২০১৮: কমেছে অস্থিরতা, তবুও সংঘাতের দামামা

২০১৮ সালে কোরিয়া উপদ্বীপজুড়ে কমেছে অস্থিরতা, সিরিয়ায় থিতিয়ে এসেছে গৃহযুদ্ধ; তবুও শান্ত হয়নি বিশ্ব। উল্টো আরও নানা দিক দিয়ে বেড়েছে পরাশক্তিদের মুখোমুখি অবস্থান।

মীর মোশাররফ হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2018, 04:29 AM
Updated : 27 Dec 2018, 07:29 AM

চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রাশিয়ার টানাপোড়েন, হরমুজ প্রণালীতে ইরান এবং কের্চ প্রণালীতে ইউক্রেইনকে ঘিরে উত্তেজনা, সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি করা নিয়ে একেক দেশের একেক অবস্থান, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যাকাণ্ড নিয়ে তুরস্ক-সৌদি আরবের সংঘাতসহ এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের এমন ঠোকাঠুকি চলেছে সারা বছরজুড়ে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংঘাতের দামামা আর নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে হাজির হচ্ছে আরো একটি বছর।

সোভিয়েত আমলে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার হুমকি ও পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার বাড়ানোর ঘোষণায় রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে ঝুঁকি বেড়েছে ইউরোপের। দক্ষিণ চীন সাগরে ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের রণসজ্জাও বাড়িয়েছে আতঙ্ক। ইরানের ওপর পুরনো নিষেধাজ্ঞা বহাল করে, তাদের তেল রপ্তানি বন্ধ করার হুমকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতকে নতুন মাত্রার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ওদিকে, ইয়েমেন সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা নয় বরং আরব অঞ্চলের দুই শক্তিধর দেশের মর্যাদার লড়াইয়ের মঞ্চে পরিণত হওয়ায় বেড়েছে অনিশ্চয়তা। বছরজুড়েই আর্তনাদ, আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়েছে ইয়েমেনে। প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে দেশটি পৌঁছে গেছে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। সেখানে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৮ ডিসেম্বর থেকে বহুপ্রতিক্ষীত যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও প্রায়ই তা লঙ্ঘনের খবর পাওয়া যাচ্ছে।  

২০১৮’র অন্যতম আলোচিত ঘটনা খাশুগজি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এবছর শুধু তুরস্কই নয়, পশ্চিমা আরো কিছু দেশ, সৌদি আরবের সঙ্গে যাদের বহুদিনের রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক সম্পর্ক, তারাও বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিই বদলে দেওয়ার পট প্রস্তুত করেছে এ হত্যাকাণ্ড।

অন্যদিকে, চলতি বছরে বিশ্বব্যাপী প্রভাব আরও সুসংহত করেছে রাশিয়া ও চীন। সিরিয়া এবং আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও তারা কয়েকবছর ধরে নিস্ক্রিয় দ্বিতীয় নৌবহর পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে নতুন কৌশলের ইঙ্গিত দিয়েছে।

কিউবায় ক্যাস্ত্রো যুগের অবসান তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন আর আশঙ্কার দোলাচলে ফেলেছে, জন্মের পর থেকেই যারা নিজেদের নেতা হিসেবে দেখে এসেছে ক্যাস্ত্রো ভাইদের। সেই যুগের অবসানে অনেকেই আসন্ন ভবিষ্যতের রূপরেখা কিভাবে আঁকবে তা নিয়ে হয়েছে দ্বিধাগ্রস্ত। প্রশ্ন জেগেছে, কোন পথে যাচ্ছে কিউবা?

হোয়াইট হাউজে প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছরে প্রতিকূলতা কাটিয়ে কিছুটা গুছিয়ে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, পেয়েছেন কিছু সফলতাও। তারপরও বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। বছরজুড়ে নানা বিতর্কে তিনি যেমন নাজেহাল হয়েছেন, তেমনি তার বিতর্কিত নানা পদক্ষেপও ঘরে-বাইরে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। আবার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের উত্থানও চাপে ফেলেছে তাকে।

গতবছরের মতো ব্রেক্সিট নিয়ে এ বছরও অনেক দৌড়ঝাঁপ করেও সফলতার শিখরে পৌঁছতে পারেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হওয়া এখনো বাকি।

ফেইসবুক থেকে তথ্য চুরি করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার বিষয়টিও ছিল এ বছরের আলোচিত ঘটনা। ওই কেলেঙ্কারির হাত ধরে একদিনে শেয়ার বাজার থেকে রেকর্ড ১০৯ বিলিয়ন ডলার হারায় ফেইসবুক।

ক্যান্সার চিকিৎসায় কীভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো যায় তার পদ্ধতি আবিষ্কার, লেজার গবেষণায় সাফল্য এবং বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যু ছিল এবছর বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অন্যতম আলোচিত বিষয়। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা সংকট সামাল দিতে ব্যর্থতায় নোবেল জয়ী অং সান সু চিকে নিয়ে তীব্র সমালোচনাও চলেছে সারা বছরজুড়ে।

প্রতিবছরের মত এবারও বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়েছে পৃথিবীর মানুষকে; ছিল ভূমিকম্প, বন্যা, সুনামি। সেইসঙ্গে ঘটেছে বেশ কয়েকটি বড় দুর্ঘটনা। যা বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আগের বছরের মত এবছরও ঘটেছে সন্ত্রাসী হামলা। এতেও প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু মানুষ।

তাছাড়া, ঘটনাবহুল এ বছরে রাজপরিবারের দুটো জমকালো বিয়ে ছাড়াও এমন আরো নানা চমকপ্রদ ও ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটেছে।

তবে বছরজুড়েই ট্রাম্পের নানা কর্মকান্ডে কখনো ইতিবাচক কখনোবা নেতিবাচক প্রভাব অনুভূত হয়েছে দেশে-বিদেশে সর্বত্র। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মৈত্রীর সুবাতাস দিয়ে শুভ সূচনা হয়ে বছরের শেষ দিকে মেক্সিকো প্রাচীরের অর্থ বরাদ্দ নিয়ে ট্রাম্পের একগুঁয়েমিতে খোদ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন আংশিক অচল হয়েছে।

কোরিয়া উপদ্বীপে সুবাতাস, হরমুজ-এ উত্তাপ

কয়েক বছর ধরে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার অস্থিরতায় কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার বৈরি সম্পর্ক সারাবিশ্বকে উদ্বেগে রাখলেও চলতি বছর এর অবসান হয়েছে।

কোরিয়া উপদ্বীপজুড়ে বয়ে গেছে মৈত্রীর সুবাতাস। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও উত্তর কোরিয়ার বৈরি সম্পর্ক এ বছর দূর হয়েছে ঐতিহাসিক সব বৈঠকের মধ্য দিয়ে।

দুই কোরিয়ার নেতার বৈঠকের পর ১২ জুনে সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের প্রথম বৈঠক ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচ্যাংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দু’ দেশের মধ্যকার দীর্ঘ উত্তেজনার বরফ গলা শুরু হয়েছিল। পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার বৈঠকটি হয় এরই ধারাবাহিকতায়।

উত্তরের শীর্ষ নেতার বৈঠকের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গোটা বিশ্বকে তাজ্জব বানিয়ে দেন ট্রাম্প। বৈঠকের পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, পিয়ংইয়ং তাদের প্রধান পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্রের টানেল ধ্বংস করাসহ একটি রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস ও মার্কিন সেনাদের দেহাবশেষও ফেরত দেয়।

কিন্তু উত্তরের অস্থিরতা কমলেও গনগনে উত্তাপ ছিল হরমুজ প্রণালীতে। বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে সংঘাতের দামামা বাজিয়েছেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা ঠকছে এ অজুহাতে মেতে  ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে ছয় বিশ্ব শক্তির সই করা পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।  তাতেই ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প। মিত্রদের অনুরোধ-আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি তেহরানের ওপর পুরনো সব নিষেধাজ্ঞা আবার বহাল করেন। ইরানের তেল কেনা কিংবা তাদের সঙ্গে বাণিজ্যে জড়ালে সব দেশের কোম্পানিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি।

ট্রাম্প প্রশাসনের এ অবস্থান ইরানের অর্থনীতিকে খানিকটা চাপে ফেললেও রাশিয়া, চীন, ভারতের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোও মার্কিন হুমকি-ধামকি উড়িয়ে তেহরানের কাছ থেকে তেল কেনা ও পরমাণু চুক্তি বহালে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইরানের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ডলারের বিকল্প অন্য মুদ্রা ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর চিন্তার কথাও জানায় ইইউ।

নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেলবাহী জাহাজের চলাচলে কড়াকড়ি আরোপের পরিকল্পনা জানালে পাল্টা হুঁশিয়ারি আসে ইরানের রেভ্যুলেশনারি গার্ডের কাছ থেকেও। ইরান তেল বেচতে না পারলে অন্য সব দেশের জন্যও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। বছরজুড়েই এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের বাদানুবাদের খবর গুরুত্ব পায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সঙ্গেও কথার লড়াই চলে তেহরানের। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব দিনদিন আরও শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি খবর মেলে তাদের অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বিস্তারেরও।

বাণিজ্যযুদ্ধে দুই শক্তিধর দেশ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই অর্থনীতির দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এ বছর শুল্ক নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শুরুতেই আমদানি করা সোলার প্যানেল ও ওয়াশিং মেশিনে শুল্ক বসিয়ে বেইজিংয়ের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেন ট্রাম্প। মেধাস্বত্ব আইনের লংঘনসহ চীনের বিরুদ্ধে অন্যায্য বাণিজ্য চর্চার অভিযোগ এনে পরের মাসেই আরও ১৩০০ চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপে তৎপর হন তিনি। 

ওয়াশিংটনের পদক্ষেপের পাল্টায় এপ্রিলেই আমদানি করা ১২৮ মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসায় বেইজিং। জুনের মাঝামাঝিতে হোয়াইট হাউজও ৫০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করে। এরপর অগাস্টে এবং সেপ্টেম্বরে ফের পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ করে দুই দেশ।

 এভাবে শুল্কযুদ্ধ চলার মাঝেই‌ চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অভিযোগ করার পাশাপাশি মার্কিন ‘দস্যু মানসিকতার’ বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর ঘোষণা দেয়।

পরে জি-২০ সম্মেলনের সময় দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে বাণিজ্য যুদ্ধে তিন মাসের বিরতি দিয়ে মধ্যস্থতা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়; কিন্তু কানাডায় চীনের টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা আটকের ঘটনা বাড়িয়ে দেয় অস্বস্তি । শুরু হয় নতুন সংঘাত।

আমদানি করা ইস্পাত-অ্যালুমিনিয়ামে শুল্ক বসিয়েও এবছর ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার মিত্রদেশগুলোর মধ্যে ট্রাম্প জন্ম দিয়েছেন তীব্র অসন্তোষের।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের উত্থান:

নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলে আবারও বিভক্ত কংগ্রেস পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে সক্ষম হয় ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি। অপরদিকে, আট বছর পর নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এর নিয়ন্ত্রণ পায় ডেমোক্র্যাটরা। ফলে কিছুটা চাপে পড়েন ট্রাম্প।

নতুন বিল পাসের জন্য উভয় কক্ষের সম্মতি আগের মতো পাওয়ার পথ বন্ধ হয় তার। এমনকী বিভক্ত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ স্বয়ং ট্রাম্পের ওপরই খড়গহস্ত হওয়ার পটও প্রস্তুত হয়। তবে এতে মোটেও বিচলিত না হয়ে তার স্বভাবসুলভ গতিতেই চলেছেন ট্রাম্প।

তার সঙ্গে মতবিরোধের জেরে এ বছর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া কিংবা সরিয়ে দেওয়ার হিড়িক পড়েছিল। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ছাড়েন নিকি হ্যালি, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দূরত্বের কারণে ছিটকে যান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস ম্যাটিস, চিফ অব স্টাফ জন কেলি, ট্রাম্প সরিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী রেক্স টিলারসন ও অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনসকে।

কোহেন মামলা, শরণার্থী ইস্যুতে নাজেহাল ট্রাম্প:

 

সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেন মামলা নিয়ে এ বছর নাজেহাল হয়েছেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প তার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা নারীদের মুখ বন্ধ রাখতে অর্থ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে কোহেনের অভিযোগ নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি।

অবৈধভাবে ওই অর্থ দিয়ে নির্বাচনী প্রচারের আর্থিক নিয়ম ভঙ্গ করাসহ একাধিক অভিযোগে তিনবছরের জেল হওয়ার পর কোহেন এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন। ট্রাম্পের ওইসব নোংরা কাজের দায় তাকে নিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন কোহেন।

অন্যদিকে, যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলা পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের করা মানহানির মামলা নিয়েও এবছর বিপাকে ছিলেন ট্রাম্প। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি এতে জয় পান। 

বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট মুলারের রাশিয়া তদন্তের বিষয়টিও প্রায় পুরোবছরই ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে। তদন্তে কংগ্রেসকে মিথ্যা বলার অভিযোগে ফেঁসেছেন ট্রাম্পের বেশ কয়েকজন সাবেক সহযোগী।

ওদিকে, মেক্সিকো সীমান্তে শরণার্থী প্রবেশে অতিরিক্ত কড়াকড়ি আর অবৈধ অভিবাসীদের তাড়ানো নিয়ে এবছর তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছেন ট্রাম্প। বছরের শুরুতে অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের সুরক্ষা দেওয়ার আইন নিয়ে বিরোধের জেরে একদফা অচলও হয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার।

তাছাড়া, এবছর অবৈধ শরণার্থীদের কাছ থেকে তাদের শিশু সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করে দেশে-বিদেশে নিন্দা কুড়িয়েছেন ট্রাম্প। বছরের শেষদিকে এসে মার্কিন হেফাজতে গুয়াতেমালার দুই শিশুর মৃত্যুও নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

মার্কিন সরকারে অচলাবস্থা:

বছরের একেবারে শেষে এসে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের অর্থবরাদ্দ নিয়ে ট্রাম্পের একগুঁয়েমিতে ফের অচল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের জন্য বাজেট বরাদ্দে পাঁচশ কোটি ডলার রাখার দাবি জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা তা অনুমোদন করলেও সিনেটের ডেমোক্র্যাটরা তাতে বাধ সাধায় ২১ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর সরকার আংশিক অচল হয়ে পড়ে। এ অচলাবস্থা দীর্ঘদিন স্থায়ী হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দেয়।

‘রক্তে রঞ্জিত’ সৌদি যুবরাজের হাত:

২ অক্টোবর তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো আলোচনার অন্ত নেই। খুনের ঘটনায় সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকেই উঠেছে সন্দেহের তীর। তার হাত ‘খাশুগজির রক্তে রঞ্জিত’ বলে সরাসরি অভিযোগ করেছে তুরস্ক।

সৌদি রাজপরিবারের বেশ কিছু নীতির সমালোচক হিসেবে পরিচিত ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট খাশুগজি বছরখানেক আগেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সৌদি আরব প্রথম দিকে খাশুগজির নিখোঁজের বিষয়ে কিছুই জানে না বলে দাবি করলেও আঙ্কারা ও পশ্চিমা মহলের চাপে পরে তারা কনস্যুলেটে তার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করে।

এ ঘটনার জেরে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেও রিয়াদের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন বয়কট করে বহু দেশ। ইউরোপের অনেক দেশ সৌদি আরবে অস্ত্র রপ্তানিও স্থগিত করে। সৌদি রাজপরিবারের ভেতরও ক্রাউন প্রিন্সের অবস্থা হয় নড়বড়ে। পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে নামতে হয় খোদ বাদশাহ সালমানকে।

এবছর সৌদি আরব সিনেমার দ্বার খোলা থেকে শুরু করে নারীদের গাড়ি চালনার অধিকার দেওয়াসহ অনেক কড়াকড়ির অবসান ঘটানোর মত বেশকিছু ইতিবাচক সংস্কারের কারণে প্রশংসা কুড়ালেও তাদের এ সব অর্জনই ম্লান করে দিয়েছে খাশুগজি হত্যাকাণ্ড।

সিরিয়ায় আসাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা:

সিরিয়া যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ এ বছর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে মোড় নিয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও বিদ্রোহীদের হটিয়ে সিরিয়ার ৭০ শতাংশ অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন আসাদ। বাকি থেকে যায় কেবল ইদলিব ।

বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া পরিচালিত বিমান হামলা এবং সিরিয়ার আরেক মিত্র দেশ ইরানের হাজার হাজার সেনার সমর্থনে বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হয় সিরীয় সেনাবাহিনী।

গত ৩০শে অগাস্ট সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সরকারের প্রধান লক্ষ্য ইদলিব 'মুক্ত' করা।

সাবেক রুশ গুপ্তচর স্ক্রিপাল হত্যাচেষ্টা নিয়ে উত্তেজনা:

এ বছর মার্চে রাশিয়ার পক্ষত্যাগী সাবেক গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়াকে যুক্তরাজ্যে সোভিয়েত আমলের নার্ভ এজেন্ট নোভিচক দিয়ে হত্যা চেষ্টা নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে রাশিয়া-যুক্তরাজ্য।

ইউরোপের মাটিতে এ ধরনের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্ক্রিপাল ও তার মেয়েকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠলেও তা অস্বীকার করে মস্কো। এরপরই শুরু হয় রুশ কূটনীতিক বহিষ্কারের হিড়িক। রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার করে।

যুক্তরাজ্যের পক্ষ নিয়ে পরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের ২৫টি দেশে ১২০ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে। পাল্টা জবাবে ২৩ দেশের কূটনীতিককে বহিষ্কার করে রাশিয়া।

সের্গেই ও ইউলিয়া স্ক্রিপাল নার্ভ এজেন্টের আঘাত কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়নি। যুক্তরাজ্যে ফের একই স্থানে নার্ভ এজেন্টে সংজ্ঞাহীন আরেক যুগলের খোঁজ মেলে। এ দফা একজনের মৃত্যুও হয়।

কের্চ প্রণালীতে ইউক্রেইন-রাশিয়া উত্তেজনা

বছরের শেষে এসে রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের কের্চ-এ ইউক্রেইনের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা উত্তাপ ছড়িয়েছে।কের্চ প্রণালীতে ইউক্রেনীয় জাহাজ ও নাবিকদের আটকের ঘটনায় মস্কো-কিয়েভ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

এর জেরে নেটো সম্মেলনের পর করণীয় ঠিক করতে বৈঠক করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা। উত্তেজনার কারণে এবছর ক্রিমিয়া উপদ্বীপে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-ফোর হান্ড্রেড মোতায়েন করে রাশিয়া।

ওদিকে, ক্রিমিয়ার পর মস্কো পুরো ইউক্রেইন দখলের মতলব আঁটছে অভিযোগে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরেশেঙ্কো আজোভ সাগরে নেটোকে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর অনুরোধ জানান। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও জারি করেন সামরিক আইন।

ব্রেক্সিটে নাকাল মে:

এ বছর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধীদের পাশাপাশি নিজ দল এমনকী মন্ত্রিসভাতেও নাকাল হতে হয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে কে। ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট) নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার পর এ বছরের শেষ নাগাদ একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারলেও চুক্তির কিছু বিষয় নিয়ে মে খুশি করতে পারেননি অনেককেই। যে কারণে চুক্তি নিয়ে পার্লামেন্টে ভোট ডেকেও পরে তা পিছিয়ে দিতে হয় তাকে।

নিজ দলে নেতৃত্ব নিয়ে সংকটে পড়ার পর মে আস্থাভোটে কোনোভাবে উৎরে গেলেও ২০১৯ সালে কার্যকর হতে যাওয়া ব্রেক্সিট কি শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে, না চুক্তি ছাড়াই হবে তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। আর এ দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে শক্তিশালী হচ্ছে ব্রেক্সিট নিয়ে নতুন গণভোটের দাবি; অস্থিরতার আভাস দেখা যাচ্ছে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডেও।

রোহিঙ্গা সংকটে বেকায়দায় সু চি:

বছরজুড়েই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে রোহিঙ্গা সংকট। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে রাখাইনে গণহত্যাসহ অবর্নণীয় নির্যাতন চালিয়েছিল, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মেলে তার প্রমাণ।

সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের প্রমাণ পায় জাতিসংঘের একটি তদন্ত দলও। মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চির সরকার ‘বিদ্বেষমূলক প্রচার উসকে দিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ ‘আলামত ধ্বংস’ করে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা না করে সেই নৃশংসতায় ‘ভূমিকা’ রেখেছে বলেও তদন্তকারীরা অভিযোগ করেন।           

কিন্তু রাখাইনে বর্বর ওই অভিযান নিয়ে শুরু থেকেই কিছু না বলা এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তেমন ভূমিকা না রাখতে পারায় অং সান সুচিকে যেমন তিরস্কারের মুখোমুখি হতে হয়েছে তেমনি বছরজুড়েই বেশ কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা একের পর এক তাকে দেওয়া পদক ও সম্মাননা ফিরিয়ে নিয়েছে।  

ইমরান খানের ছক্কা, মোদীর দুশ্চিন্তা:

পানামা পেপার্সে প্রকাশিত দুর্নীতির জেরে পাকিস্তানে নওয়াজ সরকারের পতনের পর ভোটে পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসেন দেশটির বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান। ক্রিকেটার থেকে প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া ইমরান প্রথম ভাষণেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তার আগ্রহের  কথা জানিয়ে এবং অর্থনৈতিক পতন ঠেকাতে কৃচ্ছ্র সাধনের ঘোষণা দিয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসিয়া বিবি খালাসের ঘটনায় উগ্রপন্থিদের বিক্ষোভ দমনে ইমরান সরকারের কৌশলী ভূমিকাও এ বছর পশ্চিমাদের নজর কেড়েছে। অর্থনৈতিক সংকট মেটাতে ইমরান চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও জোর দিয়েছেন। তবে বছরের শেষ দিকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার কড়া মন্তব্যও দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে খবর হয়েছে।

ওদিকে, ভারতে এবছর পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বছর শেষে বিজেপিবিরোধী জোটের বড় ধরনের সফলতা ভারতের রাজনীতির গতিমুখ বদলে দিতে পারে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা।

কোটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমা এবং বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য বানানোর পরও মোদীকে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাতেই থাকতে হচ্ছে। 

শ্রীলংকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা:

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চলতি বছর বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। ক্ষমতা নিয়ে রেষারেষির একপর্যায়ে অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহকে বরখাস্ত করে এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র মহিন্দ্রা রাজাপাকসেকে ওই পদে বসান প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা; তার এ সিদ্ধান্ত ধোপে টিকবে না বুঝতে পেরে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করেন তিনি।

সিরিসেনার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো সম্মিলিতভাবে আদালতে গেলে সুপ্রিম কোর্ট সিরিসেনার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়। পার্লামেন্টে বিশৃঙ্খলার মধ্যে আস্থা ভোটেও পরাজিত হন রাজাপাকসে। ডিসেম্বরে বিক্রমসিংহ ফের প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরলে দেশটির সাংবিধানিক সংকটের অবসান ঘটে।

বুড়ো হাড়ে ভেলকি:

৯২ বছর বয়সে নির্বাচন করে ফের মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছে এ বছর ভেলকি দেখিয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ। এ পথে নিজের পুরনো দলকে ছয় দশক পর ক্ষমতাছাড়া করতেও দুইবার ভাবেননি তিনি। দেশীয় একটি বিনিয়োগ তহবিল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগই কাল হয়ে দাঁড়ায় এক সময় মাহাথিরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নাজিব রাজাকের। নির্বাচনের ফল কারামুক্ত করে দীর্ঘদিন ধরে শাস্তি ভোগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে। আর ক্ষমতা হারানো নাজিব ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পাওয়া যেতে থাকে একের পর এক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ।

থাই গুহায় জীবনের জয়গান:

 বিশ্বকাপ ফুটবলে মশগুল বিশ্ব। এর মধ্যেই জুনের শেষ সপ্তাহে থাইল্যান্ডে এক গুহায় আটকে পড়ে ১২ কিশোর ও তাদের ফুটবল কোচ। শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর তাদেরকে অক্ষতভাবে উদ্ধার করতে পারাটাই ছিল এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা।

ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে গুহা সংশ্লিষ্ট খরস্রোতা নদীর পানি বেড়ে গিয়ে গুহার একটি অংশ ডুবে গেলে ভিতরে থাকা ওই কিশোররা আটকা পড়ে। নয়দিনের টানা অনুসন্ধানের পর গুহার ভেতরে তাদের খোঁজ মেলে। এরপরই শুরু হয় মহাযজ্ঞ। হাজারো স্বেচ্ছাসেবক, উদ্ধারকর্মী ও বিশেষজ্ঞর তত্ত্বাবধানে ১৭ দিন পর ওই কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচকে গুহা থেকে বাইরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়।

স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যু:

এ বছর ১৪ মার্চে ৭৬ বছর বয়সে মারা যান বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। সময় ও কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তত্ত্ব লেখা এবং সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্য নিয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগে এক নক্ষত্রের পতন ঘটে। মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়ে হুইলচেয়ারে বন্দি জীবন ছিল স্টিফেন হকিংয়ের। তার এতদিন বেঁচে থাকাটাই ছিল বিস্ময়ের।

সন্ত্রাসী হামলা:

এ বছরও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদীদের হামলা অব্যাহত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন স্থানে আইএসের দাপট কমে এলেও চলতি বছরের মার্চে ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলা ও পরের মাসেই টরোন্টোতে পথচারীদের ওপর গাড়ি তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটে।সেপ্টেম্বরে ইরানের আহভাজে সামরিক কুচকাওয়াজে হামলায় সেনাসদস্যসহ ২৯ জনের মৃত্যু হয়।

চলতি বছরও একের পর এক হামলায় কেঁপে উঠেছে কাবুল। এপ্রিলে শহরটির গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। ইন্টারকন্টিনেন্ট হোটেলে হামলায় বছরের শুরুতেই ৪০ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। নানগরহারে অপর এক হামলায় মারা পড়েছিল অর্ধশতাধিক মানুষ। বোকো হারাম ও আল শাবাব অস্থির করে রেখেছিল আফ্রিকার মধ্যাঞ্চলকেও। মালিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের ওপরও চলতি বছরই হামলার ঘটনা ঘটেছে। লিবিয়ার বেনগাজিতে জোড়া গাড়ি বোমা হামলায়ও প্রাণ গেছে ৪১ জনের।

বন্দুক সহিংসতা:

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনাও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোরিডার স্টোনম্যান ডগলাস স্কুলে ১৭ শিক্ষার্থীর নিহত হওয়ার ঘটনা।

এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক আইন আরও কঠোর করার দাবি উঠলেও তাতে কর্ণপাত করেনি রিপাবলিকান প্রশাসন। যার প্রেক্ষিতে মার্চে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখায় হাজারো স্কুলশিক্ষার্থী। ওই মাসেরই ২৪ তারিখ বিশ্বের ৯০০রও বেশি শহরে বন্দুক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভস’ কর্মসূচি পালিত হয়।  

বছরের শেষ দিকে পিটসবুর্গের সিনাগগে বন্দুকধারীর গুলিতে প্রার্থনারত ১১ ইহুদি নিহত হন।

দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল:

এ বছরও বিশ্ব বড় ধরনের ভূমিকম্প, সুনামি, দাবানল, বন্যা ও বৃষ্টির দেখা পেয়েছে।

 মার্চে রাশিয়ায় শপিং কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৬৪ জন। ২৮ মার্চ ভেনেজুয়েলার পুলিশ সদরদপ্তরে আগুনে নিহত হয় ৭৮ জন। সপ্তাহখানেক পর কানাডায় বাস ও মিনিট্রাক সংঘর্ষে জুনিয়র আইস হকি দলের খেলোয়াড়সহ ১৬ জন নিহত হয়। গুয়েতেমালার ফুয়েগো আগ্নেয়গিরির প্রাণঘাতী অগ্ন্যুৎপাত কেড়ে নেয় আরও ১০৯ জনের জীবন।

জুনে ভেনেজুয়েলায় কারাকাসে নাইটক্লাবে পদদলনে মারা পড়ে ১৭ জন। জুলাইতে উত্তর আমেরিকাজুড়ে দেখা দেয় তীব্র তাপদাহ। একদিনেই কানাডার ক্যুইবেকে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়। গ্রিসে ভয়াবহ দাবানলে মৃত্যু হয় ৮৭ জনের।যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতেও দাবানলে মৃত্যু হয় ৮৮ জনের, পুড়ে যায় প্রায় ১৯ হাজার ঘরবাড়ি।

অগাস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে কেরালায় দেখা দেয় সর্বগ্রাসী বন্যা। ১০০ বছরের মধ্যে রাজ্যটিতে দেখা দেওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ এ বন্যায় মৃতের সংখ্যা তিনশ’র ঘর অতিক্রম করে। রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশে ধুলিঝড় ও বজ্রবৃষ্টিতেও মারা পড়েন শতাধিক লোক।

সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ব্রাজিলের ২০০ বছরের পুরনো জাদুঘর। ওই মাসেই ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসিতে ভূমিকম্প-সুনামিতে নিহত হয় দুই হাজারের বেশি মানুষ, আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১০ হাজার।

অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় মাইকেল। ফ্লোরিডার সমুদ্রউপকূলবর্তী একটি শহরকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এ ঝড়। ১৯ অক্টোবর ভারতের পাঞ্জাবে রাবণবধের উৎসবে ট্রেনে কাটা পড়ে ৬০ জন নিহত হয়।

২০১৮ বেশক’টি বিমান দুর্ঘটনারও সাক্ষী হয়েছে। এর মধ্যে আছে মস্কোর সারাতভ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৭০৩ ও জাগরোস পাহাড়ে বিধ্বস্ত হওয়া ইরানের আসেমান এয়ারলাইন্সের বিমান ।

এ বছর নেপালও সাক্ষী হয় বিমান দুর্ঘটনার। নেপালে কাঠমাণ্ডুর ত্রিভূবন বিমানবন্দরে ১২ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এবছর ঘটে যাওয়া অন্যতম বড় বিমান দুর্ঘটনা।

এপ্রিলে আলজেরিয়ার বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয় ২৫৭ জন। মে মাসে হাভানায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা পড়েন শতাধিক মানুষ। বছরের একেবারে শেষ দিকে ১৮৯ আরোহী নিয়ে জাভা সাগরে বিধ্বস্ত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ারের একটি অত্যাধুনিক বিমান।

এর বাইরে ইতালিতে সেতু ধ্বসে ৪৩ জনের মৃত্যু ও ২০ সেপ্টেম্বর তাঞ্জানিয়ার লেক ভিক্টোরিয়ায় ফেরি ডুবে ২২৮ জন নিহতের ঘটনাও বিশ্ববাসীকে নাড়া দেয়।

বছরের একেবারে শেষ দিকে ২২ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার আনাক ক্রাকাতাউ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট সুনামিতে প্রায় সাড়ে চারশ জন নিহত হয়।

অন্যান্য ঘটনা:

*১৪ ফেব্রুয়ারি: ৯ বছর ক্ষমতায় থাকার পর পদত্যাগ করতে হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে ।

* ১১ মার্চ: চীনা পার্লামেন্ট সংবিধান থেকে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সংক্রান্ত বিধান তুলে দিলে শি-র জন্য আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথ প্রশস্ত হয়।

* ১৮ মার্চ: চতুর্থ মেয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন ভ্লাদিমির পুতিন।

*১৯ এপ্রিল: ক্যাস্ত্রো ভ্রাতৃদ্বয়ের কিউবা পেয়েছে নতুন প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেলকে।

* ২৪ অগাস্ট: অস্ট্রেলিয়ায় টার্নবুলকে দলের নেতৃত্ব থেকে হটিয়ে অভাবনীয় চমকে প্রধানমন্ত্রী হন স্কট মরিসন।

*২৮ অক্টোবর: ব্রাজিলে তুমুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হয়ে যবনিকাপাত ঘটে লুলা ডি সিলভার শাসনের। ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসেন কট্টরপন্থি জাইর বোলসোনেরো।  

* ১৯ মে: যুক্তরাজ্যের প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কলের ব্যতিক্রমী বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে রাজপরিবারের আরেকটি বিয়ে প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব।

*১৪ জুন: রাশিয়ায় ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ২০১৮’ তে জয়ী হয় ফ্রান্স।

*এ বছরই ফ্রান্স কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ দেখেছে, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ দিয়ে শুরু হলেও পরে সরকারবিরোধী নানা দাবিতে এ আন্দোলন শতাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

*১৬ জুলাই: তৃতীয় একটি দেশ ফিনল্যান্ডের হেলসিনকিতে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন।

* ১৬ অক্টোবর: বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে গাঁজা সেবন ও বিক্রি বৈধ করেছে কানাডা।

*জাপানের রাজধানী টোকিওর সাবওয়েতে ১৯৯৫ সালে সারিন গ্যাস হামলায় হতাহতের ঘটনায় চলতি বছর দেশটিতে একটি মঠের সাবেক প্রধানসহ সাতজনের মৃত্যুদণ্ড হয়।

*এ বছরই আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে ২০ বছর ধরে চলা ইরিত্রিয়া-ইথিওপিয়া যুদ্ধের।

*সমুদ্রের ওপর দিয়ে এ বছরই নির্মিত হয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সেতু।

*পেনশনের সুবিধাসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানোর প্রতিবাদে বছরের মাঝামাঝি ফুঁসে ওঠে  নিকারাগুয়া।

*কঙ্গোয় ইবোলা ভাইরাস ফের আতঙ্ক নিয়ে হাজির হয়েছে এ বছর।

*চীনের এক বিজ্ঞানী এবছর মানব ভ্রুণের জিন থেকে এইডস রোগ মুছে শিশু জন্ম দেওয়ার দাবি করলে বিশ্বজুড়ে হইচই শুরু হয়।

*২০১৮ সালে বিশ্ব হারিয়েছে: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে। বলিউড সুপারস্টার শ্রীদেবীকে। মারা গেছেন সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার ও লেখক কলিম খান, পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর, সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন, নোবেলজয়ী ভি এস নাইপল। কয়েক মাসের ব্যবধানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও তার স্ত্রী বারবারা বুশ। বছরের শেষ দিকে মারা যান সৌদি রাজপরিবারের সংস্কারের সরব সমর্থক প্রিন্স তালাল বিন আব্দুলাজিজ।