ইরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ঐক্য চাইলেন ট্রাম্প

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কেউ হতাহত হয়নি জানিয়ে তেহরানের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হতে রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোকে পাশে চাইলেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2020, 05:19 PM
Updated : 9 Jan 2020, 02:39 AM

স্থানীয় সময় বুধবার ভোরে ইরাকে দুটি বিমান ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের অবস্থানে ডজনখানেকের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।

জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে হত্যার বদলা হিসেবে ইরাকের ইরবিল ও আইন আল আসাদ ঘাঁটিতে তাদের ছোড়া ১৫টি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে অন্তত ৮০ ‘মার্কিন সন্ত্রাসী’ নিহত হয় বলে দাবি করেছিল ইরান।

তবে ওয়াশিংটনের সময় বুধবার সকালে হোয়াইট হাউজে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, “ইরানের গত রাতের হামলায় কোনো আমেরিকান আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। আমাদের কেউই হতাহত হয়নি। আমাদের সব সৈন্য নিরাপদে আছে এবং আমাদের সেনা ঘাঁটিতে খুব সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তির জন্য চীন ও রাশিয়াসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।  

ট্রাম্প বলেন, “ইরানের সঙ্গে এমন একটি চুক্তির জন্য আমাদের কাজ করতে হবে, যেটা এই বিশ্বকে আরও নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ করে।”

 

ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক স্পেনসার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের পাশে রেখে জাতির উদ্দেশে এই ভাষণ দেন ডনাল্ড ট্রাম্প।

তিনি বলেন, “প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আমাদের সেই মহান সেনাবাহিনী ও সমরাস্ত্র রয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের এগুলো ব্যবহার করতে হবে। আমরা এগুলো ব্যবহার করতে চাই না।”

আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার শ্রেষ্ঠত্বই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ মন্তব্য করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমাদের মহান আমেরিকান সামরিক বাহিনী যে কোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত। ইরানকে মনে হচ্ছে পিছু হটেছে, যা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য শুভ এবং বিশ্বের জন্যও ভালো।”

তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাম্পের বক্তব্যের বিষয়ে ইরানের কোনো কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে আধা সরকারি ফারস বার্তা সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্যকে ‘হুমকি দেওয়া থেকে বড় প্রত্যাবর্তন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের অবস্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে জেনারেল কাসেম সোলেমানি হত্যার বদলা নিয়েছে ইরান

এর আগে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী এক বিক্ষোভে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেন, ইরানের এই হামলা ‘যুক্তরাষ্ট্রের মুখে চপেটাঘাত’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের উচিত এই অঞ্চল ত্যাগ করা।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ জারিফ বলেছেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে সোলেমানি হত্যার বদলা নেওয়া হয়েছে।

“আমরা উত্তেজনা বৃদ্ধি বা যুদ্ধ চাই না। তবে যে কোনো আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করব,” টুইটারে লিখেছেন তিনি।

যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া?

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন সরকারি সূত্র বলছে, পরিস্থিতি আরও অবনতি যেন না হয় সেজন্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের হতাহত যাতে এড়ানো যায়, তা ইরান খুব করে চেয়েছে বলেই তাদের বিশ্বাস।

তবে ইরানের সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র হামলার আগে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগের খবর অস্বীকার করেছেন বলে বার্তা সংস্থা ফারস জানিয়েছে।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে অভিসংশিত ট্রাম্পকে এই বছরই আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে হবে। এরমধ্যেই তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, ইরান যদি সোলেমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে যায় তাহলে দেশটির ৫২টি লক্ষ্যে হামলা চালানো হবে। তবে বুধবারের ভাষণে সেই অবস্থান থেকে সরে এলেন তিনি।  

অপরদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার অফিসের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইরানিয়ান টেলিভিশন জানিয়েছে, ইরান প্রতিশোধমূলক যে সব পদক্ষেপ নিতে পারে তার মধ্যে ‘সবচেয়ে দুর্বল’ এই ক্ষেপণাস্ত্র। ইরান আরও ১০০ হামলার লক্ষ্য ঠিক করে রেখেছে বলে আরেকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।  

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ফুটেজে রাতের আকাশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ দেখানো হচ্ছে। এর সঙ্গে ভেসে আসছে ‘আল্লাহ মহান’।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রথাগত সামরিক লড়াই এড়াতে চেয়েছে ইরান।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, সোলেমানির কমান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে হামলার পরিকল্পনা হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে, যদিও এই বক্তব্যের পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ দেননি।

দাফনের আগে সোলেমানির মরদেহ ইরাক ও ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে নেওয়া হয়, যেখানে লাখ লাখ জনতার সমাবেশ ঘটে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। মঙ্গলবার তার দাফন অনুষ্ঠানে পদদলনে অন্তত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সোলেমানিকে দাফনের ফুটেজ দেখানো হচ্ছে, যেখানে শত শত মানুষকে ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ বলে স্লোগান দিতে দেখা যায়।

“তার হত্যার বদলা নেওয়া হয়েছে এবং এখন তিনি শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন,” বলছে ইরানি টেলিভিশন।

যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলার যে প্রস্তুতি ইরানের

বিপুল পরাক্রমশালী ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে কীভাবে সামলানো হবে, সে পরিকল্পনা নিয়ে ইরান কয়েক দশক ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গত বছরের প্রতিবদনের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইরানের এলিট ফোর্স রেভোল্যুশনারি গার্ডের এক লাখ ২৫ হাজার সৈন্যসহ পাঁচ লাখের বেশি সৈন্য রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ির কারণে অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করা ইরানের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এই ঘাটতি পূরণে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে নিজেদের শক্তির জায়গা বৃদ্ধি করেছে তারা। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, প্রাণঘাতী ড্রোন এবং ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে লাখ লাখ মিলিশিয়া মিত্রকে প্রস্তুত করেছে, যাতে প্রচলিত যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে থেকে শত্রুপক্ষকে আঘাত করা যায়।

একজন সাবেক ব্রিটিশ সেনা কমান্ডার বলছেন, “তাদের নিয়মিত সামরিক বাহিনী খুব, খুবই হালকা, বেশ সনাতনী এবং বর্তমান সময়ের উপযুক্ত নয়। তারা সব অর্থ ব্যয় করেছে বিকল্পভাবে আক্রমণের সক্ষমতা অর্জনের পেছনে।

“এক্ষেত্রে তারা বেশ ভালোই প্রস্তুত।”

যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির গত বছরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে বড় মজুদ গড়ে তুলেছে ইরান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্তত সাড়ে ৭৫০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম ‘স্কাড’ ক্ষেপণান্ত্র। এছাড়া উত্তর কোরিয়াভিত্তিক নো ডং ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দুই হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম, যার আওতায় ইসরায়েল ও দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের দেশ রয়েছে।

ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডের রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সক্ষমতা সম্পন্ন স্পিডবোট ও ছোট আকৃতির সাবমেরিন, যেগুলো পারস্য উপসাগর দিয়ে তেল পরিবহনে বিঘ্ন ঘটাতে বাণিজ্যিক ট্যাঙ্কার ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে। গত বছর তেহরান ছয়টি ট্যাঙ্কারে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে ওয়াশিংটনের।

জেন’সে ডিফেন্স সাপ্তাহিকের মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা এডিটর “আপনি যদি জাহাজ, ট্যাংক, যুদ্ধ বিমানের দিকে তাকান তাহলে ইরানকে খুব দুর্বল মনে হবে। তবে আপনি যদি এন্টি-শিপ মিসাইল, ব্যালিস্টিক মিসাইল, ইউএভি এবং এসব জিনিস দেখেন তাহলে একে বেশ সক্ষম মনে হবে।”

১৮ বছর ইরানের নৌবাহিনীতে কাজ করে আসা সামরিক বিশ্লেষক হোসেন আরিয়ান বলেন, “পারস্য উপসাগরে ইরানের বড় যুদ্ধ জাহাজ, ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ারের দরকার নেই। স্পিডকোট, গান বোট ও মিসাইল বোটই কাজ সারতে পারবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় নিহত মেজর-জেনারেল কাসেম সোলেইমানি ছিলেন রেভোল্যুশনারি গার্ডস কুদস ফোর্সের প্রধান। এই বাহিনীই ইরানের বাইরে ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননে বিভিন্ন মিত্র বাহিনী ও মিলিশিয়াদের সঙ্গে কাজ করত।লেবাননের হেজবোল্লাহ ও ইরাকি মিলিশিয়াদের একটি বড় অংশই ইরানঘনিষ্ঠ।

ইরাক-ইরান থেকে নিরাপদ দূরত্বে

যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ইরাক-ইরান থেকে নাগরিকদের সরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে ফিলিপিন্স।

এদিকে বুধবারই ইরানের একটি বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর ইউক্রেইনের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ১৭৬ আরোহী নিহত হওয়ার পর ইরাক-ইরানের আকাশপথ পরিহার করছে বিশ্বের বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো।

আগামী ২৪ ঘণ্টার জন্য ইরাক ও ইরানে সব ফ্লাইট বাতিল করেছে টার্কিস এয়ারলাইন্স। তুরস্কের পেগাসাস এয়ারলাইন্সও সাময়িকভাবে এই দুই দেশে ফ্লাইট স্থগিত করেছে।

ফ্রাঙ্কফুর্ট ও তেহরানের নিয়মিত ফ্লাইট বাতিল করেছে জার্মানির লুফথানসা এয়ারলাইন্স।

দুবাইভিত্তিক এমিরেটস এয়ারলাইন্স বাগদাদের একটি ফ্লাইট বাতিল করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ফ্লাইদুবাইও বাগদাদের একটি ফ্লাইট বাতিল করেছে।

এর বাইরে ফ্রান্সের কেএল এম এয়ার ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, ভিয়েতনাম এয়ারলাইন্স, নরওয়ের এয়ার শাটল, তাইওয়ানের চায়না এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, অস্ট্রেলিয়ার কান্তাস এয়ারলাইন্সসহ বহু এয়ারলাইন্স ইরাক ও ইরানের আকাশপথ এড়িয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।