করোনাভাইরাস যেভাবে হন্তারক হয়ে ওঠে

চীনের উহানে ডিসেম্বরের শেষদিকে প্রথম এর আবির্ভাব হয়েছিল; আড়াই মাস পর বিশ্বকে এখন প্রাণঘাতী এই নভেল করোনাভাইরাস আর তা থেকে সৃষ্ট রোগ কভিড-১৯ এর মহামারির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়তে হচ্ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2020, 08:58 AM
Updated : 14 March 2020, 06:38 PM

এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে এক লাখ ৪২ হাজারেরও বেশি মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন, মৃতের সংখ্যাও ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, আক্রান্তদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই রোগটির তীব্রতা মারাত্মক নয়। অল্প ক’দিনে সেরেও উঠছেন তারা। তবে কোথাও কোথাও মানুষের মৃত্যুহার আতঙ্কিত হওয়ারই মতো।

সামান্য হাঁচি-কাশি আর জ্বর নিয়ে হাজির হওয়া ভাইরাসটি কীভাবে ধাপে ধাপে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে? শরীরই বা কিভাবে এর আক্রমণ সামলানোর চেষ্টা করে? বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসবেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে।

শরীরে হানা

করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে; আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ কিংবা হাঁচি-কাশি থেকে এটি অন্য দেহে ছড়াতে পারে।

আশপাশে থাকা ভাইরাসটির কোনো বাহকের হাঁচি বা কাশি থেকে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে এটি আপনার দেহে প্রবেশ করতে পারে; প্রবেশ করতে পারে এমনকী বাহকের সংস্পর্শে আসা কোনো বস্তু থেকেও।

ভাইরাসটির জীবাণু আছে এমন যে কোনো কিছুতে হাত দেয়ার পর ওই হাত যদি আপনার মুখমণ্ডলও স্পর্শ করে, তাহলে নিজের অজান্তেই আপনি শরীরে কভিড-১৯ কে ডেকে আনলেন।

নতুন দেহে জায়গা করে নিতে প্রথম পর্যায়ে ভাইরাসটির লক্ষ্যই থাকে যত বেশিসম্ভব কোষের ভেতর প্রবেশ করা এবং সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেওয়া।

শুরুর দিকে এটি গলা, শ্বাসনালী ও ফুসফুসের চারপাশের কোষগুলোকে কব্জা করে এবং সেগুলোকে ‘করোনাভাইরাসের কারখানায়’ রূপান্তরিত করে। এ কারখানাগুলো থেকেই পরে আরও আরও ভাইরাস অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে।

এ পর্বে আক্রান্ত ব্যক্তির অসুস্থতা, কারও কারও ক্ষেত্রে এমনকি উপসর্গও ধরা পড়ে না। এই ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হলেও গড়ে সাধারণত ৫ দিন থাকে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।

মৃদু আক্রমণ

ভাইরাসটিতে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনের সংক্রমণের মাত্রা থাকে খুবই সামান্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের জ্বর ও কাশি হয়।

কারও কারও ক্ষেত্রে শরীর ম্যাজম্যাজ করা, গলা ব্যথা ও মাথা ব্যথাও দেখা দিতে পারে।

জ্বর আর এর ফলে যে বিচ্ছিরি অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তার মানেই হচ্ছে, আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে দিয়েছে।

ভাইরাস যখন কোনো কোষের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে তখনই সেসব কোষ সাইটোকিনস নামের রাসায়নিক নিঃসরণ করে ‘দখলদার শত্রু’ সম্পর্কে শরীরের অন্যান্য অংশে সংকেত পাঠায়।

এ পরিস্থিতিতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় হলে দেখা দেয় শরীর ম্যাজম্যাজ, ব্যথা ও জ্বরের মতো উপসর্গ।

করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম দিকে আক্রান্ত ব্যক্তির শুকনো কাশি দেখা যায়। ভাইরাসে ফুসফুসের কোষগুলো মরতে শুরু করলে অনেকের কাশির সঙ্গে কফও বের হয়।

এ ধরনের উপসর্গগুলোর ক্ষেত্রে আপনাকে বিশেষায়িত হাসপাতালে যেতে হবে না; পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার ও প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট।

সাধারণত সপ্তাহখানেক ধরে কভিড-১৯ এর এ মৃদু পর্যায় থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা করোনাভাইরাসকে এ পর্যায়েই কাবু করে ফেলে।

এখন পর্যন্ত এ পর্যায় সম্বন্ধে এটুকুই জানা গেছে; কারও কারও ক্ষেত্রে অবশ্য এ সময় সর্দিও দেখা দিতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে।

গুরুতর অবস্থা

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দেয়াল টপকে ভাইরাসটি যদি এরপরও অগ্রসর হয়, তখন দেহের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ দেখা দেয়।

এর মধ্যে ফুসফুসের প্রদাহকে বলা হয় নিউমোনিয়া।

“ভাইরাসটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়, তখন ব্যাপক জ্বালাপোড়া হতে থাকে। ভাইরাসটি কীভাবে এটি করে তা আমরা এখনো জানি না,” বলেছেন লন্ডনের কিংস কলেজের ড. নাতালি ম্যাকডারমট।

এসময় সংকট তৈরি হয় ফুসফুসের বায়ুথলেগুলো নিয়ে; এ থলেগুলোর মধ্য দিয়েই অক্সিজেন রক্তে পৌঁছায় আর কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে আসে।

নিউমোনিয়া হলে ছোট ছোট ওই থলেগুলো পানিতে ভরে যায়, যে কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখতে এসময় অনেককেই ‘ভেন্টিলেটর মেশিনের’ সহযোগিতা নিতে হয়।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশকেই এ গুরুতর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলে চীনের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে।

সংকটকালীন পরিস্থিতি

সংক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের ভেতর ৬ শতাংশ হয়ে পড়েন ভয়ানক অসুস্থ।

মূলত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা শরীরজুড়ে নানান সমস্যা সৃষ্টি করায় বাধে বিপত্তি।

এসময় রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে গিয়ে ও বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ অচল হয়ে পড়ে দেখা দিতে পারে ‘সেপটিক শক’।

ফুসফুসে ব্যাপক জ্বালাপোড়া বা প্রদাহের কারণে সৃষ্ট রোগ অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে; কিডনিকে রক্ত পরিষ্কার থেকে বিরত রাখতে পারে, ক্ষতি করতে পারে নাড়িভুঁড়ির আস্তরণের।

“ভাইরাসটি এমন মাত্রার প্রদাহ সৃষ্টি করবে যে আপনি টিকতে পারবেন না, এটি অনেকগুলো প্রত্যঙ্গকে অচল করে দেয়,” বলেছেন ড. ভারত পাঙ্খানিয়া।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি ভাইরাসটিকে হারাতে না পারে তাহলে দ্রুতই এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে আরও ক্ষতিসাধন করতে পারে।

এসময় বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃত্রিম ফুসফুসও ব্যবহার করা হয়, যেখানে টিউবের মাধ্যমে শরীরের ভেতরকার রক্ত বাইরে এনে, সেখানে অক্সিজেন সরবরাহ করে আবার শরীরে ফেরত পাঠাতে হয়।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ পরিস্থিতি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে এবং প্রত্যঙ্গগুলো আর শরীরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না।

ল্যানচেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে চীনের উহানের জিনইনতান হাসপাতালে মারা যাওয়া দুই রোগীর কথাও উঠে এসেছে, যাদেরকে দেখতে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মনে হলেও হাসপাতালে ভর্তির পর বেশিদিন তাদের বাঁচিয়ে রাখা যায়নি।

দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করায় ওই দুজনেরই ফুসফুস ছিল বেশ দুর্বল। 

এর মধ্যে ৬১ বছর বয়সী প্রথম যে ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন, তিনি হাসপাতালেই এসেছিলেন তীব্র নিউমোনিয়া নিয়ে।

শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়ায় তাকে একটি ভেন্টিলেটর মেশিন দেয়া হলেও ভর্তির ১১ দিন পর তার ফুসফুস অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং হৃদপিণ্ড অচল হয়ে যায়।

৬৯ বছর বয়সী দ্বিতীয় জনেরও অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম ছিল। ভয়াবহ নিউমোনিয়া এবং রক্তচাপ কমে গিয়ে ‘সেপটিক শকে’ তার মৃত্যু হয়।