ভিয়েতনামে ‘জমি অধিগ্রহণ’ ঘিরে সংঘর্ষ, ৩ পুলিশ নিহত

ভিয়েতনামে সামরিক বাহিনীর জমি অধিগ্রহণকে ঘিরে সংঘর্ষে নিহত তিন পুলিশ সদস্যকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে রাজধানী হ্যানয়ে সমাহিত করা হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2020, 09:56 AM
Updated : 16 Jan 2020, 09:56 AM

গত সপ্তাহে হ্যানয়ের কাছে একটি গ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা অভিযানের সময় এ তিনজনের মৃত্যু হয়; একই অভিযানে স্থানীয় এক নেতারও মৃত্যু হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার দেশটির প্রেসিডেন্ট নগুয়েন ফু ত্রং নিহত পুলিশ কর্মকর্তাদের মরোণত্তর সম্মাননা দিয়েছেন; প্রধানমন্ত্রী নগুয়েন জুয়ান ফুক নিহত পুলিশদের শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছেন।

“তারা জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষায় জীবন উৎসর্গ করেছেন,” নিহত পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্মান জানিয়ে বলেছেন নগুয়েন জুয়ান ফুক।

দং তাম গ্রামের কাছে মিউ মোনে তিন বছর আগে থেকে সেনাবাহিনী বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করে। ওই স্থাপনা নির্মাণে ১২৪ একরের মতো জমি ‘অন্যায্যভাবে’ অধিগ্রহণ করে সেনাবাহিনী পরিচালিত কমিউনিকেশনস কোম্পানি ভিয়েটেল গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের।

গ্রামটির বাসিন্দারা গত কয়েক বছর ধরে তাদের জমিতে সেনাবাহিনীর বিমানঘাঁটি নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল।

দং তাম গ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান ও ৮৪ বছর বয়সী স্থানীয় নেতা লে দিন কিনের ‘ব্যাখ্যাতীত’ মৃত্যু ঘিরে দেশটিতে তীব্র জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।

ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকার পুলিশ কর্মকর্তাদের মৃত্যুর জন্য ‘দাঙ্গাকারীদের’ দায় দিয়েছে; অন্যদিকে সংঘর্ষের জন্য গ্রামবাসীরা অভিযানে পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগকে দোষারোপ করছে।

ভিয়েতনামে জমি নিয়ে বিরোধের ঘটনা প্রায়ই ঘটলেও এ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা বেশ বিরল, বলছে বিবিসি।

আইন অনুযায়ী, ভিয়েতনামে সকল ভূমির মালিক সরকার। তারা চাইলে সামরিক-বেসামরিক যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো জমিই অধিগ্রহণ করতে পারে।

তবে দং তাম গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওই জমি চাষ করছেন, কিন্তু জমি অধিগ্রহণের বিপরীতে তাদেরকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।

২০১৭ সালে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে ‘শৃঙ্খলা বিঘ্নের’ অভিযোগে চার জনকে গ্রেপ্তার করা হলে দং তামে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্থানীয়দের বিরোধের খবর প্রথম স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরের শিরোনাম হয়।

ওই গ্রেপ্তারের পাল্টায় গ্রামবাসীরা পুলিশসহ ৩৮ কর্মকর্তাকে এলাকার একটি বাড়িতে সপ্তাহখানেক আটকে রাখে। বাসিন্দাদের কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার শর্তে পরে ওই কর্মকর্তারা ছাড়া পান।

চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ভোরে নিরাপত্তা বাহিনীর হাজার তিনেক সদস্য ওই গ্রামে অভিযান শুরু করলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাদের দাঙ্গা বেধে যায়।

“মোবাইল পুলিশের পোশাক পরা, লাঠিসোঁটা, বন্দুক, শিল্ড নিয়ে অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তারা গ্রামের দিকে ছুটে আসেন,” বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী।

পুলিশ সেসময় মশাল, কাঁদুনে গ্যাস ছুড়েছিল, গ্রামের প্রতিটি কোণ বন্ধ করে দিয়ে নারী ও বয়স্কদেরও মারধর করেছিল, বলে জানিয়েছেন আরেক প্রত্যক্ষদর্শী।

ভিয়েতনামের জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে ও বিতর্কিত ওই জমির বাইরের দিকে সেনাবাহিনীর সীমানা দেয়াল নির্মাণে সহযোগিতায় সেদিন পুলিশ পাঠানো হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে।

“শ্রমিকরা দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করতেই কিছু মানুষ তাতে বাধা দেয়; তারা হাতে বানানো গ্রেনেড, পেট্রল বোমা ও ছুরি নিয়ে পুলিশদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ও শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটায়,” বিবৃতিতে এমনটাই বলা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভিএন এক্সপ্রেস।

সংঘর্ষের এক পর্যায়ে গ্রামের ভেতরে ঢোকা তিন পুলিশ কর্মকর্তা কর্নেল নগুয়েন হুই থিন, ক্যাপ্টেন নগুয়েন কং হুই এবং লেফটেনেন্ট দুয়ং দুক হোয়াং কুয়ান আক্রমণের শিকার হন; শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর তাদের মৃত্যু হয় বলে জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলনের নেতা কিনের মৃতদেহ পাওয়া যায় গ্রামের একটি বাড়ির ভেতর, সেসময় ৮৪ বছর বয়সী এ বৃদ্ধের হাতেও একটি গ্রেনেড ছিল।

কিনের পরিবারের সদস্য ও সমর্থকরা মন্ত্রণালয়ের এ ভাষ্য প্রত্যাখ্যান করে; ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে নিহত কিনের শরীরে বুলেটের ক্ষত দেখার কথাও জানিয়েছে তারা।

নিরাপত্তা বাহিনীর সেদিনের অভিযানে কিনের ছেলে লে দিন চুকও আহত হন। পুলিশ পরে অনেকগুলো পেট্রল বোমা, লোহার রড ও অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করেছে বলে উপমন্ত্রী লুয়ং তাম কুয়াং জানিয়েছেন।

হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

কিন একসময় ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন; যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার অবস্থান সরকারবিরোধী ছিল বলে জানিয়েছে বিবিসি।

সোমবার কিনের পরিবারের তিন সদস্যকে টেলিভিশনে হাজির করা হয়; মুখে আঘাতের চিহ্ন থাকা ওই সদস্যরা পেট্রল বোমাসহ ঘরে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র বানানোর কথা জানালেও ওই স্বীকারোক্তি জোর করে আদায় করা হয়েছে বলে সন্দেহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।

কিনের স্ত্রী দু থি থানও পুলিশ তাকে মারধর করেছে বলে অভিযোগ করেছেন।

নিরাপত্তা বাহিনীর এ ধরনের অত্যধিক বলপ্রয়োগ নিয়ে ভিয়েতনামজুড়েই ব্যাপক সমালোচনা চলছে।

“দুই পক্ষই সীমা অতিক্রম করেছে বলে অনুমান আমার। ভোর চারটার দিকে গ্রামের মধ্যে হাজার হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য পাঠানো কখনোই সঠিক সমাধান হতে পারে না,” বিবিসি ভিয়েতনামকে এমনটাই বলেছেন হ্যানয়ের সাবেক সাংসদ ফাম থি লোন।

সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।