গুজরাট দাঙ্গার স্মৃতি ফেরাচ্ছে দিল্লির সংঘর্ষ

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহ সহিংসতা চলছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) পক্ষে-বিপক্ষে ছোটখাট সংঘর্ষ থেকে যার সূত্রপাত হয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পুরোমাত্রার ধর্মীয় সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2020, 02:07 PM
Updated : 26 Feb 2020, 07:39 PM

মসজিদ, বাড়ি, দোকান কোনেকিছুই বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সাংবাদিকদেরকে থামিয়ে তাদের ধর্ম জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। আহত মুসলিমদেরকে জাতীয় সংগীত গাইতে বলা হচ্ছে, নির্দয়ভাবে পেটানো হচ্ছে। চার দিন ধরে রাজধানীতে চরম সহিংসতায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ পুলিশ তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। এখানেই প্রশ্ন  উঠেছে পুলিশের এ ‘অপারগতা’ পরিকল্পিত কিনা- ঠিক যেমন অভিযোগ উঠেছিল ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময়। প্রশাসন ‘নিষ্ক্রিয়’ থেকে দিল্লির সংঘর্ষ বাড়িয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।

সহিংসতার চারদিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথম টুইটে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। দাঙ্গায় নিহতদের জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ করেননি তিনি। দিল্লির শাসনক্ষমতায় থাকা আম আদমি পার্টিও বিশেষ কিছু না করার জন্য সমালোচিত হয়েছে। বিরোধীদলগুলোও একযোগে কোনো সমাবেশ করেনি। তবে বেশিরভাগ মানুষই আঙুল তুলেছেন দিল্লি পুলিশের ব্যর্থতার দিকে। রাজধানী শহরে পুলিশ নীরব দর্শক কেন হবে? ‘দিল্লিতেও ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার মডেল চলছে’ বলে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) এক নেতা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদেরও অনেকেই বলছেন, পুলিশ আগে থেকে আরও সক্রিয় হলে দিল্লির পরিস্থিতি এতটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না। গুজরাট দাঙ্গায় যে অভিযোগ ছিল, দিল্লির পুলিশের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তুলেছেন তারা। কেন সেনা নামানো হল না, সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।

দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীনে। দায়িত্বে আছেন অমিত শাহ। কাকতালীয়ভাবে, ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর তার মন্ত্রিসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এই অমিত শাহ-ই। ২০০২ সালের গুজরাটের সেই প্রেক্ষাপট ভেসে উঠছে অনেকের মনেই।

ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরায় সবরমতি এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়ার পর থেকেই গোটা গুজরাট জুড়ে শুরু হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ। প্রায় তিন মাস ধরে চলা সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছিল ১০৪৪ জনের। নিহতদের ৭৯০ জন ছিলেন মুসলিম। হিন্দু ছিলেন ২৫৪ জন। গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদী দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেননি, উল্টে প্রচ্ছন্ন মদদ দিয়েছিলেন দাঙ্গায়। পুলিশ-প্রশাসনকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেননি বলে পরে অভিযোগ উঠেছিল। দিল্লির এবারের সংঘর্ষেও ফিরে এসেছে সেই প্রশ্ন।

দিল্লি পুলিশকে তিরস্কার করেছে সুপ্রিম কোর্টও

অগ্নিগর্ভ রাজধানীতে লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত্যুসংখ্যা বাড়তে থাকার জন্য দিল্লি পুলিশকে তিরস্কার করল ভারতের সুপ্রিম কোর্টও। আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, “দিল্লি পুলিশ স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছে না এবং তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে” বলে মন্তব্য করেছে আদালত।

বুধবার বিচারপতি কেএম জোসেফ বলেছেন, ‘‘বিচারব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বলছি, পুলিশের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছে না তারা। এটাই সমস্যার মূল কারণ। আইন মেনে কাজ না করে কেন অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের?’’

আরেকটি ১৯৮৪ হতে দেওয়া যাবে না, দিল্লি হাইকোর্ট

১৯৮৪ সালে শিখ দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে দিল্লি হাইকোর্ট বলেছে, ‘‘আর একটা ১৯৮৪-র দাঙ্গা হতে দিতে পারি না আমরা।’’ যে দাঙ্গা ছড়িয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকে কেন্দ্র করে।

ইন্দিরা গান্ধীর শিখ বিদ্রোহ দমনের প্রতিশোধ নিতে ওই বছরই দুই শিখ দেহরক্ষী তাকে গুলি করে হত্যা করে। ইন্দিরার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সাধারণ জনতার বিশাল একটি অংশের ভেতর শিখদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তী ৩ দিনের মধ্যে দাঙ্গায় উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্রসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে প্রায় ৩,৩২৫ জন শিখকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে শুধু দিল্লিতেই হত্যা করা হয় ২,৭৩৩ শিখকে।

১৯৮৪ সালে দিল্লির ওই হত্যাযজ্ঞের মত ঘটনাই এবার আর না ঘটতে দেওয়ার কথা বলেছে হাই কোর্ট। ওই ঘটনা তুলে ধরে আদালত বলেছে, “ওইরকম সহিংসতা আর হতে দেওয়া যাবে না।”

সহিংসতার পেছনে বিজেপি নেতাদের উস্কানি-হুমকি

দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই নাগরিকত্ব শংসোধনী আইন( সিএএ) বিরোধী আন্দোলন নিয়ে উস্কানিমূলক মন্তব্য করে আসছেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও তা বন্ধ হয়নি। গত রোববার জাফরাবাদে পুলিশের সামনেই হুমকি দিয়েছেন বিজেপির এক নেতা। তিনদিনের মধ্যে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান না হটালে, তারা রাস্তায় নামবেন, তখন কেউ রুখতে পারবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এরপর ওইদিন থেকেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির একাধিক জায়গায়।

যাদের মুখ থেকে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য বেরিয়েছে, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে হবে বলে বুধবার দিল্লি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, অভয় বার্মা, ও পরবেশ বার্মার ভিডিও দেখেছে দিল্লি হাইকোর্ট। এ ধরণের সংবেদনশীল ঘটনায় কেন দিল্লি পুলিশ ঢিলেমি করেছে তা নিয়েও প্রশ্নও উঠেছে।