রোববার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে দুই দফায় এসব হামলার ঘটনায় আহত হয়েছেন সাড়ে চারশ মানুষ।
শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের পর গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই হামলার দায় স্বীকার করেনি কেউ।
এই হামলার শিকার হয়েছে দেশটিতে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের তিনটি বড় গির্জা সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চ, সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ আর জিয়ন চার্চে, যেখানে ইস্টার সানডের প্রার্থনায় সমবেত হয়েছিল হাজারো মানুষ।
হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল কলম্বোর পাঁচ তারকা হোটেল শাংরি লা, কিংসবুরি আর সিনামন গ্র্যান্ডের বিদেশি পর্যটকরা।
শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ২৭ জন বিদেশি নাগরিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন তুর্কি, একজন ডাচ ও একজন চীনা নাগরিক।
এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি জায়ান চৌধুরীও (৮) বিস্ফোরণে মারা গেছে বলে পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন জানিয়েছেন। জায়ানের বাবা মশিউল হক চৌধুরী প্রিন্সও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়ে একটি হোটেলে উঠেছিলেন তারা।
হামলার পর আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হওয়া কলম্বোতে সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে দেশটির সরকার। পাশাপাশি সোম ও মঙ্গলবার ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি ছুটি।
পাশাপাশি গুজব ঠেকাতে ফেইসবুক, হোয়াটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, কলম্বোর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরাই অধিকাংশ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে তদন্তকারীরা ধারণা।
দেশটির প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলছেন, হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে, একটি গোষ্ঠীই হামলাগুলো চালিয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
“কোনো উগ্রপন্থি দল এ দেশে থাকতে পারবে না। তাদের তৎপরতা বন্ধের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই আমরা নেব।”
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা এ হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে নাগরিকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
আর হামলার ঘটনার পর নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমসিংহে বলেছেন, “আমি এই কাপুরুষোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। দেশের মানুষকে আমি ঐক্যবদ্ধ ও শক্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।”
ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এ হামলাকে ‘অত্যন্ত নিষ্ঠুর সহিংসতা’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি ‘হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা’ প্রকাশ করেছেন তিনি।
যেভাবে হামলা
বিবিসি জানিয়েছে, তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে বিস্ফোরণের খবরটি আসে স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে। ‘যিশুর পুনরুত্থান’ দিবস উদযাপনে গির্জাগুলোতে তখন চলছিল বিশেষ প্রার্থনা।
এর মধ্যে ১৯ শতকের শুরুতে নির্মিত কোচিকাডের সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। খ্রিস্টানদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছেও এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা।
এছাড়া কাটুয়াপিতিয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ এবং বাত্তিকালোয়ার জিয়ন গির্জাও শ্রীলঙ্কায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাসনালয়।
বিস্ফোরণে প্রতিটি গির্জাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছাদ উড়ে যায়। বিধ্বস্ত গির্জাগুলোর বেঞ্চ আর যিশুর ভাস্কর্যে রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা ছবি ও ভিডিওতে।
এক প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর দৌঁড়ে সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চে গিয়ে মেঝেতে লাশ পড়ে থাকতে দেখার কথা বলেছেন বিবিসিকে।
কামাল নামের ওই ব্যক্তি বলেন, পৌনে ৯টার দিকে বিকট ওই বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি। এরপর লোকজন দৌঁড়ে বের হয়ে আসতে দেখেন। তারা চিৎকার করে অনেক লোকের মৃত্যুর কথা বলছিল।
“আমরা দৌড়ে গির্জার ভিতরে গিয়ে লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। আমরা প্লাস্টিক দিয়ে সেগুলো ঢেকে দিলাম। এরপর পুলিশ এসে সবাইকে সেখান থেকে বের করে দিল।”
ইস্টার সানডের প্রার্থনার জন্য ওই গির্জায় পাঁচ শতাধিক লোক জড়ো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রায় একই সময়ে বিস্ফোরণ হয় কলম্বোর শাংরি লা, সিনামন গ্র্যান্ড ও কিংসবুরি হোটেলে। প্রতিটি হোটেলের রেস্তোরাঁয় তখন সকালের নাস্তা সারতে আসা পর্যটকদের ভিড় ছিল। আর সেই পর্যটকরাই ছিল আত্মঘাতী হামলাকারীদের টার্গেট।
শ্রীলঙ্কায় বেড়ে ওঠা ৪৮ বছরের চিকিৎসক জুলিয়ান ইমানুয়েল পরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে কলম্বো এসে তারা উঠেছিলেন সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে।
বিবিসিকে ইমানুয়েল বলেন, “বিকট বিস্ফোরণের সময় আমরা হোটেলের ঘরেই ছিলাম। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমাদের ঘর কেঁপে উঠল।… পরে আমাদের হোটেলের লাউঞ্জে নিয়ে আসা হল, পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে বলা হল। সেখানে আমরা কয়েকজন হতাহতকে দেখতে পেলাম, তাদের তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।”
সকালের নাস্তা খেতে যেতে তার সামান্য দেরি হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক কিরণ আরাসারত্নম।
তিনি বলেন,“এত জোরে শব্দ হয়েছিল যে আমি বজ্রপাত ভেবেছিলাম। সবাই আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করে। … বেশিভাগ মানুষ বুঝতে পারেনি আসলে কী হয়েছে। লোকজনের শার্টে রক্ত লেগে ছিল, ছোট একটা মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছিল… দেয়াল, মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।”
একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে করে হতাহতদের নেওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। স্বেচ্ছাসেবীদের আহ্বানে বহুন মানুষ ততক্ষণে রক্ত দিতে ভিড় করেছেন ব্লাড ব্যাংকে।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর দেহিওয়ালায় চিড়িয়াখানার কাছে ট্রপিকাল ইন হোটেলে সপ্তম এবং দেমাটাগোদা এলাকায় একটি বাড়িতে পুলিশি অভিযানের সময় অষ্টম বিস্ফোরণের খবর আসে। দেমাটাগোদা এলাকায় বিস্ফোরণে তিন পুলিশ সদস্য নিহত হন।
দুই দফা হালার কারণে ইস্টার সানডের সন্ধ্যার সব জমায়েত বাতিল করা হয়। শ্রীলংকার সব সরকারি স্কুলে আগামী দুই দিনের জন্য ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। জোরদার করা হয় কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারফিউয়ের মধ্যে রাতের ফ্লাইটের যাত্রীদের টিকেট ও পাসপোর্ট দেখিয়ে বিমানবন্দরে যেতে হবে। যাত্রীদের নির্ধারিত সময়ের অন্তত চার ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে উপস্থিত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কেন ইস্টার সানডে
শ্রীলংকায় সিংহলি ও তামিলদের মধ্যে মধ্যে সিকি শতাব্দি ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। এরপর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপ দেশ হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় গন্তব্য।
শ্রীলংকার দুই কোটি বিশ লাখ জনসংখ্যার মোটামুটি ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাকিদের মধ্যে ১৩ শতাংশ হিন্দু, ১০ শতাংশ মুসলমান, আর ৭ শতাংশ খ্রিস্টান ।
ইস্টার সানডেতে খ্রিস্টানদের গির্জাগুলো থাকে জমজমাট। এই সময়টায় পর্যটকরাও ছুটি কাটাতে আসেন।
হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি নিশ্চিত করার জন্যই ইস্টার সানডে এবং গির্জা ও হোটেলগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এথিরাজন আনবারাসন।
এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান পুজুথ জয়সুন্দর গত ১১ এপ্রিল দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন। বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে বরাতে তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি দল ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত (এনটিজে) কলম্বোয় ভারতীয় হাইকমিশন ও শ্রীলঙ্কার প্রধান গির্জাগুলোতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করছে।
গত বছর একটি বৌদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শ্রীলঙ্কার উগ্রপন্থি মুসলিমদের সংগঠন ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতের নাম খবরে এসেছিল।
কিন্তু পুলিশ প্রধানের ওই সতর্কবার্তা পুরোপুরি আমলে না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, “আমাদের এ বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখতে হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার মত সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই উচিৎ হয়নি।”
বিবিসি সিনহলার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন এ ঘটনার পেছনে ছিল বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন।