জুয়া জিতলেন জনসন, এখন ব্রেক্সিট

ব্রেক্সিটের বোর্ডে একই রকম জুয়ার দান; দুই বছর আগে হেরে গিয়েছিলেন টেরিজা মে, তবে বরিস জনসন জিতলেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2019, 07:51 PM
Updated : 13 Dec 2019, 07:53 PM

বৃহস্পতিবারের সাধারণ নির্বাচন কনজারভেটিভ পার্টিকে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি এনে দিয়েছে, যা যুক্তরাজ্যের কোনো সরকারের হাতে বহুদিন দেখা যায়নি।

কনজারভেটিভ নেতা জনসন আশা করছেন, তার দলের এই অসাধারণ বিজয় ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিভাজন ঘোচাতে সহায়ক হবে, ক্ষতে এনে দেবে উপশম।

সমর্থকদের হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, “আর কোনো ‘যদি’ নয়, আর কোনো ‘কিন্তু’ নয়, আর কোনো ‘হয়ত’ নয়, আসছে ৩১ জানুয়ারিই আমরা ব্রেক্সিট শেষ করব।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের জুয়ায় জনসন জিতেছেন ঠিক, তবে ২৮ দেশের ইউরোপীয় পরিবার থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার আসল চ্যালেঞ্জ জয়ের লড়াই কেবল শুরু হল।

জুয়া

২০১৭: ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোটের পর টালমাটাল যুক্তরাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার নয় মাসের মাথায় আকস্মিকভাবে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে।

তার উদ্দেশ্য ছিল পার্লামেন্টে নিজের দলের অবস্থান মজবুত করা, যাতে আগামী বছরগুলোতে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার পথ সুগম হয়, বিরোধীদের বাধা ডিঙিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ৬৫০ আসনের মধ্যে ৩৩০টি তখন মের কনজারভেটিভ পার্টির হাতে, আর জেরেমি করবিনের লেবার পার্টির হাতে ২৬২ আসন।

কিন্তু সেই জুয়ায় হেরে গেলেন মে।

২০১৭ সালের ৮ জুন নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির আসন কমে হল ৩১৭টি। অন্যদিকে লেবার পার্টির আসন ৩০টি বেড়ে হল ২৬২টি। টোরিদের ভোটের হার যেখানে ৫.৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়লো, লেবারের বাড়লো ৯.৬ শতাংশ পয়েন্ট।   

এমপিদের বিরোধিতায় ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে না পেরে এক বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হলেন টেরিজা মে।

কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব আর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রিত্বের সঙ্গে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের দায়িত্ব ঘাড়ে নিলেন ৫৫ বছর বয়সী জনসন, নানা কারণে আলোচিত রাজনীতিবিদ বরিস জনসন।

২০১৯: জনসনকে ঘিরে শুরু থেকেই ছিল সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তা। নিজের দলের এমপিরাও তার বিরোধিতা করেছেন, একের পর এক হার এসেছে পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গিয়ে ব্রেক্সিটের সময় পেছাতে হয়েছে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।

এই দুর্যোগ সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত জনসনও হাঁটলেন জুয়ার পথে, আগাম নির্বাচনের জুয়া। স্নায়ুক্ষয়ী টানাপোড়েনের পর পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত দিল, ভোট হবে ১২ ডিসেম্বর।

সেই জুয়া জিতে গেলেন বরিস জনসন।

বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬৫টি জিতে নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল বরিসের কনজারভেটিভ পার্টি। আর প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি ৫৯টি আসন খুইয়ে পেল ২০৩টি।

টোরিদের ভোটের হার বাড়লো ১.২ শতাংশ পয়েন্ট , লেবার হারালো ৭.৯ শতাংশ পয়েন্ট।   

জয়ের মন্ত্র

বরিস চেয়েছিলেন পার্লামেন্টে আরও যথেষ্ট আসন, যাতে তার ব্রেক্সিট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর বাধায় পড়তে না হয়।

ভোট শেষে বৃহস্পতিবার রাতে গণনার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকলো যুক্তরাজ্যের মানচিত্রের রাজনৈতিক রঙ। লেবারের অনেক লাল বিন্দু সকাল হতে হতে হয়ে গেল টোরিদের নীল।

কোন মন্ত্রে এই জুয়া জিতলেন উস্কোখুস্কো চুলের অস্থিরমতি জনসন?

বিবিসির পলিটিকাল এডিটর লরা কুয়েনসবার্গ এবং যুক্তরাজ্যে রয়টার্সের চিফ পলিটিক্যাল করেসপনডেন্ট এলিজাবেথ পাইপারের বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে মিলে যাচ্ছে।

তারা দুজনেই বলছেন, সুইং ভোটারদের মন জয় করে ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার সনাতনী চেষ্টায় এবার যাননি কনজারভেটিভ নেতা। বরং তার লক্ষ্য ছিল প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সেই সব আসন, যেখানে টোরিদের ভোট দেওয়াও অনেকের বিবেচনায় ‘পাপ’।

জনসনের লক্ষ্য ছিল একটাই- ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’।

ব্রেক্সিট প্রশ্নে পার্লামেন্টের অচলাবস্থা আর নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে লেবারের লাল দুর্গের পাঁজরেও তৈরি হয়েছিল হতাশা। এবার ভোটের প্রচারে সেই দুর্বলতাই টোরিরা কাজে লাগিয়েছে বলে মনে করছেন রয়টার্সের এলিজাবেথ পাইপার।

আর তাতে ফল মিলেছে হাতে হাতে, আশির দশকে মার্গারেট থ্যাচারের পর সবচেয়ে বড় জয়ের দেখা পেয়েছে জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি। 

যাত্রা সবে শুরু

কনজারভেটিভ পার্টির বড় জয় তাৎক্ষণিকভাবে বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে দৃশ্যপটে।

বিবিসির লরা কুয়েনসবার্গ মনে করছেন, অদ্ভুতুড়ে কিছু না ঘটলে আসছে শুক্রবার জনসনের ব্রেক্সিট পরিকল্পনা পার্লামেন্টে উঠবে এবং ভোটাভুটিতে উৎরেও যাবে। 

সেক্ষেত্রে জানুয়ারির শেষে নির্ধারিত সময়েই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ ঘটবে যুক্তরাজ্যের।  

গত তিন বছরে ব্রেক্সিটের চক্করে নাভিশ্বাস ওঠা ব্রিটিশ ভোটার যদি ভেবে থাকেন, ৩১ জানুয়ারিই সব ঝামেলা শেষ হচ্ছে, তিনি ভুল ভাবছেন। 

আসলে সেটা হবে ব্রেক্সিট বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের এক্সিটের শুরু।

এরপর ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত একটি সময় পাবে ব্রিটেন। পুরনো সম্পর্ক ভুলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের একটি রূপরেখা এর মধ্যে ঠিক করতে হবে।

দর কষাকষি হবে বাণিজ্য, সীমান্ত নীতি, কর কাঠামো, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, শিল্প পণ্য পরিবহন, নিরাপত্তা, তথ্য বিনিময়- ইত্যাদি ইত্যাদি প্রায় সব কিছু নিয়ে। 

জনসন যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই রূপরেখা চূড়ান্ত করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে ব্যর্থ হন, এবং আলোচনার সময় বাড়ানোর চেষ্টা না করেন, তাতে সেই ‘নো ডিল’ ব্রেক্সিটের মত একই ফল হবে।

ইইউর সঙ্গে চার দশকের সেই সম্পর্কের অবসানের পর যুক্তরাজ্যকে নতুন চলার পথ দেখানোর এই কাজটি সহজ হবে না বলেই মনে করছেন কুয়েনসবার্গ। 

তার ভাষায়, যে বিপুল সমর্থনের রসদ জনগণ কনজারভেটিভ নেতার হাতে তুলে দিয়েছে, তা তাকে খরচ করতে হবে যথেষ্ট হিসাব করে।