ভারতে তাৎক্ষণিক তিন তালাক এখন ফৌজদারি অপরাধ

ভারতে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় আগেই পাশ হয়েছিল তিন তালাক বিল। এবার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাতেও পাশ হল বিলটি। এখন কেউ তিন তালাক দিলে কারাদণ্ড হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2019, 03:45 PM
Updated : 30 July 2019, 05:05 PM

মঙ্গলবার রাজ্যসভায় ৯৯-৮৪ ভোটের ব্যবধানে বিলটি পাশ হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এতে সই করলেই বিলটি আইনে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে তিনবার ‘তালাক’ উচ্চারণ করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে।

‘মুসলিম নারী (বিবাহের নিরাপত্তা অধিকার) বিল’ নামের বিলটিই ‘তিন তালাক বিল’ হিসাবে পরিচিত। বিলটি আইনে পরিণত হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে তিন তালাক দিলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে মুসলিম পুরুষদের।

লোকসভায় তিন তালাক বিল নিয়ে আলোচনার সময় যেমন এটি বিরোধিতার মুখে পড়েছিল রাজ্যসভার ক্ষেত্রেও একই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে বিলটি। এদিনও উচ্চকক্ষে তিন তালাক বিলে তীব্র আপত্তি জানায় এআইএডিএমকে এবং জেডি(ইউ)-র মতো এনডিএ-র শরিক দলগুলোও। বিলের প্রতিবাদে সভাকক্ষ থেকে ওয়াকআউট করে তারা।

এছাড়া, বিল নিয়ে ভোটাভুটির সময় সভায় অনুপস্থিত ছিলেন বিএসপি, টিআরএস এবং টিডিপি-র সাংসদরা। ফলে রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল পাশ করাতে সফল হয় মোদী সরকার।

ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, বিলটি পাশের পর টুইটারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি লিখেছেন, “এত দিনে তিন  তালাকের মতো একটি প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় প্রথাকে আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে ফেলা গেল। মুসলিম নারীদের প্রতি এতদিন ধরে চলে আসা একটি ঐতিহাসিক ভুল শুধরানো সম্ভব হল সংসদে। এটি লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে জয়। এর ফলে সমাজে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ আরও প্রশস্ত হল। আজ ভারতের খুশির দিন।”

আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদও বলেছেন, ‘‘আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। মুসলিম নারীদের ন্যায় বিচার দিয়েছে সংসদের দু’কক্ষই।”

বিলের সমর্থকরা নতুন এ আইনকে মুসলিম নারীদের রক্ষাকবচ বলে উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে, বিরোধীরা তিন তালাকের জন্য আইনি দণ্ডকে কঠোর বলে বর্ণনা করেছে এবং এর অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ আছে বলে অভিযোগ করেছে।

২০১ ৪ সালে  ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিন তালাক প্রথার অবসান চেয়ে সরব হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। ২০১৭ সালে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টও। তারপরই তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করা এবং তিন বছরের জেলের বিধান দিয়ে বিল আনে মোদী সরকার। কিন্তু প্রথম দফায় সেই বিল পাশ করাতে ব্যর্থ হয়ে পরে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে উদ্যোগী হন মোদী।

গত সপ্তাহে ৩০৩ ভোটে লোকসভায় বিলটি পাশ হয়েছিল। সংখ্যার ফেরে এত দিন আটকে থাকলেও এবার শেষ পর্যন্ত রাজ্যসভাতেও সফলতা এল।

তিন তালাকে তাৎক্ষণিক বিবাহবিচ্ছেদ প্রথা:

তাৎক্ষণিকভাবে তিনবার ‘তালাক’ উচ্চারণ করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো কিংবা চিঠিতে তিনবার তালাক লেখা, হোয়াটসঅ্যাপ এবং স্কাইপে তালাক বার্তা পাঠানো বা ফোনে তালাক বলে বিবাহবিচ্ছেদ করা।

এভাবে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটানোর উল্লেখ ইসলামিক শরিয়া আইন বা কুরআনে না থাকলেও দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে এ প্রথা। নারীরা এ প্রথার বিরোধিতা করায় তাৎক্ষণিক তিন তালাকের এমন অসংখ্য ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

ইসলামের পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতে, কুরআনে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর প্রক্রিয়া স্পষ্ট করেই বলে দেওয়া আছে। আর তা হচ্ছে, তিনমাস সময় নিয়ে সেটি করা।যাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবার বোঝাপড়া করে বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকে।

মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মতো অনেক মুসলিম দেশেই তিন তালাক নিষিদ্ধ হলেও ভারতে এ প্রথা চলে এসেছে। সেখানে প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিয়ে এবং বিবাহবিচ্ছেদের আইন এক নয়।

বিলটি কেন বিতর্কিত?

তিন তালাকের বিরুদ্ধে প্রচারকর্মীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র মতবিরোধ বিলটিকে বিতর্কিত করে তুলেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বিলটি সমর্থন করলেও প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস পার্টি এর বিরোধিতা করেছে।

বিরোধীদের মূল আপত্তি ছিল তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করার বিষয়টি নিয়ে। ভারতীয় কংগ্রেস পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য ছিল, দেশে শীর্ষ আদালত এ প্রথাকে বেআইনি ঘোষণা করার পর এটিকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।

কিন্তু ভারতের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বিলের পক্ষ সমর্থনে বলেছেন, প্রথাটি নিষিদ্ধ হলেও বন্ধ হয়নি। রাজ্যসভাতে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও তিন তালাকের ৫৭৪ টি ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, “রায় এসেছে। কিন্তু তিন তালাকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সে কারণেই আমরা এ আইন এনেছি। এ প্রথাকে নিবৃত্ত করাই এর লক্ষ্য।”

প্রচারকর্মীরা বলছেন, ভারতজুড়ে তিন তালাকের কত ঘটনা ঘটছে তার হিসাব দেওয়া প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।