মাঝ দিয়ে নদী বয়ে যাওয়া জাপানের শিকোকু দ্বীপের এ গ্রামটিতে এখন দুই ডজনের চেয়ে সামান্য বেশি পূর্ণবয়স্কের বাস। শেষ দুই শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ শ্রেণি পাস করার পর ২০১২ সালে গ্রামটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরজাও বন্ধ হয়ে যায়।
তবে সম্প্রতি শরতের এক উজ্জ্বল দিনে সুকিমি আয়োনো স্কুলটিতে শিশুদের ফিরিয়ে এনেছেন। না মানুষ নিয়ে নয়, পুতুল দিয়ে। ৭০ বছর বয়সী এ বৃদ্ধা ৪০টিরও বেশি হাতে তৈরি পুতুল বন্ধ স্কুলটির মাঠে সাজিয়ে রেখেছেন; দৌড় প্রতিযোগিতা, দোলনা আর বল ছোড়া খেলার মাধ্যমে ফিরিয়ে এনেছেন জাপানি ক্যালেন্ডারে থাকা স্কুল স্পোর্টস ডে, ‘উনদোকাই’।
“আমরা এখানে আর শিশু দেখি না, আমি চাইতাম অনেক বেশি শিশু থাকলে এটা আরও আনন্দদায়ী হতো, যে কারণে আমি শিশুদের (পুতুল) তৈরি করেছি,” বলেছেন গত সাত বছর ধরে বাৎসরিক পুতুল উৎসব মঞ্চস্থ করা নাগোরোতে জন্ম নেওয়া আয়ানো।
জাপানের জনসংখ্যা দিন দিন কমে আসছে ও অবশিষ্টরা বুড়িয়ে যাচ্ছে; পরিস্থিতির ধাক্কা এখন এমনকি দুর্গম এলাকাগুলোতেও টের পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে নিম্ন জন্মহার উৎসাহিত হচ্ছে কর্মসংস্থানের অভাব এবং সমস্যাসংকুল জীবনযাপনের কারণে।
“তরুণদের জন্য এখানে কোনো সুযোগ নেই। তারা এখানে বাঁচতে পারবে না,” ভাষ্য আয়ানোর। যার স্মরণে আছে, নাগোরোতে একসময় হাসপাতাল, পাচিনকো গ্যাম্বলিং পার্লার ও খাওয়ার দোকান ছিল। কিন্তু এখন একটিও নেই।
আয়ানো এবং তার বন্ধুরা এখানে ৩৫০ এর বেশি পুতুল বানিয়েছেন; যে সংখ্যা এখান মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ গুণ। কাঠ আর তারের কাঠোমো দিয়ে বানানো, খবরের কাগজ ও জাপানের বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া পুরনো কাপড় দিয়ে বানানো এ পুতুলগুলো নাগারোর বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হচ্ছে।
স্কুলের ভেতর থাকা পুতুলগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি সিড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করছে, কেউ শিক্ষকের সামনে ডেস্কে বসে পাঠ নিচ্ছে। আয়ানোর পুতুলগুলোর মধ্যে আছে উচ্ছ্বাস, মনে হচ্ছে যেন সবগুলোই জীবন্ত। যে কারণে পুতুলভর্তি শহরের কথা শুনলে যেমন অদ্ভূত মনে হওয়ার কথা, তেমনটা মনে হচ্ছে না।
“আমি মনে করছি না এটা ছমছমে কিছু,” বলেছেন ফ্রান্স থেকে নাগোরো গ্রাম দেখতে আসা ৩৮ বছর বয়সী সেবিকা ফেনি রেনড। ট্রাভেল ব্লগে পুতুলের গ্রামের কথা শুনে আগ্রহী হয়ে স্বামী ৫৫ বছর বয়সী ক্রিস মননকে নিয়ে এসেছেন তিনি।
“আমার মনে হয় গ্রামটিতে প্রাণ ফেরাতে এটি একটি চমৎকার উপায়,” ভাষ্য ফেনির।
অন্য এক পর্যটক স্কুলের এক শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে লেখা বার্তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, যেখানে লেখা আছে,“জীবিতরা কোথায়?”
নাগোরো হচ্ছে জাপানের সেই পৌর এলাকাগুলোর একটি, যাদের বাসিন্দাদের মধ্যে ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সীর সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও বেশি। শিশুসেবায় ভর্তুকি, মেডিকেল খরচ ও বাড়ি নির্মাণে ছাড় দিয়েও এসব এলাকাগুলো নতুন বাসিন্দাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না, পারছে না এলাকাগুলোর তরুণদের ফেরাতেও।
চার ভাইবোনের বড় আয়ানোও ১২ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে ওসাকা চলে গিয়েছিলেন; তার বাবা জাপানের তৃতীয় বৃহত্তম শহরটির একটি খাদ্য কোম্পানিতে কাজ করতেন। আয়ানোর বিয়েও সেখানেই হয়; দুই সন্তানকে বড়ও করেন সেখানে।
তাদের বাড়ির সামনে আয়ানো কিছু লাল মুলা ও মটর বীজ রোপন করেছিলেন। পাখির হাত থেকে বাঁচাতে এরপর সেখানে বানান বাবার চেহারার কাকতাড়ুয়া।
“দেখতে সত্যিকারের মানুষ মনে হয়, সাধারণ কাকতাড়ুয়া নয়। এ কারণেই এটি ভালো কাজ করেছে,” বলেন এ নারী।
রাস্তার অপর পাশে মাঠের মাঝে কিছু নারী পুতুল বসিয়েছেন, দেখে মনে হচ্ছে কিষানিরা নিড়ানি দিচ্ছে। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া অনেকেই বিভ্রান্ত হন; অনেকে ওই পুতুলগুলোকে সত্যিকারের নারী মনে করে প্রশ্নও করে বসেন।
আয়ানো এখন মাঝে মাঝে কাছের শহরগুলোতে কিংবা গ্রামের পুরনো নার্সারি স্কুলে বানানো তার স্টুডিও দেখতে আসা লোকজনকে পুতুল বানানোর প্রশিক্ষণ দেন।
স্পোর্টস ফেস্টিভালে কাছাকাছি শহরের বেশকিছু শিশু তাদের দাদা-দাদির হাত ধরে ‘উনকোদাই’ দেখতে আসে। শিশুদের সংখ্যা বেশি না থাকায় বৃদ্ধ অনেকেও সেই খেলায় যোগ দেন।
এদেরই একজন হিরোয়ুকি ইয়ামামোতো। পাহাড়ের নিচে একটি সদনে বসবাস করা ৮২ বছর বয়সী এ ব্যক্তি একটি পুতুলের গালে হাত দিয়ে পুলক অনুভব করছেন।
“সে খুবই সুন্দর। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই,” বলেছেন ইয়ামামোতো। এসেছেন ৬৭ বছর বয়সী কায়াকো মোতোকাওয়া, যার নিজেরই পুতুলের মতো দেখতে একটি নাতি আছে।
নাগোরো যে এখন মানুষের বদলে পুতুলের জন্য বিখ্যাত হতে চলেছে, তাতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এ বৃদ্ধা।
“যদি এরা মানুষ হতো, তাহলে এটি সত্যিকারের সুখী স্থান হতো,” পুতুলগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন মোতোকাওয়া।