তার পরিবারের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, ৯৫ বছর মুগাবের স্বাস্থ্যের অবস্থা বেশ কিছুদিন ধরেই ভালো যাচ্ছিল না। গত এপ্রিল থেকে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিনি ভর্তি ছিলেন। শুক্রবার সকালে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
জিম্বাবুয়ে ১৯৮০ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর টানা ৩৭ বছর দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন মুগাবে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে এক সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে তাকে উৎখাত করা হয়।
মুগাবের মৃত্যুর খবর জানিয়ে তার উত্তরসূরি এমারসন এমনানগাগোয়া এক টুইটে লিখেছেন, “গভীর শোকের সঙ্গে জিম্বাবুয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের মৃত্যুসংবাদ আমাকে জানাতে হচ্ছে।”
জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমনানগাগোয়ার ভাষায়, “মুগাবে ছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক, প্যান-আফ্রিকা মতবাদের একজন সমর্থক, যিনি তার জীবন উৎসের্গ করেছিলেন জনগণের মুক্তি আর ক্ষমতায়নের জন্য।”
জিম্বাবুয়ের শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসনের অবসান ঘটানো মুগাবে তার দেশে অনেকের কাছেই একজন মহানায়ক। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার সুযোগ বাড়িয়ে শুরুর দিকে তিনি পুরো বিশ্বেই প্রশংসা পেয়েছিলেন।
কিন্তু পরে তার ভূমি সংস্কার কার্যক্রম ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়, অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ধীরে ধীরে তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ।
পশ্চিমা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মুগাবেকে চিত্রিত করা হয় আফ্রিকার একজন স্বৈরশাসক হিসেবে, যিনি নিজের ক্ষমতা টেকাতে দেশকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গিয়েছেন।
১৯২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রবার্ট মুগাবের যখন জন্ম হয়, জিম্বাবুয়ের নাম তখন রোডেশিয়া। এক সময়ের এই ব্রিটিশ কলোনিতে তখনও সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের শাসন চলছে।
রোডেশিয়া সরকারের সমালোচনা করায় এক দশকের বেশি সময় বিনা বিচারে বন্দি থাকতে হয় মুগাবেকে। ১৯৭৩ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হন মুগাবে।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মুগাবে চলে যান মোজাম্বিকে। সেখান থেকে রোডেশিয়া সরকারের বিরুদ্ধে শুরু করেন গেরিলা যুদ্ধ। সেই সঙ্গে চলে আলোচনা।
আর সেই আলোচনার পথ ধরেই জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র রিপাবলিক অব জিম্বাবুয়ে। স্বাধীনতার একজন যোদ্ধা হিসাবে বীরোচিত সম্মান পান মুগাবে। জিম্বাবুয়ের ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’ আখ্যা পান তিনি।
স্বাধীন জিম্বাবুয়ের প্রথম নির্বাচনে মুগাবের বিপুল বিজয় হয়। ১৯৮০ সালে তিনি জন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী। পরে ১৯৮৭ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করে নিজে সেই পদে বসেন।
১৯৮১ সালে মুগাবে নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন। প্রতিবেশী দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৪ সালে তিনি জাতিগত বিদ্বেষ অবসানের অন্যতম দৃঢ় সমর্থক ছিলেন।
জিম্বাবুয়ে ও ব্রিটেনের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে অবদানের জন্য নাইট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছিলেন মুগাবে। ১৯৯৪ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে নাইটহুড দেন।
কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মুগাবের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। তার বিভিন্ন পদক্ষেপ তৈরি করে তিক্ততা।
এদিকে অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা, বিচার ও গণতন্ত্রহীনতায় নিজের দেশেও মুগাবের ভাবমূর্তি বদলাতে শুরু করে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে দমন করায় মহায়নায়ক মুগাবে মানুষের চোখে ‘স্বৈরশাসক’ হয়ে উঠতে থাকেন।
কিন্তু সেই মুগাবেই নির্বাচনে মর্গান সাভাঙ্গিরাইয়ের কাছে হারের পর ক্ষমতায় অটল থেকে বলেছিলেন, “কেবল ঈশ্বরই তাকে সরাতে পারেন।”
এরপর তিনি ক্ষমতা আকড়ে থাকার জন্য মরিয়া চেষ্টা শুরু করলে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। সাভাঙ্গিরাই তার অনুসারীদের জীবন বাঁচাতে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। মুগাবে পরে চার বছরের জন্য দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বাধ্য হলেও প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যান।
২০১৩ সালের নির্বাচনে আরেকবার জয় পান মুগাবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘণীভূত হওয়ায় তার জনপ্রিয়তায় ফের ধস নামে।
মুগাবে বরাবরই বলে এসেছেন, জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কারণ পশ্চিমা দেশগুলোর চক্রান্ত, তারা আসলে তাকে উৎখাত করতে চায়। আর শ্বেতাঙ্গদের জমি কেড়ে নেওয়ায়ই পশ্চিমাদের এই রোষের কারণ।
২০০০ সালে জিম্বাবুয়ের শ্বেতাঙ্গ-মালিকানাধীন ফার্মগুলো জব্দ করে সেখনে কৃষ্ণাঙ্গদের বসানো শুরু করেন মুগাবে। আর তখনই তিনি প্রথমবারের সত জোরাল বিরোধিতার মুখে পড়েন।
তার সমালোচকরা বলেন, আধুনিক অর্থনীতি কীভাবে পরিচালিত হয় সে বিষয়টিই মুগাবে বুঝতেন না। অর্থনীতির বিকাশ কীভাবে ঘটানো যায়, তা তিনি কখনও গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি।
দেশের অর্থনীতির করুণ দশার মধ্যেও মুগাবে ও তার স্ত্রীর বিলাসবহুল জীবনযাপন দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম হয়েছে।
তবে দীর্ঘ জীবনের শেষভাগে এসে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই মুগাবের মসনদের পতন ডেকে আনে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাওয়া তখন জিম্বাবুয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাকেই দলীয়ভাবে মুগাবের উত্তরসূরি বিবেচনা করা হত।কিন্তু নিজের স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য মুগাবে ২০১৭ সালের অক্টোবরে নানগাওয়াকে বরখাস্ত করেন।
দলের উত্তসূরি নিয়ে এই দ্বন্দ্বের মধ্যে জিম্বাবুয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী, মুগাবেকে করা হয় গৃহবন্দি। শেষপর্যন্ত তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন।