ভাইরাস সংক্রমণের দিক থেকে ১৭ বছর আগের সার্সের মহামারিকে এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। সার্সে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছিল হাজার হাজার কোটি ডলারের।এবার করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে সার্সের চেয়েও বড় বিপদ ডেকে আনবে বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
করোনাভাইরাসের আতুড়ঘর বলে গণ্য চীনের উহান এখন কার্যত একটি অবরুদ্ধ এলাকা।ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে একের পর এক দেশ চীনের সঙ্গে যাতায়াত-যোগাযোগ বন্ধ করতে থাকায় বিশ্ব থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চীন।
কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় করোনাভাইরাস মহামারি চীনের পাশাপাশি বিশ্বের জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে।চীনা কারখানাগুলোর ওপর পণ্য উৎপাদনের জন্য এবং সেসব বিক্রির জন্য চীনা ভোক্তাদের ওপর যেসব আন্তর্জাতিক কোম্পানি নির্ভর করে তারা এরই মধ্যে সমস্যার কথা বলতে শুরু করেছে।
চীনে অ্যাপল,স্টারবাকস এবং আইকার মতো দোকানগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং শপিং মলগুলো জনমানবশূন্য হয়ে পড়ায় বেচা-কেনা ব্যাহত হচ্ছে।কর্মীরা ছুটিতে থাকায় অনেক কলকারখানাই পণ্য উৎপাদনে বিলম্ব করছে।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের নেতিবাচক প্রভাবে এবছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতবছরের ৬ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে অক্সফোর্ড ইকোনোমিক্স।
চীনের অর্থনীতির এ শ্লথগতির প্রভাবে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বার্ষিক ২ দশমিক ৩ শতাংশ হার থেকে এবছর কমে দাঁড়াবে ০ দশমিক ২ শতাংশে।যা বিশ্ব অর্থনীতিতে এক দশক আগে সংকটের শুরু থেকে সবচেয়ে শ্লথগতির।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে এমনিতে নাজুক হয়ে পড়া চীনের অর্থনীতিতে নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে এই করোনাভাইরাস। গতবছর ৩ দশকের মধ্যে চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বনিম্নে। এর মধ্যে ভাইরাসের প্রদুর্ভাব তাদের জন্য আরেক বোঝা। অর্থনীতিকে টেকাতে চীন এরই মধ্যে ভর্তুকি বৃদ্ধি, ব্যয় সংকোচনের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনাও করেছে।
কিন্তু চীনে করোনাভাইরাস এমন সময়ে ছড়িয়েছে যখন সেখানে চলে এসেছে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার সময়। নতুন রোগের কারণে এ উৎসব ঘিরে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর এই সময় চীনের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ যা ছিল এবার তাতে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তাছাড়া,করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চীনের সঙ্গে যাতায়াত যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া কারণে এবং জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা জারি থাকার কারণে চীনের বহুজাতিক কম্পানিগুলোর কাজও ব্যাহত হচ্ছে গোল্ডম্যান সাক্সসহ বড় বড় ব্যাংকগুলোর যেসব কর্মী চীন ভ্রমণ করেছে তাদের আলাদা করে রাখার কারণেও ব্যাংক সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
বিশ্বে বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক তৃতীয়াংশই আসে চীনের অর্থনীতি থেকে।যা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের সম্মিলিত বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি।
চীন বিশ্বের প্রধান একটি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ এবং উহান বিশেষভাবে অটোমোবাইল বা গাড়ি নির্মাণশিল্প গড়ে ওঠার জন্য পরিচিত। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের অংশ হিসেবে সেখানকার শিল্পকারখানা গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এসব কারখানা বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে।
করোনাভাইরাস মহামারি কতদিন চলবে তা কেউ জানে না। চীনের অর্থনীতিতে তা কতটা ক্ষতি ডেকে আনবে তাও ধারণা করা মুশকিল।তবে বিশ্ব অর্থনীতিতে সার্সের তুলনায় করোনাভাইরাসের প্রভাব যে আরো বিধ্বংসী হবে তা আঁচ করা যাচ্ছে।
২০০৩ সালে চীনে প্রাদুর্ভাব ঘটা সার্স ভাইরাস বিশ্বে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। সে সময় বিশ্ব বাণিজ্যের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ চীন থেকে এসেছিল। আর গত বছর তা বেড়ে হয়েছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। সুতরাং,এবার চীনের প্রবৃদ্ধি কমে তা সার্সের তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলার আশঙ্কা আছে।