হামলাকারী এ হত্যাযজ্ঞের পুরো ঘটনা ফেইসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেছেন, ইন্টারনেটে ছড়িয়েছেন বর্ণবাদী, অভিবাসী বিদ্বেষী, উগ্র ডানপন্থি বার্তা।
প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ’ডুর্ন এ ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন নিউ জিল্যান্ডের ইতিহাসের একটি কালো দিন হিসেবে।
বিবিসি জানিয়েছে, শুক্রবার দুপরে প্রথম হামলাটি হয় ক্রাইস্টচার্চের ডিনস এভিনিউয়ের আল নূর মসজিদে। সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হামলাকারী গাড়ি চালিয়ে মাইল তিনেক দূরের লিনউড মসজিদে যায় এবং একই কায়দায় গুলি শুরু করে।
নিহতদের মধ্যে অন্তত তিনজন বাংলাদেশি বলে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল শফিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
নিউ জিল্যান্ড সফররত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কয়েকজন খেলোয়াড় আল নূর মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। সফরের বাকি ম্যাচ বাতিল করে শনিবার ফিরে আসছে বাংলাদেশ দল।
প্রার্থনারত মানুষের ওপর এভাবে হামলার এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে চলছে নিন্দার ঝড়। হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন বিশ্বনেতারা। বিভিন্ন দেশে মসজিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিউ জি ল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ’ডুর্নকে বার্তা পাঠিয়ে শোক জানিয়েছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনেছে ক্রাইস্টচার্চের পুলিশ। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে আরও দুইজনকে।
পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের কথা জানালেও গ্রেপ্তার কারও নাম প্রকাশ করেননি।
আল নূর মসজিদে হামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ হেলমেটে লাগানো ক্যামারার মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা ওই হামলাকারীর ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারেন্ট, বয়স ২৮।
ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ওই হামলাকারীর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে তারা, ওই ভিডিওর যেসব কপি ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোও মুছে ফেলা হচ্ছে।
হামলা চালানোর আগে ট্যারেন্ট তার টুইটার অ্যাকাউন্টে ৭৩ পৃষ্ঠার একটি কথিত ‘ম্যানিফেস্টো’ প্রকাশ করেন। হামলার উদ্দেশ্য ও নিজের পরিকল্পনার বিষয়ে সেখানে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তিনি। শনিবার তাকে আদালতে হাজির করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ওই হামলাকারীকে বর্ণনা করেছেন ‘উগ্র ডানপন্থি একজন সন্ত্রাসী’ হিসেবে। তবে নিউ জিল্যান্ডের পুলিশের খাতায় তার নাম ছিল না বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশ কমিশনার বুশ।
ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে গড়ায়
আল নূর মসজিদ থেকে প্রথম হামলার খবরটি আসে শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে। অস্ত্রধারী ওই যুবক মসজিদের দরজার বাইরে থেকেই গুলি শুরু করে। গুলি চালাতে চালাতে সে ভেতরে যায় এবং টানা পাঁচ মিনিট সে গুলি চালিয়ে যায়।
হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন নিউ জিল্যান্ড টেলিভিশনকে বলেছেন, প্রথমে মসজিদের পুরুষদের নামাজের কক্ষে এবং পরে নারীদের কক্ষে নির্বিচারে গুলি চালায় ওই অস্ত্রধারী।
“আমি শুধু প্রার্থনা করছিলাম, আর অপেক্ষা করছিলাম কখন গুলি থামে। বলছিলাম, আল্লাহ, ওর বন্দুকের গুলি শেষ হয়ে যাক।”
লিনউড মসজিদের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, সেখানে এক সাহসী তরুণ ঝুঁকি নিয়ে হামলাকারীর অস্ত্রটি কেড়ে নেয়। এরপর ওই হামলাকারী দৌড়ে বেরিয়ে যায় এবং বাইরে অপেক্ষায় থাকা একটি গাড়িতে করে পালিয়ে যায়।
বিবিসি জানিয়েছে, হামলায় সন্দেহভাজনদের ঠিক কখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে পুলিশ কমিশনার বুশ একটি গাড়িতে পাওয়া বেশ কিছু আইইডি নিষ্ক্রিয় করার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, দুই মসজিদ থেকে যেসব আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে এবং ওই বিস্ফোরকের মালিক একই ব্যক্তি।
এই হামলার ঘটনার পর ক্রাইস্টচার্চের সব মসজিদ পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ আদম শুমারির তথ্য অনুযায়ী, নিউ জিল্যান্ডের ৪২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ১.১ শতাংশের মত।
নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ থেকে শরণার্থীরা আসতে শুরু করা পর নিউ জিল্যান্ডে মুসলমানের সংখ্যাও বেড়েছে।
শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত নিউ জিল্যান্ডে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এভাবে হামলার ঘটনা একেবারেই বিরল।
১৯৯০ সালে সাউথ আইল্যান্ডে মানসিকভাবে অসুস্থ এক ব্যক্তি গুলি করে ১৩ জনকে হত্যার পর সেখানে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তার দুই বছরের মাথায় সেমি অটোমেটিক রাইফেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটির সরকার।
কে এই হামলাকারী
হামলার আগে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ব্রেন্টন ট্যারেন্টের নামে থাকা অ্যাকাউন্ট থেকে দীর্ঘ একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ওই লেখাকে হামলাকারীর ম্যানিফেস্টো হিসেবে বর্ণনা করছে।
ট্যারেন্ট সেখানে লিখেছেন, ২০১৭ সালে ইউরোপ ঘুরে আসারার পর হামলার পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়া থেকে তিনি নিউজিল্যান্ডে যান নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য কিন্তু ক্রাইস্টচার্চকে উপযুক্ত জায়গা মনে হওয়ায় পরিকল্পনায় নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই তিনি হামলার সিদ্ধান্ত নেন।
গার্ডিয়ান লিখেছে, হামলার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে নিজের অভিবাসনবিরোধী ও মুসলিমবিরোধী অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন ট্যারেন্ট। এক জায়গায় নিজেকে বর্ণনা করেছেন ‘এথনোন্যাশনালিস্ট এবং ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে।
অল্পের জন্য রক্ষা
ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভালে শনিবার সকাল থেকে বাংলাদেশ-নিউ জিল্যান্ড সিরিজের তৃতীয় টেস্টটি শুরু হওয়ার কথা ছিল। তার আগে শুক্রবার সকালে ওই মাঠে অনুশীলন করেন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়রা।
সেখান থেকে কয়েকজন মিনিট খানেক দূরত্বে আল নূর মসজিদে যান জুমার নামাজ পড়তে। দলের ম্যানেজার খালেদ মাসুদ জানান, খেলোয়ার-স্টাফ মিলিয়ে মোট ১৭ জন একটি বাসে করে ওই মসজিদে গিয়েছিলেন।
মসজিদের ৫০ গজের মতো কাছে গিয়ে তারা গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত মানুষদের ছুটে বেরিয়ে আসতে দেখেন। আর ৩-৪ মিনিট আগে পৌঁছালে তারা হয়ত গোলাগুরির সময় মসজিদের ভেতরই থাকতেন।
“আমরা ভিডিওর মত দেখছিলাম, সিনেমার যেমন দেখা যায়, বাসের ভেতর থেকে দেখছিলাম বেশ কিছু মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসছে। প্রায় ৮-১০ মিনিট আমরা বাসের ভেতরই ছিলাম। মাথা নিচু করে ছিল সবাই, যাতে কোনো কারণে গুলি আসে।”
পরে পুলিশ এসে পাহারা দিয়ে বাংলাদেশ দলের সদস্যদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ক্রিকেটাররা। যেসব ছবি সংবাদমাধ্যমে আসে, তাতে তাদের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট।
এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড মিলে তৃতীয় টেস্ট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। খালেদ মাসুদ জানিয়েছেন, শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় রওনা দিয়ে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় পা রাখবে বাংলাদেশ দল।
প্রবাসীদের নিরাপত্তা চায় বাংলাদেশ
ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলায় তিন বাংলাদেশিসহ ৪৯ জনের হতাহতের ঘটনার পর নিউ জিল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে এ কে আবদুল মোমেন।
সেই সঙ্গে এক শোকবার্তায় তিনি এই দুঃসময়ে নিউ জিল্যান্ডের মানুষ এবং দেশটির সরকারের পাশে থাকার কথা বলেছেন।
শুক্রবার বিকেলে সিলেটে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, নিহত বাংলাদেশিদের পরিবার ও আহতদের খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি তাদের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অকল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল শফিকুর রহমান ভূঁইয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের দুজন কর্মকতা ক্রাইস্টচার্চে যাচ্ছেন।
প্রবাসীদের তথ্য অনুযায়ী, ক্রাইস্টচার্চে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা সব মিলয়ে পাঁচশর বেশি হবে না। যে কোনো তথ্য বা সাহায্যের জন্য ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে সবাইকে।
জরুরি যোগাযোগের জন্য +৬১ ৪২৪ ৪৭২৫৪৪ এবং +৬১ ৪৫০১ ৭৩০৩৫ নম্বরে ফোন করতে বলা হয়েছে হাই কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে।