শরণার্থী থেকে প্রেসিডেন্ট: লাটভিয়ার ভায়রা ভাইকা-ফ্রাইবার্গা

যুদ্ধবিধ্বস্ত লাটভিয়া থেকে পরিবারের সঙ্গে পালানো ছোট্ট মেয়েটি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর দেশে ফিরেই হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2019, 03:27 PM
Updated : 4 August 2019, 04:00 PM

শুধু তাই নয়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত লাটভিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তিনি। শরণার্থী থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া এই নারীর নাম ভায়রা ভাইকা-ফ্রাইবার্গা।

বিবিসি’কে তিনি বলেন, “আমি যে লাটভিয়ান সেকথা আমার বাবা-মা কখনো আমাকে ভুলতে দেয়নি।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের মুখে পড়েছিল লাটভিয়া।

১৯৪১ সালে জার্মানরা লাটভিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং অনেক সোভিয়েতকে বন্দী করে। এরপর ১৯৪৪ সালে রাশিয়ার কমিউনিস্ট রেড আর্মির সেনারা ফের লাটভিয়া দখল করে।

 ওই সময় দেশের উত্তাল পরিস্থিতির বেশ কিছু কথা মনে আছে ভায়রার। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “লাল পতাকা আর সেনাদের মুঠিবদ্ধ হাত দেখে অভিভূত হতাম। তাদের কেউ কুচকাওয়াজ করার সময় আমিও আমার হাত উঁচিয়ে মুঠিবদ্ধ করে চিৎকার করে বলতাম “হুররে!”

“ওই সময় মাকে দেখতাম ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে মনমরা হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। তার গাল বেয়ে অশ্রু নামত। বলতেন, না বাছা, এটি কোরো না। লাটভিয়ার জন্য আজ খুব দুঃখের দিন।”

ভায়রার এও মনে আছে যে, তার বাবা রেডিওতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস শুনে যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করতেন। একপর্যায়ে তিনি লাটভিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে লাটভিয়া ছাড়েন ভায়রা।

প্রথমে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানিতে, পরে ফ্রান্স শাসিত মরক্কোয় এবং তারও পরে কানাডায় যান। ১৯৯৮ সালে ৬০ বছর বয়সে ভায়রা দেশে ফিরে আসেন। এর আট মাসের মধ্যে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা নির্বাচনী প্রচার ছাড়াই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ভায়রা।

বিবিসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শরণার্থী জীবনের বর্ণনায় ভায়রা বলেছেন, “আমরা ১৯৪৫ সালে নববর্ষের রাতে জাহাজে উঠি। জাহাজটি ছিল রণসজ্জায় সজ্জিত এবং সেনা বোঝাই। তবে জাহাজটিতে সমাজতান্ত্রিক শাসন থেকে পালাতে মরিয়া কিছু বেসামরিক লোকজনকেও নেওয়া হয়েছিল। লাটভিয়ানরা জাহাজের ডেকে জড়ো হয়ে লাটভিয়ার জাতীয় সংগীত গাইতেন।”

জীবনের নির্মম শিক্ষা:

পরিবারের সঙ্গে ভায়রা প্রথমে জার্মানির শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেন। তখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। তার ১০ মাস বয়সী ছোট বোন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর এক বছরের মধ্যে ভায়রার মা একটি ছেলের জন্ম দেন। ওই সময়ই জীবনের কঠিন দিকটি দেখেন ভায়রা। তার মায়ের সঙ্গে একই কক্ষে ১৮ বছর বয়সী একটি মেয়ে থাকতেন। তিনি একটি শিশুকন্যার জন্ম দেন। রুশ সেনাদের গণধর্ষণের শিকার হয়ে এ সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে তিনি শিশুটিকে সহ্য করতে পারতেন না। নার্সরা পরে ভায়রার মৃত বোন মারার নামে শিশুটির নাম রাখেন।

তখনই ভায়রা উপলব্ধি করেন জীবন খুবই অদ্ভুত আর অন্যায্য। সে অনুভূতির বর্ণনায় ভায়রা বলেন, “এক মারা জন্ম নিয়েছে, বাঁচার লড়াই করছে। অথচ সে এই পৃথিবীতে অনাকাঙ্ক্ষিত। আর আমাদের মারা, যে ছিল আমাদের খুবই কাঙ্খিত, তাকেই আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হল।”

শিশুবয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার ভয়:

 

১১ বছর বয়সে ভায়রা পরিবারের সঙ্গে জার্মানি থেকে ফ্রান্স শাসিত মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় চলে যান। মধ্যরাতে একটি ট্রাক থেকে ছোট একটি গ্রামে নামিয়ে দেওয়া হয় তাদের। ওই গ্রাম যেন ছিল এক ক্ষুদে বিশ্ব। নানা বিদেশির আবাস ছিল সেখানে। ছিল ফরাসি, ইতালীয়, রাশিয়ার পুরোনো অভিবাসীরা।

একদিন ভায়রার বাবার এক আরব সহকর্মী শিশু ভায়রাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। বাবা বাড়িতে ফিরে ভায়রার মাকে সেই প্রস্তাব সম্পর্কে বলছিলেন, “তিনি (আরব সহকর্মী) বিয়ের যৌতুক হিসেবে ১৫ হাজার ফ্রাঁ দিতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে দুটো গাধা ও বাছুর। পরে তিনি যৌতুকের অর্থ আরও বাড়িয়ে বলেন। কিন্তু আমি তাকে বললাম, মেয়ে তো এখনো ছোট, ওকে স্কুলে যেতে হবে। সেটা শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমরা ভায়রাকে স্কুল শেষ করতে দেব।”

এই আলোচনা করে বাবা-মা হাসছিলেন। কিন্তু ভায়রা সতর্ক হয়ে যান। শিশুবয়সেই বিয়ের ভয় ঢুকে যায় তার মনে।

নারীবিদ্বেষী অধ্যাপক:

 

যা হোক, এরপর ভায়রার পরিবার কানাডায় পাড়ি দেয়। ওই সময় ভায়রার বয়স ছিল ১৬ বছর। সেখানেই পরে  ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে পড়েছিলেন ভায়রা। এরপর   লাটভিয়া থেকে আরেক নির্বাসিত ইমান্টস ফ্রাইগবার্গার সঙ্গে ভায়রার পরিচয় হওয়ার পর তারা বিয়ে করেন।

ভায়রা মনোবিজ্ঞানে পড়তেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পিএইচডি করেন। ওই সময়ই ভায়রার আরেক অভিজ্ঞতা হয় নারীদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে। তিনি দ্রুতই বুঝতে পারেন মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় অভ্যর্থনা জানানোর বদলে বরং সহ্য করা হয়। একদিন এক অধ্যাপক একটি সেমিনারে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বক্তব্য রাখেন।

ভায়রা বলেন, “আমাদের প্রিয় অধ্যাপক বলছিলেন, পিএইচডি প্রোগ্রামে আমাদের তিনজন বিবাহিত নারী আছেন। এটি অপচয় ছাড়া কিছু না। কারণ, তারা বিয়ে করে সন্তান নেবেন। সত্যিকারের বিজ্ঞানী হতে পারত—এমন একটি ছেলের জায়গা তারা নিয়ে নিয়েছেন।”

 

ভায়রা জানান, সেমিনারে উপস্থিত মেয়েরা সারাজীবন অধ্যাপকের ওই কথাগুলো মনে রেখে সংকল্প করেছিলেন, অধ্যাপককে দেখিয়ে দেবেন,ছেলেদের চেয়েও নারীরা সফল হতে পারেন।

ভায়রা ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিয়েলে ৩৩ বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে পারেন এবং বইও লিখেছেন ১০টি।

শেষ পর্যন্ত আবার দেশে ফেরা:

 

১৯৯৮ সালে ৬০ বছর বয়সে তিনি প্রফেসর ইমেরিটাস হন এবং অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এক সন্ধ্যায় তার ফোন বেজে ওঠে। ফোন করেছিলেন লাটভিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তিনি ভায়রাকে লাটভিয়ার একটি নতুন ইনস্টিটিউটের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন।

ভায়রাকে বলা হয়, বহু ভাষায় পারদর্শী, পশ্চিমাদের মনোভাব বোঝে আবার লাটভিয়ার সংস্কৃতিও ভালভাবে বোঝে এমন একজনকেই এ পদের জন্য খোঁজা হচ্ছে।

ব্যাস, এর প্রায় পরপরই লাটভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী দৌড়ে চলে আসেন ভায়রা। নির্বাচনে লড়তে ভায়রা নিজের কানাডীয় পাসপোর্ট হস্তান্তর করেন এবং দেশে ফেরার মাত্র আট মাসের মধ্যে তিনি লাটভিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

একপর্যায়ে দেশে ভায়রার জনপ্রিয়তা ৮৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। এ ব্যাপারে ভায়রা বলেছেন, “আমি পয়সাকড়ি বানানোয় আগ্রহী ছিলাম না, কেবলমাত্র কাজ করে গেছি।”

তবে এত জনপিওয়তার পরও কিছু সংবাদমাধ্যমে ভায়রার সমালোচনাও হয়েছে। তিনি অপব্যয়ী এবং সারা জীবন পশ্চিমে বিলাসি জীবন কাটিয়েছেন বলে সমালোচনা করেছে পত্রিকাগুলো। তবে এসব অভিযোগ অতিরঞ্জিত বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ভায়রা। বলেছেন, “আমি উপলব্ধি করলাম, কেউ গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করতে না পারলে তাকে সরাসরি জনগণের সামনে গিয়েই কথা বলতে হবে।”

ভায়রা দ্বিতীয় মেয়াদেও লাটভিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তার এ মেয়াদ শেষ হয় ২০০৭ সালে। সদ্য ৭০ বছরে পা রেখেছেন তিনি। সাবেক নেতাদের নিয়ে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তিনি ‘ক্লাব দে মাদ্রিদ’ও গড়ে তুলেছেন। গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও সুশাসনের লক্ষ্যে এ সংগঠন কাজ করে। নারীর ক্ষমতায়নের ওপরই বেশি জোর দেন ভায়রা।