেবে, তা ঠিক করতে বৃহস্পতিবার জি-২০ দেশগুলো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। বৈঠক করতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা ২৭ দেশও।

স্পেনে একদিনে ৭৩৮ জনের মৃত্যুর পর দেশটিতে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ৪০০ অতিক্রম করেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় চিকিৎসা উপকরণ কিনতে দেশটি বেইজিংয়ের সঙ্গে ৪৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারের একটি চুক্তিও করেছে।

ইতালিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা শেষ খবর পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫০৩ জনে। ফ্রান্স করোনাভাইরাসে বুধবার নতুন আরও ২৩১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে; দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা এক হাজার ৩০০ পেরিয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে প্যারিসে মেট্রো ও রেল চলাচল সীমিত করা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে সফলতার কাছাকাছি পৌঁছানো চীনের পরিস্থিতি এখন একেবারেই অন্যরকম। ডিসেম্বরের শেষদিকে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটি দেশটির যে প্রদেশ থেকে ছড়িয়েছিল, সেই হুবেই প্রদেশে মানুষের চলাচলের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে।

তিনমাস পর ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া মানুষদের চাপে বাস ও ট্রেনে ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে।

চীনের অবস্থা স্বস্তিদায়ক হলেও করোনাভাইরাস মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। ইরানে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার পেরিয়েছে; আফ্রিকার মালি তাদের দেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগীর সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে। সংক্রমণ রুখতে মহাদেশটির বেশ কয়েকটি দেশ জরুরি অবস্থা জারি করেছে।

চলতি বছরের অলিম্পিক স্থগিত রাখা জাপানের রাজধানী টোকিওর গভর্নর করোনাভাইরাসের বিস্ফোরণ ঠেকাতে বাসিন্দাদের সপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ঘরেই থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।

আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার ও মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ জনে দাঁড়ানোর পর ইসরায়েলেও নাগরিকদের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জেরুজালেমের চার্চ অব হোলি সেপুলক্রে।

মহামারি আঘাত হেনেছে ইউরোপীয় ফুটবলেও; মহাদেশটির সব লিগ ও টুর্নামেন্ট বন্ধ রয়েছে। উইম্বলডন টেনিস টুর্নামেন্টের ভাগ্যও আগামী সপ্তাহে নির্ধারিত হবে।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হতে যাচ্ছে, তা এক দশক আগের মন্দার চেয়েও ভয়াবহ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্র দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়ায় সেখানকার শেয়ারবাজারে ইতিবাচক হাওয়া বইছে। কিন্তু প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় সবচেয়ে বড় অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়াসহ দেশটির ১৬ কোটিরও বেশি মানুষকে ঘরবন্দি থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।