জর্জ বুশ সিনিয়র আর নেই

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2018, 05:30 AM
Updated : 1 Dec 2018, 08:41 AM

তার ছেলে জর্জ ওয়াকার বুশ এক বিবৃতিতে শুক্রবার সন্ধ্যায় সিনিয়র বুশের মৃত্যুর খবর জানান।

হিউস্টনে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান বলে পরিবারের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে জন্য নির্বাচনে তিনি ডেমক্রেটিক প্রার্থী বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে যান। পরে তার ছেলে জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০১ সাল থেকে দুই দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে মাত্র দুইজন নিজের ছেলেকেও প্রেসিডেন্ট হতে দেখেছেন।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউজে এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের গলায় সম্মানসূচক মেডেল পরিয়ে দিচ্ছেন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ নিজের পূর্বসূরি রোনাল্ড রিগ্যানের দুই মেয়াদে মোট আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।

সিনিয়র বুশ বেশ আগে থেকেই পার্কিনসনস রোগে ভুগছিলেন। হাঁটার শক্তি হারানোয় তাকে চলাফেরা করতে হত হুইলচেয়ারে, নয়ত বৈদ্যুতিক স্কুটারে। শ্বাসতন্ত্রের জটিলতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোকে তাকে বেশ কয়েক দফা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই রক্তে সংক্রমণজনিত কারণে তাকে হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। 

এ বছর এপ্রিলে এইচ ডব্লিউ বুশের স্ত্রী বারবারা বুশ মারা যান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৈমানিক জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৬৪ সালে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন টেক্সাসের একজন তেল ব্যবসায়ী।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্ব নেতারা সিনিয়র বুশের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।

প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ:

জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ অত্যন্ত দক্ষ কূটনীতিক ছিলেন, বিশেষ করে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে। স্নায়ু যুদ্ধের শেষ দিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেন্ট স্কুক্রফ্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকারকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন তিনি। যেখানে সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ও তার স্ত্রী বারবারা বুশ। ফাইল ছবি: রয়টার্স

সিনিয়র বুশের পররাষ্ট্র নীতিকে আরেকটি বিপদজনক পরীক্ষায় ফেলেছিলেন ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম হোসেন।

সাদ্দাম বাহিনী প্রতিবেশী কুয়েত আক্রমণ করে ধ্বংসযোজ্ঞ শুরু করলে দেশটির সরকার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চায়।

এইচ ডব্লিউ বুশ তাতে সাড়া দিয়ে চার লাখের বেশি মার্কিন সেনা কুয়েত পাঠান।

তখন তিনি বলেছিলেন, “এটা মেনে নেওয়া যায় না। কুয়েতের উপর এই আক্রমণ মেনে নেওয়া যায় না।”

১৯৯১ সালে মার্কিন সেনারা ইরাকী বাহিনীকে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করে। ওই সময় অনেকেই ভেবেছিলেন সাদ্দামকে উৎখাত করতে বুশ হয়তো বাগদাদ আক্রমণ করবেন। কিন্তু তিনি তা না করে সেনাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

সিনিয়র বুশ ওই সময় কতটা দক্ষ কূটনীতিকের মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার প্রমাণ দেন তার ছেলে জর্জ ডব্লিউ বুশ।

ডব্লিউ বুশের আমলে মার্কিন বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে। কিন্তু ওই যুদ্ধে যত মার্কিন সেনার রক্ত ঝরেছে  এবং যে পরিমাণ সম্পদ ব্যয় হয়েছে তা এত দিতে এসে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে প্রমাণিত।

শেষ বয়সে হুইলচেয়ারই ছিল জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ নিত্যসঙ্গী। ফাইল ছবি: রয়টার্স

সাদ্দামকে উৎখাতের চেষ্টা না করলেও তার আগে  অফ-ডিউটিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের এক মেরিন সেনাকে হত্যা করায় এইচ ডব্লিউ বুশ পানামা আক্রমণ করে তখনকার স্বৈরাশাসক ম্যানুয়েল নোরিয়েগাকে উৎখাত করেন। এজন্য মার্কিন বাহিনী মাত্র চারদিন সময় নেয়। পরে মাদক মামলায় নোরিয়েগাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আদালত ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেয়।

প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গেও নিরাপদ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন সিনিয়র বুশ।  ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়ানানমেন স্কয়ারে বিক্ষোভরতদের উপর চীন সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি দেশটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। যদিও একই সঙ্গে তিনি সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছেদও চাননি।

আলোচনার মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংকট সমাধানের পথও তিনিই দেখিয়েছেন। তার ওই পথে অনুসরণ করেই পরে বিল ক্লিনটনের আমলে ‘অসলো চুক্তি’ হয়।

ডালাসে সাউদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে পিতা-পুত্রের করমর্দন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

বৈদেশিক নীতিতে দক্ষতার পরিচয় দিলেও দেশে অর্থনীতির চাকা গতিহীন হয়ে পড়ায় জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। নির্বচনী প্রচারে কর না বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় দায় তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে চুকাতে হয়েছে।

জন্ম ও কর্ম জীবনঃ

১৯২৪ সালের ১২ জুন ম্যাসাচুসেটসের মিল্টনে বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নেন বুশ। অভিজাত স্কুলে লেখাপড়ার শুরু, কলেজ শেষ করার আগেই মাত্র ১৮ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।

নৌবাহিনীর বৈমানিক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে অংশ নেন এবং প্রশান্ত মহাসাগরে তার আকাশযান গুলিতে ভূপাতিত হলেও তিনি বেঁচে যান।

যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তিনি বারবারাকে বিয়ে করেন; এ দম্পতি ছয় সন্তান।

ইয়াল ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশনের পর একজন তেল ব্যবসায়ী হিসেবে টেক্সাসে পাড়ি জমান সিনিয়র বুশ।

সেখানেই ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালে টেক্সাসে সিনেট নির্বাচনে হেরে যান। তবে দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

তারপর দুই মেয়াদে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য ছিলেন এইচ ডব্লিউ বুশ। এরমধ্যে ১৯৭০ সালে দ্বিতীয় দফা সিনেট নির্বাচনে হারেন।

সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাকে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি পরে সিআইএর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিনিয়র বুশ রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পকে অনুমোদন দেননি। তার ছেলে জেব বুশ নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এছাড়া নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প সাবেক প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশকে কটাক্ষ করেও কথা বলেছিলেন।

ওই নির্বাচনে সিনিয়র বুশ ডেমক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিল সিএনএন। যদিও বুশ পরিবার এ বিষয়ে মুখ খোলেনি। তবে ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমন্ত্রিত হলেও জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ উপস্থিত ছিলেন না।