আর্কটিকে নেটো-রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধিতে অস্বস্তি নরওয়েজুড়ে

সীমান্তের এপারে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটোর যৌথ মহড়া আর অপরপাশে রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধিতে নরওয়ের উত্তরাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে চাপা অস্বস্তি বিরাজ করছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2019, 09:35 AM
Updated : 6 Nov 2019, 09:51 AM

সাম্প্রতিক সময়ে আর্কটিক অঞ্চলে নেটো ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় নরওয়েতে এখন নেটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর তিন হাজার সেনাসদস্যের যৌথ মহড়া চলছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

হিমশীতল পরিবেশে কী করে যুদ্ধ করতে হবে চলছে তারই প্রশিক্ষণ।

“উত্তরপশ্চিমে কোন দেশ?,” নরওয়ের সেতেরমোয়েন শহরের কাছের পাইন বনে চলা এক প্রশিক্ষণে ক্যামোফ্লেজড কমব্যাট জ্যাকেট ও সাদা ট্রাউজার পরিহিত ২০ সৈন্যের দিকে চিৎকার করে এই প্রশ্নই ছুড়ে দিতে দেখা গেছে স্টাফ সার্জেন্ট ডেনিয়েল ক্রোককে।

বনের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ৬৫০ মেরিন কন্টিনজেন্টের সদস্যদের কাছ থেকে উত্তর এলো, “রাশিয়া”।

সেতেরমোয়েনের কয়েকশ কিলোমিটার দূরে কোলা পেনিনসুলায় রাশিয়ায় নর্দান ফ্লিটের ঘাঁটি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মস্কো উত্তর আটলান্টিকে একটি বড় ধরনের ডুবোজাহাজ মহড়া চালিয়েছে বলেও গোয়েন্দা সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে জানিয়েছে নরওয়ের গণমাধ্যম।

“তোমাদের জিপিএসগুলো ব্যবহার করো না; সেগুলো জ্যাম হয়ে থাকতে পারে,” মেরিন সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলা এ কথাতেও ক্রোক ইঙ্গিত করলেন রাশিয়ার দিকে।

রাশিয়া অতীতেও নরওয়ের জিপিএস ব্যবস্থাপনা জ্যাম করে দিয়েছিল বলে নেটো অভিযোগ করছে, মস্কো সেসব উড়িয়ে দিয়েছে।

দুই পক্ষের মধ্যে এই অব্যাহত উত্তেজনাবৃদ্ধি কেবল কিরকেনেসের মতো সীমান্ত শহরগুলোতেই নয়, নরওয়ের বেশিরভাগ বাসিন্দাদের মধ্যেই সৃষ্টি করছে তুমুল অস্বস্তি। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার এ দেশটি গত তিন দশক ধরেই প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিরকেনেসের বাসিন্দারা সহজেই ভিসাছাড়াই সীমান্ত পার হতে পারেন; তুলনামূলক সস্তায় পেট্রল কেনার সুযোগ থাকায় অনেকেই চলে যান কাছাকাছি রুশ শহর নিকেলে। কিরকেনেসের সড়কে থাকা সাইনগুলোও লেখা রয়েছে সিরিলিক ও লাতিন উভয় অক্ষরে।

“সীমান্তের দুই পাশে তাদের সামরিক শক্তিবৃদ্ধি পছন্দ হচ্ছে না আমার। উত্তেজনা বাড়ুক চাই না আমরা,” বলেছের শহরটির কিমেক শিপইয়ার্ডের অন্যতম স্বত্বাধিকারী এইরিক উইকান।

তার শিপইয়ার্ডের আয়ের দুই তৃতীয়াংশই আসে রুশ নৌযান সারাইয়ের মাধ্যমে।

“এখানে উত্তরে আমরা উত্তেজনা প্রশমেনে একসঙ্গে কাজ করছি। আমরা উত্তেজনার অংশ না হওয়ার চেষ্টা করছি,” বলেছেন উইকান।

কিমেকের কর্মচারীদের এক তৃতীয়াংশই রাশিয়ান। এদেরই একজন নিকোলাই চাগিন। রাশিয়ার সেভেরোদভিনস্ক শহর থেকে আসা এ মিস্ত্রি ২০০৬ সাল থেকেই নরওয়ের এ শিপইয়ার্ডে কাজ করছেন।

“রাশিয়ায় যে ধরনের সমস্যার মুখে ছিলাম, এখানে সেগুলো নেই। আমার এখন ভালো চাকরি আছে, বেতন স্বাভাবিক,” বলেছেন এ রুশ।

কেবল কিমেক শিপইয়ার্ডই নয়, কিরকেনেসের সামোভার থিয়েটার কোম্পানিতেও প্রচুর রুশ কর্মচারী আছে। কোম্পানিটি নরওয়ে, রাশিয়া দুই দেশেই নাট্য প্রদর্শনী করে। সামোভারের কোরিওগ্রাফার নিকোলাই স্চেতেনেভের কাছে এখন কিরকেনেসকেই দ্বিতীয় বাড়ি মনে হয়; দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথাও ভাবছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। 

নরওয়ের এ সীমান্তবর্তী শহরটির প্রায় ১০ শতাংশ বাসিন্দারই আদি বাড়ি কোলা পেনিনসুলাতে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

“কিরকেনেস নরওয়ের ভেতরে রাশিয়ার একটি শহর,” বলেছেন সোয়ের ভারাঙ্গের মিউনিসিপালিটির মেয়র রুনে রাফায়েলসেন। কিরকেনেস শহর এই মিউনিসিপালিটিরই অংশ।

নরওয়ের নেটো সদস্যভুক্তিকে ‘আমি আমার চাকরি করতে পারবো এমন নিশ্চয়তা’ হিসেবে দেখলেও রুনে বলছেন তিনি সীমান্তে অত্যধিক ট্যাঙ্ক মোতায়েনকে স্বাগত জানাতে রাজি নন।

সীমান্তে এই উত্তেজনাবৃদ্ধির পেছনে দায় নিতে রাজি নয় মস্কো। তাদের অভিযোগের তীর সাম্প্রতিক সময়ে নরওয়েতে ঘাঁটি গড়া মার্কিন মেরিন সদস্যদের দিকে। নেটোর এই পদক্ষেপকে রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবেও দেখছে।

অন্যদিকে নরওয়ে ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ এবং আর্কটিকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরিবহন করা রুশ নৌযানের মহড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন।

“এগুলো মস্কোর দিক থেকে নেটোর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনার অংশীদার না হতে স্পষ্ট বার্তা,” বলেছেন নরওয়ের জয়েন্ট হেডকোয়ার্টার্সের কমান্ডার লেফটেনেন্ট জেনারেল রুনে জেকবসন।

দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাবৃদ্ধিতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে জেকবসন কোলা পেনিনসুলার এফএসবি সিকিউরিটি সার্ভিসের (রুশ গোয়েন্দা সংস্থা)  আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিরকেনেসে রুশ নর্দার্ন ফ্লিটের প্রধান আলেক্সান্ডার মইসেয়েভের সঙ্গেও তার বৈঠক হয়েছে।

“পরাশক্তির প্রতিবেশী একটি ছোট দেশ হিসেবে আপনাকে প্রতিরোধ ও প্রতিশ্রুতির সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে,” বলেছেন এ কমান্ডার।

নরওয়ের সামরিক বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা নেটোর মহড়াগুলোকেও নরওয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।

“একসঙ্গে কাজের (মহড়া) মানে হচ্ছে, দরকার পড়লে একসঙ্গে যুদ্ধ করাও সম্ভব,” বলেছেন সেতেরমোয়েনে মোতায়েন করা নর্দার্ন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার লারস লেরভিক।