করোনাভাইরাস: বসন্তে অবরুদ্ধ ভালোবাসার শহর

মহামারী রূপ নেওয়া নভেল করোনাভাইরাস চীনে ব্যাপকভাবে ছড়ানোর সময় বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক তৈরি হলেও তখনও দেশটিতে একদিনে মৃত্যুর সংখ্যা দেড়শোর বেশি হয়নি। সেদিক থেকে ইতালি চীনকে ছাড়িয়ে গেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2020, 05:56 AM
Updated : 25 March 2020, 05:58 AM

প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ছড়ানোর নতুন কেন্দ্রস্থল ইউরোপের দেশটিজুড়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পরও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় জনসমাগম নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের শহর রোমে এখন ভরপুর বসন্ত। কিন্তু ভালোবাসার শহর বলে খ্যাত রোমে চলছে না কোনো ‘রোমান হলিডে’।

অন্য শহরের মত অবরূদ্ধ রাজধানী রোমও। অবরুদ্ধ সময়ে জীবন কেমন কাটছে রোমবাসীদের তা উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে সিমা কোটেচারের ভাষ্যে:

মার্চের গোড়ার দিকে এক সকালে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর আমি উড়োজাহাজ ছাড়ার অপেক্ষা করছিলাম। আমার গন্তব্য ছিল ইতালি; নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে প্রতিবেদন করতে হবে। রোমে এটাই আমার প্রথম যাত্রা। অথচ প্লেনে গুটিকয়েক যাত্রীর মাঝে বসে আমি কেমন যেন অস্থির, চিন্তিত আর ভয় পাচ্ছিলাম।

মিশমিশে কালো চুলের একটি মেয়ে বসেছিল আমার কাছেই। যুক্তরাজ্য থেকে ইতালিতে পরিবারের কাছে ফিরছে মেয়েটি। শহরটি পুরোপুরি অবরুদ্ধ হওয়ার আগেই ফিরতে চায় বলে আমাকে জানালো সে।

প্লেন থেকে যখন নামলাম রোমে তখন উষ্ণ ও উজ্জ্বল একটি দিন। কিন্তু তা ছাপিয়ে ভয় গ্রাস করেছিল আমাকে। লক্ষ্য করলাম, এখানে কেউ কারো চোখের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না; সবারই মাস্কে মুখ ঢাকা।

বিমানবন্দরের এক কর্মী বেশ জোরেই কথা বলছিলেন। মাস্ক পরে থাকার কারণে একটু চাপা কণ্ঠ শোনালেও বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে বলা হলো, আমরা সবাই যেন একে অপরের কাছাকাছি না দাঁড়াই।   

রোমে পর্যটনের সঙ্গে মিশেছে প্রাচীন ইতিহাস ও ধর্ম। ছাদবিহীন মঞ্চ রোমান কলোসিয়াম, ভ্যাটিকান সিটির সেইন্ট পিটারস স্কয়ার, পুরনো মন্দির প্যানথিওন পর্যটকদের টানে। অন্য সময় লোকে লোকারণ্য হলেও এসব স্থাপনাগুলো এখন জনমানবশূন্য যেন মরুভূমি। 

সুনসান শহরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে মনে হলো যেন এক ভুতুড়ে নগরী। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, জরুরি কারণ ছাড়া ঘুরে বেড়ানো যাবে না একেবারেই। সরকারের এই নির্দেশনা মানতে বাধ্য করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মাঠে নেমেছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মুখে বিশেষ মাস্ক পরে মিলান শহরের এক গির্জার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন ব্যক্তি। ছবি- রয়টার্স।

গির্জায় ঘণ্টার আওয়াজ ছাড়া রোম জুড়ে এখন শুধুই নৈঃশব্দ। আমরা এখানকার ফ্যাশন নিয়ে শুটিং করছিলাম। সড়কের ধারে সারি করে ছিল নামকরা ডিজাইনারের দোকান। হঠাৎ পরিবেশটা পাল্টে গেল। দেখলাম আশেপাশের বাড়ি থেকে বারান্দায় জড়ো হচ্ছেন বাসিন্দারা। আমাদের দেখে হাত তালি দিয়ে উঠলেন।

ওদের সবার তালির ছন্দে মুহূর্তেই খান খান হয়ে গেল সবটুকু মৌনতা। কেউ কেউ বারান্দা থেকে চিৎকার করে বললো, “এটা আমাদের ঐক্য ও প্রতিরোধের জন্য। ঘরে থাকার এই নিয়মকে আমরা মেনে নিয়েছি। কারণ ভাইরাসটিকে ধ্বংস করার জন্য এটাই জরুরি এখন।”

ইতালির সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা লমবার্দিতে তখন পরিস্থিতি বেশ খারাপ। হাসপাতালগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বাড়তে থাকা মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে। কিন্তু তাদের কিট ফুরিয়ে আসছিল; অভাব তৈরি হয় বিশেষজ্ঞ সহায়তারও।

প্রেসিডেন্ট কড়া ভাষায় দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, নিজেরা ঘরবন্দি না হলে এত স্বল্পসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে সেবা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না কোনোভাবেই।  

এক চিকিৎসক আমাকে বললেন, “যুদ্ধক্ষেত্রর মত অবস্থা এখানে।”

ওদিকে রোমে পুলিশকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে; ৪৫ লাখ মানুষের শহরটিতে কোথাও জটলা দেখলেই ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চিত্র ছিল শহরের সর্বত্রই।

একদিন সকালে একটি সুপারমার্কেটের বাইরে শুটিং চলছিল। এক বৃদ্ধা আমার প্রযোজক হান্নাস ও আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, আমরা দুজন যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলছি না। যেতে যেতেও বৃদ্ধা আমাদের উদ্দেশে বলছিল, একটু দায়িত্বশীল হতে হবে।

এটাই এখন রোমের বাস্তবতা। শহরের খাবার আর ওষুধের দোকানগুলো খোলাই ছিল। কিন্তু সেখানে কেনাকাটার কোনো হিড়িক চোখে পড়লো না।

‘আমার হৃদয় বেদনাহত’

ক্যাথলিক গীর্জাগুলো খোলাই ছিল; যদিও ভক্তদের জন্য কোনো সেবা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপও ঘরবন্দি করেছেন নিজেকে।

এক গীর্জার বাইরে আলাপ হলো জার্মানি থেকে আসা এক শিক্ষকের সঙ্গে। জাতীয় এই দুর্যাগের কালে প্রার্থনার তাগিদ দিলেন ওই নারী।

“গীর্জা হলো মানুষের সেই আশ্রয়স্থল যেখানে স্বস্তি আর উপদেশ মেলে।”

পঞ্চাশোর্ধ এক নারী আমাদের বললেন, রোমকে এমন কখনই দেখেননি তিনি।

“আমি ভারাক্রান্ত। কেউ জানে না কখন শেষ হবে এসব, কবে যেন আমরা একটু স্বাভাবিক হতে পারি। এখন চিন্তা একটাই, এর শেষ কোথায়?”

এই দুঃসময়ে ইতালি বিপর্যস্ত হলেও, মানুষের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। এক রেস্তোরাঁ মালিক মানুষকে প্যাকেট করে খাবার সরবরাহ করার জন্য নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন।

আমার ক্যামেরাম্যান পল ও আর হান্নাহ দুজনেই মানুষের সাথে কথা বলে দুর্দান্ত একটা গল্প খুঁজে আনায় চৌকষ। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে টানা হৃদয়বিদারক ঘটনা প্রচার করতে করতে মনে হলো এবার থামা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী ততদিনে ঘোষণায় বলেছেন, যে কোনো অপ্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক কাজ স্থগিত করে দিতে। এরপরই আমাদের হোটেল বন্ধ হওয়ার প্রস্তুতি নিল। বেশিরভাগ বিমানবন্দরও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিল। শুধুমাত্র ফিউমিসিনো এয়াপোর্টের টার্মিনাল-৩ খোলা ছিল। আর ওতেই আমরা ফিরতি ফ্লাইট ধরি। 

যেমন গভীর উদ্বেগ নিয়ে রোমে পা রেখেছিলাম, ফেরার সময়ও ছিল ততটাই উৎকণ্ঠা।

জুলিয়াস সিজার থেকে শুরু করে রোমান সামাজ্যের পতন, তারপর ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে শহরের বোমা হামলা- এই শহরের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে উঁকি দিচ্ছিল মনে।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যেভাবে ভীতি জাগিয়েছে আর ধ্বংস করেছে ইতালিকে তা কি কোনো ধরনের পরীক্ষা? আমরা দূর থেকে দেশটির মানুষের জন্য উদ্বেগ, সমবেদনা আর ভালোবাসাই অনুভব করতে পারি কেবল। আর পারি আগামীর জন্য ওই মানুষগুলোর মঙ্গল প্রার্থনা করতে।