ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: মার্কিনিদের মৃত্যু সচেতনভাবে এড়িয়েছে ইরান?

শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলেমানির হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ব্যবহৃত দুটি বিমান ঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Jan 2020, 09:46 AM
Updated : 9 Jan 2020, 09:46 AM

সোলেমানিকে হত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ‘চরম মূল্য’ দিতে হবে বলে তীব্র ভাষায় সতর্ক করেছিল ইরান; কিন্তু তা সত্ত্বেও বুধবার তেহরানের চালানো প্রতিশোধমূলক হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কেউ আহতও হননি বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।

তাহলে ইরান কী সচেতনভাবেই মার্কিনিদের মৃত্যু এড়িয়েছে, এমন জিজ্ঞাসা সামনে রেখে প্রতিবেদন করেছে বিবিসি।  

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র কী বলেছে?

ইরানের ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) বলেছে, “যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী ও আগ্রাসী সেনাবাহিনীর দখল করা বিমান ঘাঁটি আল আসাদ গুড়িয়ে দিতে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ১০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে।”

পশ্চিম ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য আইন আল আসাদকেই প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে মার্কিনিরা।

আইআরজিসির ঘনিষ্ঠ ইরানের তাসনিম বার্তা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলায় ফাতেহ-৩১৩ ও কিয়াম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং এগুলোতে ক্লাস্টার ওয়ারহেড থাকার কারণে মার্কিন বাহিনী এগুলো প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ওয়ারহেডগুলো আল আসাদে ‘বহু বিস্ফোরণ’ ঘটিয়েছে বলে তাসনিম জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরান এক ডজনেরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে যেগুলো অন্তত ইরাকের দুটি সামরিক ঘাঁটি, আল আসাদ ও আধা-স্বায়ত্তশাসিক কুর্দিস্তান অঞ্চলের ইরবিলকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছে।

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মার্কিন বাহিনীর কেউ হতাহত হয়নি এবং ঘাঁটি দুটির ‘সামান্য ক্ষতি’ হয়েছে বলে ট্রাম্প জানিয়েছেন।

টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক বিবৃতিতে তিনি ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার জন্য ‘গৃহীত পূর্ব সতর্কতা, বাহিনীগুলোকে ছড়িয়ে রাখা এবং আগাম সতর্ক করার পদ্ধতি যা অত্যন্ত ভালো কাজ করেছে’, এসব পদক্ষেপকে কৃতিত্ব দিয়েছেন; এরপর ঘোষণা করেছেন, “ইরান তাদের অবস্থান থেকে সরে আসছে বলেই মনে হচ্ছে।”

তবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর জেনারেল মার্ক মিলি জানিয়েছেন, হামলাটি মারাত্মক ছিল বলেই বিশ্বাস তার।

নিজের ‘ব্যক্তিগত মূল্যায়ন’ জানিয়ে তিনি বলেন, “স্থাপনার ক্ষতি, সামরিক যান, সরঞ্জাম ও এয়ারক্রাফট ধ্বংস এবং সৈন্যদের হত্যা করার অভিপ্রায় ছিল ইরানের।”

ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রকৃতপক্ষে কোথায় আঘাত হেনেছে?  

ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেউ হতাহত হয়নি, ইরাকের সামরিক বাহিনীও এমনটি জানিয়েছে। ইরাকের স্থানীয় সময় বুধবার ভোররাত ১টা ৪৫ মিনিট থেকে ২টা ১৫ মিনিটের মধ্যে ইরাকে ২২টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে তারা। এর মধ্যে আল আসাদ বিমান ঘাঁটির দিকে ১৭টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয় বলে তারা জানিয়েছে।

মিডলবুড়ি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন্য বাণিজ্যিক কোম্পানি প্ল্যানেট ল্যাবস কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে যে ছবিগুলো তুলেছে তাতে আল আসাদ ঘাঁটির অন্তত পাঁচটি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দেখা গেছে।

মিডলবুড়ি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ডেভিড স্মেলার বলেছেন, “কিছু আঘাতের স্থান দেখে মনে হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূল কেন্দ্রেই আঘাত হেনেছে।”

পাশাপাশি কিছু ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানেনি এটিও পরিষ্কার। ইরাকি সামরিক বাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী, আল আসাদ লক্ষ্য করে ছোড়া দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হিত শহরের পশ্চিম দিকে হিতান এলাকায় গিয়ে পড়েছে এবং সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি।

ক্ষেপণাস্ত্র দুটির মধ্যে একটির অবশিষ্টাংশের ছবি ঘটনার পরপরই সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, তাতে ক্ষেপণাস্ত্রটির কাঠামোর তিনটি অংশ দৃশ্যমান।

ইরাকি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় কুর্দিস্তান অঞ্চলের ইরবিল বিমান ঘাঁটির দিকে পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান।

তবে এগুলোর মধ্যে কয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিটিতে আঘাত হেনেছে তা জানায়নি তারা। কিন্তু টেলিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ইরবিলের ১৬ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে সিদান গ্রামে গিয়ে পড়েছে এবং তৃতীয় আরেকটি ইরবিল থেকে ৪৭ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে বারদাহ রাশশ এলাকায় পড়েছে।

বারদাহ রাশশে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করা গর্ত থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করছে, ইতোমধ্যে এমন ছবি তুলেছেন সাংবাদিকরা।

ইরান কি মার্কিনিদের মৃত্যু এড়ানোর চেষ্টা করেছিল?

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সরকারের সূত্রগুলো রয়টার্সকে বলেছে, তাদের বিশ্বাস সংকট যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, যার সমাধান করার ইঙ্গিত তারা এখনও দিচ্ছে, তার জন্য ইরানিরা সচেতনভাবে হতাহত হ্রাস করা চেষ্টা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনাগুলোতে আঘাত এড়ানোর চেষ্টা করেছে।

“সচেতনভাবেই জীবননাশ হবে না এমন লক্ষ্যগুলো বেছে নিয়েছে ইরান,” পেন্টাগনের এক কর্মকর্তা এমনটি বলেছেন বলে তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন সিএনএনের সাংবাদিক জেইক টাপার।

 

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরাকে মার্কিন লক্ষ্যস্থলগুলোতে ইরান হামলা করা স্থির করেছে, মঙ্গলবার বিকালেই তারা এমনটি জানতেন বলে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন। তবে কোন লক্ষ্যস্থলে হামলা হচ্ছে তা পরিষ্কার ছিল না বলে জানিয়েছেন তারা।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো থেকে আগাম সতর্কতা পাওয়ার পাশাপাশি ইরাকের টেলিযোগাযোগ থেকেও ইরানের হামলার বিষয়ে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল বলে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে।

বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএসের পেন্টাগন সংবাদাতা ডেভিড মার্টিন জানিয়েছেন, ‘বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই’ যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করা হয়েছিল বলে এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন। এতে মার্কিন সৈন্যরা বাংকারে আশ্রয় নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষার ওপর নজরদারী করার জন্য যে ধরনের আড়িপাতার স্যাটেলাইট, সিগন্যাল ও যোগাযোগের সমন্বিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেই একই পদ্ধতির মাধ্যমে আগাম সতর্কতা পাওয়া গিয়েছিল।

 

তবে ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এরকম কোনো আগাম সতর্কর্তা জানানো হয়েছে, এমন কোনো কিছু জানানে এরকম একজনও কর্মকর্তাকেও (যাদের মধ্যে একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও আছেন) পাননি বলে জানিয়েছেন মার্টিন। ইরানের ব্যর্থতা ‘ইচ্ছাকৃত’ বলেও মনে করেন না ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকতা, জানিয়েছেন মার্টিন।

“আমাদের তৎপরতাই আমেরিকানদের জীবন রক্ষা করেছে,” বলেছেন ওই কর্মকর্তা।

বিবিসির প্রতিরক্ষা সংবাদাতা জোনাথন মার্কাস বলেছেন, “সঠিক কী হয়েছে তা এখনও অপরিষ্কারই রয়ে গেছে। তবে মার্কিন ঘাঁটির বিরুদ্ধে দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কিছু অর্জন করার পথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

“প্রাথমিকভাবে বেসামরিক স্যাটেলাইট ছবিগুলো দেখে আল আসাদ বিমান ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কয়েকটি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তাই হতাহত না হওয়ার বিষয়টি পরিকল্পনা থেকে না হয়ে ভাগ্যের জোরেও হতে পারে।”