মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে সৌদিকে ‘টপকে যাচ্ছে ইরান’

প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবকে হারিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত লড়াইয়ে জিততে যাচ্ছে বলে লন্ডনভিত্তিক এক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের গবেষণায় দাবি করা হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2019, 08:47 AM
Updated : 7 Nov 2019, 08:48 AM

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) এ গবেষণায় বলা হয়েছে, রিয়াদের শতকোটি ডলার বিনিয়োগের পাল্টায় এর ভগ্নাংশ পরিমাণ খরচ করেও তেহরান এখন সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও ইয়েমেনের ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে সৌদি আরব দশকের পর দশক ধরে শত শত কোটি ডলারের পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র কিনেছে, যার বেশিরভাগই যুক্তরাজ্য থেকে গিয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রে পিছিয়ে থেকেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছেছে বলে আইআইএসএস জানিয়েছে।

‘মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নেটওয়ার্কের প্রভাব’ শীর্ষক ২১৭ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে লন্ডনভিত্তিক এ থিঙ্কট্যাঙ্কটি জানায়, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ১৯৭৯ সালে দেশটির নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই তারা তাদের প্রভাব সীমানার বাইরেও বিস্তৃত করার কাজ শুরু করে।

এ কাজে তারা প্রথম যুক্ত করে লেবাননের হিজবুল্লাহদের। সাদ্দাম হুসেনকে উৎখাতের পর শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাকে তারা গড়ে তোলে আধাসামরিক পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট (পিএমইউ)। সিরিয়া যুদ্ধে বাশারের পাশে দাঁড়িয়ে তেহরান তাদের প্রভাব ইসরায়েলের সীমানায় নিয়ে যায়, ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হস্তক্ষেপ করলে ইরান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় হুতিদের দিকে। 

“ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যকে নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে, পুরোনো ঘরানার শক্তিশালী বাহিনীগুলোকে প্রতিহত এবং তৃতীয় পক্ষের শক্তিগুলোকে ব্যবহার করে তারা এটা অর্জন করেছে,” বলা হয়েছে আইআইএসএসের প্রতিবেদনে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই পাল্টে যাওয়া চিত্রের মূল অনুঘটক বলা হচ্ছে ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (আইআরজিসি) বৈদেশিক বিভাগ ‘কুদস ফোর্স’কে, যারা সমগ্র অঞ্চলে তেহরানের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর।

এই কুদস ফোর্স ও তাদের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানির সরাসরি যোগাযোগ ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সঙ্গে।

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী সাদ্দামকে উৎখাত করার পর থেকে ইরাক ও অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষ করে শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে কুদস ফোর্স পেখম মেলতে শুরু করে।

সাদ্দামকে বলা হতো, মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রাচীর। ওই প্রাচীর সরে যাওয়ার পর কুদস ফোর্স তড়িৎগতিতে শক্তিবৃদ্ধির কাজ শুরু করে; বিভিন্ন গোষ্ঠীর মেলবন্ধনে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজে সচেষ্ট হয়।

কেবল তাই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিদের প্রচলিত ঘরানার সেনাবাহিনীর মোকাবিলায় তারা ড্রোন ও সাইবার হামলার মতো অপ্রচলিত কিন্তু শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কার্যকর পথে হাঁটা শুরু করে।

কুদস ফোর্সের এসব কাজের আনুষ্ঠানিক ‘স্বীকৃতি মেলে’ চলতি বছরের এপ্রিলে; এ বছরই যুক্তরাষ্ট্র আইআরজিসিকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর অন্তর্ভুক্তির ঘটনা এটাই প্রথম।

ওয়াশিংটনের ওই ঘোষণার পাল্টায় তেহরানও পরে উপসাগরের মার্কিন বাহিনীকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করে।  

আইআইএসএস বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ধারাবাহিক প্রভাববৃদ্ধির সবচেয়ে বড় উদাহরণ লেবাননে হিজবুল্লাহর প্রাধান্য। ইরান সমর্থিত এ গোষ্ঠীটির সশস্ত্র অংশের পাশাপাশি রাজনৈতিক অংশও বেশ তৎপর। লেবাননের ক্ষমতা কাঠামোতেও তাদের প্রভাব অপরিসীম।

সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এবং আসাদবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইরান ও রাশিয়ার সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। হাসান নাসরাল্লাহর এই বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ‘জুনিয়র পার্টনার’ হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে বলেও ধারণা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের।

‘আরব বসন্তের’ সময় ইরান তার প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব এবং এর মিত্র বাহরাইন ও কুয়েতে শিয়া বিভিন্ন গোষ্ঠীকে উসকে দিয়ে সুন্নি শাসকগোষ্ঠীকে তটস্থ রাখতেও ভূমিকা রাখে বলে আইআইএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

তেহরানের মদদে সৃষ্ট এসব রাজনৈতিক অস্থিরতাকে রিয়াদ দমন করতে পারলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা তাদের তেল শিল্পক্ষেত্রের দিকে ধেয়ে আসা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোটি কোটি ডলার খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা কেনা হয়েছিল, সাম্প্রতিক হামলা ঠেকাতে সেগুলোও ছিল অকার্যকর।

সৌদি আরবের অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষাকে একই সঙ্গে ঝাঁকুনি দেওয়া সেপ্টেম্বরের ওই হামলা সৌদি আরবের তেলের উৎপাদন অনেকখানিই কমিয়ে দিয়েছিল।

আইআইএসএস বলছে, গত ৪০ বছর ধরে ইরান খুব সতর্কতার সঙ্গে তার মিত্রদের বেছে নিয়েছে, তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়েছে, দিয়েছে কৌশলগত নানান সুবিধাদি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এই মেয়াদেও তারা ধারাবাহিকভাবেই এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে তৎপর।

আইআইএসএসের এ প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় লন্ডনের ইরান দূতাবাসের এক মুখপাত্র বলেছেন, এই প্রতিবেদনের অর্থ যদি হয় মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূমিকাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া উচিত, তাহলে একে স্বাগত জানাচ্ছি।

“ইরানকে অবজ্ঞা করার নীতি কাজ করেনি। ইরান তা প্রতিহত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিও সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে ইরান। হ্যাঁ, এটি একটি শক্তিধর দেশ, আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যার নানান ধরনের উদ্যোগ ও সম্পর্কে বিরাজমান,” বলেছেন তিনি।