করোনাভাইরাস: আলোচনায় এবার বনরুই

নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কোথা থেকে শুরু হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বাদুড়, ভোঁদরের পর এবার একদল চীনা গবেষকের আলোচনায় এসেছে বনরুইয়ের নাম।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2020, 07:19 PM
Updated : 12 Feb 2020, 05:38 AM

বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া যে করোনাভাইরাসটি ৬৩৬ জনের মৃত্যু ঘটিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, সেটির আরএনএ বিন্যাসের সঙ্গে বনরুইয়ের শরীরে পাওয়া করোনাভাইরাসের বিন্যাসের ৯৯ শতাংশ মিল পেয়েছেন দাবি করেছেন গুয়াংজু প্রদেশের সাউথ চীন এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির গবেষকরা।

গায়ে আঁশযুক্ত একমাত্র স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী বনরুইকে বলা হয় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া প্রাণী । চীন ও ভিয়েতনামে কবিরাজি চিকিৎসায় পিঁপড়েখেকো এই প্রাণীর মাংস ও আঁশ ব্যবহার করা হয়।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়, প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের (২০১৯-এনসিওভি) আদি পোষক বাদুড় হলেও মানুষের মাঝে এর বিস্তারে আরেকটি প্রাণীর ভূমিকা রয়েছে বলে গুয়াংজুর গবেষকরা মনে করছেন। তাদের ধারণা, সেই প্রাণীটি হল বনরুই।

ভাইরোলজির ভাষায় এ ধরনের পোষক প্রাণীকে বলা হয় মধ্যবর্তী বাহক। তবে চীনা বিজ্ঞানীদের গবেষণার এই ফলাফল কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেই প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, নিশ্চিত করে বলার আগে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।

গত ৩০ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ার পর নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত করে চীন। এশিয়ার বিশাল এ দেশটির হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি সি ফুড মার্কেট থেকে ওই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে তখন থেকেই ধারণা করে আসছেন বিজ্ঞানীরা।

সি ফুডের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জীবিত বন্যপ্রাণীও ওই মার্কেটে বিক্রি হত, যা পরে বন্ধ করে দেয় চীনা কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে আরও অনেক কঠোর ব্যবস্থা নিয়েও নভেল করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায়নি। এ ভাইরাস কীভাবে মানুষের দেহে এসেছে তাও খোলাসা করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

গোড়ার দিকে সাপ, বাদুড় ও ভোঁদড়ের দিকে ইঙ্গিত ছিল অনেকের। আবার বিজ্ঞানীদের আরেকটি অংশের বক্তব্য ছিল, করোনাভাইরাস সাপকে পোষক হিসেবে ব্যবহার করে- এমন কোনো প্রমাণ কখনও মেলেনি।

বনরুই

ফোলিডোটা বর্গের প্রাণী বনরুইয়ের বিশেষত্ব হল এর গায়ে মাছের মত আঁশ। সে কারণে বাংলায় এর নাম হয়েছে বনরুই। স্তন্যপ্রায়ী এ প্রাণী পিঁপড়া খায় বলে তাদের পিপিলিকাভুকও বলা হয়।

এ প্রাণীর দাঁত নেই। ভয় পেলে বা আত্মরক্ষার তাগিদে বনরুই লেজ দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে বলের আকার নেয়। পিঁপড়ে-উঁইপোকা খাওয়ার জন্য এরা ব্যবহার করে দীর্ঘ জিহবা।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া প্রাণী এই বনরুই। মূলত আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতেই এর কেনাবেচা চলে। চীন, ভিয়েতনামসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সনাতন কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এর মাংস ও আঁশ।

পোচারদের হাতে পড়ে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় সোয়া দুই লাখ বনরুইয়ের প্রাণ গেছে বলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য। তবে গবেষকদের ধারণা, প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি।

নতুন করোনাভাইরাসের পোষক দেহ শনাক্ত করতে বিভিন্ন দেশে জোর গবেষণার মধ্যেই সাউথ চীন এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির গবেষকদের বিবৃতি আসে।

চীনের বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার খবরে বলা হয়, হাজারের বেশি বন্যপ্রাণীর উপর নিরীক্ষা চালিয়ে বনরুইয়ের শরীরে পাওয়া জিন বিন্যাসের সঙ্গেই নভেল করোনাভাইরাসের গঠনের সবচেয়ে বেশি মিল পেয়েছেন তারা। আর তাতে নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজে পাওয়া সহজ হতে পারে।   

তবে ওই গবেষণার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন কোনো জার্নালে প্রকাশিত না হওয়ায় এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক জেমস উড। তার ভাষায়, চীনা গবেষকদের এই দাবি একেবারেই প্রাথমিক ধারণার ওপর। এ থেকে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর সুযোগ কম। 

নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার ভাইরোলজির অধ্যাপক জোনাথন বল রয়টার্সকে বলেন, চীনা বিজ্ঞানীদের গবেষণা অবশ্যই অগ্রহ জাগানোর মত। তবে সঙ্কটের মুখে থাকা প্রাণী বনরুই আসলেই ওই ভাইরাসের পোষক কি না, সেটা এখনও নিশ্চিত করে বলার সময় হয়নি।

“সব জেনেটিক তথ্য আমাদের দেখার সুযোগ দিতে হবে। মানুষের দেহে পাওয়া ভাইরাস আর বনরুইয়ের শরীরের ভাইরাসে মিল আসলে কতটা তা আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে। যদি সঠিক হয়, বনরুইয়ের প্রজাতির মধ্যে এ ভাইরাস কতটা ছড়িয়েছে এবং উহানের সেই মার্কেটে বনরুই বিক্রি হত কি না- সেসবও বিবেচনায় নিতে হবে।”

ইউনিভার্সিটি অফ লিডসের অধ্যাপক মার্ক হ্যারিস বলছেন, নতুন করোনাভাইরাস বাদুড়ের শরীরে মেলা এক ধরনের করোনাভাইরাসের সঙ্গেও অনেকটা মিলে যায়, তবে উহানের সেই সি ফুড মার্কেটে কোনো বাদুড় ছিল না। মূলত সে কারণেই মধ্যবর্তী একটি বাহক থাকার সম্ভাবনার কথা বিজ্ঞানীরা বিবেচনা করতে শুরু করেন।

করোনাভাইরাস পরিবারের আরেক সদস্য সার্সের শুরুটাও বাদুর থেকে হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে মানুষের দেহে আসার আগে সেই ভাইরাসেরও মধ্যবর্তী বাহক প্রয়োজন হয়েছিল। ভোঁদড় সেই মধ্যবর্তী বাহক বলে ধারণা করা হয়।

 

আরও পড়ুন