ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে ফিলিস্তিনের তীব্র প্রতিক্রিয়া

দীর্ঘ বিলম্বের পর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশ করা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ফিলিস্তিন। এ পরিকল্পনাকে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন,“এ চুক্তি পাস হবে না”।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2020, 10:52 AM
Updated : 29 Jan 2020, 04:52 PM

মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। এতে ট্রাম্প ফিলিস্তিনের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

তার পরিকল্পনায় জেরুজালেমকে ইসরায়েলের ‘অবিভক্ত’ রাজধানী হিসাবে রাখা এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে কেবল পূর্ব জেরুজালেমের একটি অংশ ‘আবু দিস’কে রাখার কথা বলা হয়েছে। আর পশ্চিম তীরে গড়ে তোলা ইহুদি বসতিসহ সবটাই ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলা হয়েছে।

ফলে ইসরায়েলের জন্য বেশি সুবিধা থাকায় ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিন।পরিকল্পনায় বিশেষ করে জেরুজালেম নিয়ে বিরাজমান সংকট কাটেনি। জেরুজালেম ফিলিস্তিনিদের কাছে পবিত্র নগরী এবং এটিকে তারা তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে চায়।কিন্তু ট্রাম্প এটিকে ইসরায়েলের অবিভক্ত রাজধানী হিসাবে রেখেছেন।

পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস মঙ্গলবার বলেছেন,“জেরুজালেম বিক্রির জন্য নয়। আমাদের অধিকার বিক্রির জন্য নয় কিংবা দরকষাকষির জন্যও নয়।”

তিনি বলেন, “কোনো ফিলিস্তিনি, আরব, মুসলিম কিংবা খ্রিস্টানের পক্ষে জেরুজালেমকে রাজধানী করা ছাড়া ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেওয়া অসম্ভব। আমি হাজার বার বলেছি, এ পরিকল্পনা মানি না, মানি না, মানি না। আমরা শুরু থেকেই এ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে আসছি এবং আমাদের অবস্থানও ঠিক আছে।”

ওদিকে, গাজা উপত্যকাতেও মঙ্গলবার ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ‘ক্ষোভ দিবস’ পালিত হয়েছে। গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা ফিলিস্তিন দল হামাসও পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করেছে।

ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে তার পরিকল্পনা ঘোষণার সময় বলেন, “ফিলিস্তিনিদের জন্য এটিই হতে পারে শেষ সুযোগ।” ওদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ পরিকল্পনাকে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলে বর্ণনা করেন। ইসরায়েল এ সুযোগ হারাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ইসরায়েল রোববারই মন্ত্রিসভার ভোটাভুটির মাধ্যমে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েল এরই মধ্যে প্রায় ৪ লাখ বসতি স্থাপন করেছে। আরো ২ লাখ বসতি আছে পূর্ব জেরুজলেমে। আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এ বসতিস্থাপন অবৈধ হলেও ইসরায়েল এর বিরোধিতা করে আসছে।

ট্রাম্পের প্রস্তাবগুলো কি?

·       ইহুদি বসতি এবং জর্ডান রিভার ভ্যালিসহ পশ্চিম তীরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাষ্ট্র।

·       ফিলিস্তিনের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেমে এবং তাদের ভূখণ্ড দ্বিগুণেরও বেশি হবে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র একটি দূতাবাস খুলবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। তবে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন বলছে, এ পরিকল্পনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য মাত্র ১৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ পাবে ফিলিস্তিনিরা।

·       জেরুজালেম ইসরায়েলের ‘অবিভক্ত’ রাজধানী থাকবে। সেটি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ভাগাভাগি হবে না।

·       “কোনো ফিলিস্তিনি কিংবা ইসরায়েলি তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হবে না”- অর্থাৎ, ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে  ইহুদি বসতি রয়ে যাবে।

·       জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট এবং আল হারাম আল শরীফ এর প্রশাসনিক বিষয়গুলো স্থির করতে ইসরায়েল জর্ডানের সঙ্গে কাজ করবে।

·       আলাদা রাষ্ট্র গড়ার জন্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিন চারবছর সময় পাবে। বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার জন্য এ চারবছরের মধ্যে চুক্তি পড়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রের একটি মানদণ্ড ঠিক করে নিতে পারে। এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ হওয়া ভূখন্ড উন্মুক্ত থাকবে এবং সেখানে কোনো উন্নয়নও হবে না।

ট্রাম্প তার পরিকল্পনায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন দুটো আলাদা রাষ্ট্র গড়ার কথা বললেও এতে আদতে ফিলিস্তিন ইসরায়েলের প্রভাবমুক্ত হবে না বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। তাছাড়া, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করার জন্য পূর্ব জেরুজালেমের আবু দিস কে নির্ধারণ করাটাও ফিলিস্তিনের জন্য অসুবিধাজনক।

কারণ, আবু দিসের অবস্থান জেরুজালেমের ওল্ড সিটির একমাইল পূর্বে। যে এলাকায় আছে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের পবিত্র স্থান। আবু দিসে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের তোলা উচুঁ কংক্রিটের নিরাপত্তা প্রাচীর এবং চেকপয়েন্ট দিয়ে অবরুদ্ধ।

তবে ট্রাম্প তার দ্বিরাষ্ট্রিক পরিকল্পনাকে দুপক্ষের জন্যই লাভজনক ‘উইন-উইন’ প্রস্তাব বলে বর্ণনা করেছেন এবং দুই রাষ্ট্রের রূপরেখা দিয়ে একটি মানচিত্রেরও প্রস্তাব করেছেন। তার পরিকল্পনাটি পড়ে দেখার অনুরোধ জানিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ অব্বাসকে চিঠিও পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:

জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র জাতিসংঘ প্রস্তাবনা,আন্তর্জাতিক আইন এবং দ্বিপক্ষীয় নানা চুক্তির ভিত্তিতে একটি শান্তি চুক্তি করার আহ্বান জানিয়েছেন।

আরব লিগ শনিবারেই বিষয়টি নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক করার ঘোষণা দিয়েছে।

ওদিকে,যুক্তরাজ্য ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে ফিলিস্তিনিদেরকে এটি বিবেচনা করে দেখা এবং এর ভিত্তিতে তাদেরকে আলোচনায় ফিরে আসার প্রথম ধাপ শুরু করে দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে।একই সুরে কথা বলেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতও (ইউএই)।

কাতার,সৌদি আরব ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে।ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ পরিকল্পনা পড়ে দেখবে এবং মূল্যায়ন করবে বলে জানিয়েছে।

পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা করেছে তুরস্ক,ইরান,লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিরা।

ওদিকে,পাকিস্তান বলেছে,তারা বরাবরই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনার আওতায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানকে সমর্থন করে।

মিশর এবং জর্ডান উভয়ই ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছে।মিশর ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনকে সতর্কভাবে প্রস্তাবটি পড়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে।