উহানের যে খ্যাতনামা মানুষদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে কভিড-১৯

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসে প্রতিটি মৃত্যুই তাদের প্রিয়জনদের কাছে হাজির হয়েছে ভয়াবহ যন্ত্রণা নিয়ে, এর মধ্যেও কিছু মৃত্যু তাদের পাশাপাশি শোকাচ্ছন্ন করেছে সমগ্র চীনকে, নজর কেড়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Feb 2020, 09:58 AM
Updated : 19 Feb 2020, 09:58 AM

এই ভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯ উহানের কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন একজন চিত্রশিল্পী, একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, একজন বিজ্ঞানী, একজন বডিবিল্ডার ও দুই জন চিকিৎসক।

কভিড-১৯ এর ছিনিয়ে নেওয়া এই মানুষদের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্য তুলে ধরা হল বিবিসির প্রতিবেদনে অবলম্বনে। 

হাসপাতাল পরিচালক লিউ জিমিং

চীনে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে এক হাজার ৭১৬ জন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই তালিকায় মঙ্গলবার বিশিষ্ট চিকিৎসক লিউ জিমিংয়ের নামটিও যুক্ত হয়েছে।

৫১ বছর বয়সী এ চিকিৎসক ছিলেন উহানের উচাং হাসপাতালের পরিচালক। ভাইরাস উপদ্রুত শহরটির প্রথম যে কয়টি হাসপাতাল আক্রান্তদের চিকিৎসায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, জিমিংয়ের হাসপাতাল ছিল তার একটি।

সোমবার রাতে চীনের গণমাধ্যম প্রথমে তার মৃত্যুর খবর দিলেও কিছুক্ষণ পর সেই খবর সরিয়ে, ‘চিকিৎসকরা এখনো জিমিংকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন’ বলে জানানো হয়েছিল।

মঙ্গলবার সকালে কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। লিউই নতুন এ করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া প্রথম কোনো হাসপাতাল পরিচালক। কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার আগে তার অন্য কোনো অসুখ ছিল কি না, যা তার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

লিউ’র ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে সামান্যই জানা গেছে; মৃত্যুর পর চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এ চিকিৎসক পেয়েছেন ‘নায়কের’ মর্যাদা।

“বিদায় নায়ক, সাদা পোশাকের সৈনিক,” উইবুতে এমনটাই বলেছেন এক ব্যবহারকারী।

“স্বর্গে কোনো অসুস্থতা নেই, আপনার ত্যাগের জন্য ধন্যবাদ,” মন্তব্য আরেকজনের।

হুইসেলব্লোয়ার চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং

উহানের মৃতদের মধ্যে এ মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ড. লি ওয়েনলিয়াং।

ডিসেম্বরেই তিনি নতুন একটি ভাইরাস নিয়ে তার বন্ধু ও সহকর্মীদের সতর্ক করেছিলেন। সেসময় পুলিশ কর্মকর্তারা লি‘কে ‘মিথ্যা গুজব’ ছড়ানোর ব্যাপারে সাবধান করেছিল।

এ চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর নিয়েও বেশ কয়েকঘণ্টা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছিল।

৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো প্রথমে তার মৃত্যুর খবর দিলেও পরে তা সংশোধন করা হয়। বলা হয়, চিকিৎসকরা এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য একদিন পরই কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে।

লি’র মৃত্যুতে শোক জানায় লাখো মানুষ। এ মৃত্যুর ঘটনা চীনাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে, সৃষ্টি হয় সরকারের প্রতি বিশ্বাসহীনতার অনুভূতি।

ডিসেম্বরে এ চিকিৎসকের ‘আগাম সতর্কতায়’ কান না দেওয়ায় অনেকেই কর্তৃপক্ষের কড়া সমালোচনা করেন। লির মৃত্যুর খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা নিয়েও অনেককে অভিযোগ তুলতে দেখা গেছে।

চিত্র পরিচালক চাং কাই

নতুন এ করোনাভাইরাস হুবেই ফিল্ম স্টুডিওর পরিচালক চাং কাই এবং তার বাবা-মা ও বোনেরও প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

মৃত্যুর আগে লেখা এক নোটে ৫৫ বছর বয়সী এ চলচ্চিত্র পরিচালক তার অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথাও লিখেছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

তার ওই নোটটি এক বন্ধুর হাতে পড়ে এবং পরে তা সংবাদমাধ্যম কাইজিনে প্রকাশিত হয়।

নোটটিতে চাং কাই জানান, তারা বাবা জ্বর, কাশি ও শ্বাসনালীর সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোথাও ভর্তি হতে পারেননি।

“চিকিৎসার জন্য তাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল: কিন্তু সবখান থেকেই কোনো আসন খালি নেই বলে জানানো হয়। আমরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি,” লিখেছেন এ চলচ্চিত্র পরিচালক।

এর কয়েকদিন পরই তার বাবার মৃত্যু হয়। পরে মারা যান ‘শারিরীক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ মা।

“নির্দয় এ ভাইরাস আমার ও আমার স্ত্রীর শরীরেও বাসা বেঁধেছে। আমি বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েছিলাম এবং ভর্তি করাতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু আসন পাওয়া খুবই কঠিন, আমরা আসলে কেউ না। আমরা সেরে ওঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এবং আমার শ্বাস দিন দিন দুর্বল হচ্ছে,” বলেছেন তিনি।

চাং কাই ও তার স্ত্রীকে পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ততদিনে এ পরিচালকের শারিরীক অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছিল বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

হুবেই ফিল্ম স্টুডিওর এ পরিচালক ১৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তার স্ত্রী এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। এ দম্পতির এক ছেলে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করছেন বলে চীনা গণমাধ্যম জানিয়েছে।

“আমি আমার বাবার আদরের সন্তান, এবং আমার ছেলের দায়িত্ববান পিতা। স্ত্রীর প্রিয়তম স্বামী এবং জীবনের ক্ষেত্রে আন্তরিক। যাদেরকে আমি ভালোবাসি আর যারা আমাকে ভালোবাসে- বিদায়,” নোটে এমনটাই লিখেছিলেন চাং কাই।

চিত্রশিল্পী লিউ শৌজিয়াং

জলরংয়ে আঁকা ছবির জন্য হুবেইজুড়েই অধ্যাপক লিউ শৌজিয়াংয়ের খ্যাতি ছিল।

সংবাদমাধ্যম জিয়েমিয়ান নিউজের খবর অনুযায়ী, কভিড-১৯ আক্রান্ত এ চিত্রশিল্পী গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬২ বছর বয়সে মারা যান।

১৯৫৮ সালে উহানে জন্ম নেওয়া লিউ পড়াশোনা করেন হুবেই অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। পরে সেখানেই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন, হন অধ্যাপক।

লিউর জলরংয়ে আঁকা ছবিগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তাকে খ্যাতি এনে দেয়; তার অনেক ছবিই চীনের বিভিন্ন জাদুঘর ও গ্যালারিতে স্থান পায়।

তার মৃত্যুর পর উইবুতে হাজার হাজার মানুষ শোক জানিয়েছে। কেউ কেউ এ প্রয়াণকে অভিহিত করেছেন ‘অসাধারণ এক প্রতিভার মৃত্যু’ হিসেবে।

“এ ধরনের প্রতিভাবানকে প্রশিক্ষিত করতে লাগে কয়েক দশক, অথচ মৃত্যু তাকে কয়েকদিনেই কেড়ে নিতে পারে,” লিখেছেন এক ব্যবহারকারী।

“এ ভাইরাস আর কত প্রতিভাবানকে কেড়ে নেবে ? ভাইরাসের কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক, কিন্তু এ ধরনের মানুষের মূল্য কে নির্ধারণ করবে?” বলেছেন শোকার্ত আরেক ব্যবহারকারী।

বিজ্ঞানী দুয়ান জেংচেং

৮৬ বছর বয়সী দুয়ান ছিলেন চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাবেক সদস্য; ছিলেন ন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টার ফর ডিজিটাল ম্যানুফেকচারিংয়ের চিফ সায়েন্টিস্ট।

১৯৩৪ সালে জিয়াংসুতে জন্ম নেওয়া এ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী চীনের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পড়াশোনা শেষ করে সেখানে পড়িয়েছেনও।

দুয়ান ১৯৯৬ সালে টিউমার চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপিতে ব্যবহৃত বিশ্বের প্রথম হোল বডি গামা নাইফ বানান বলে জানিয়েছে গ্লোবাল টাইমস। এ কাজ তাকে ২০০৫ সালে জাতীয় পুরস্কারও এনে দিয়েছিল।

কখনো হাল না ছাড়ার মানসিকতার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে ‘মেডিকেল ম্যাডম্যান’ হিসেবে খ্যাত দুয়ান ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান।

বডিবিল্ডার কিউ জুন

৭২ বছর বয়সী বডিবিল্ডার কিউ জুনের ছবি গত বছর অনলাইনে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল।

অবসরের পর শরীরচর্চা শুরু করা এ ব্যক্তি একটি জিমে যোগ দেয়ার অল্প কিছুদিন পর থেকেই অন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন বলে জানিয়েছে ফিনিক্স নিউজ।

ধর্মীয় উপাসনালয়ে যাওয়ার মতো করেই তিনি জিমে যেতেন; চলতি বছরের জুনে এক প্রতিযোগিতায় তার অংশ নেওয়ারও কথা ছিল।

২৩ জানুয়ারি তার দেহে নভেল করোনাভাইরাসের লক্ষণ ধরা পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সপ্তাহ দুয়েকের লড়াই শেষে ৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি। তার ছেলে পরে বাবার বন্ধু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে কিউ জুনের মৃত্যুসংবাদ দেয়।

“বাবা, যিনি কখনোই অসুস্থ হতেন না, তিনিও এই মহামারি থেকে বাঁচতে পারেননি,” বলা হয় ওই বার্তায়।