ছেলের প্রতি সমর্থন দেখাতে দেশের ভেতর সফরে সৌদি বাদশা

ছেলে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদের প্রতি নিজের সমর্থনের বিষয়টি জনসম্মুখে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে তাকে নিয়েই সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চল সফরে বেরিয়েছেন বাদশা সালমান।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2018, 10:26 AM
Updated : 8 Nov 2018, 10:26 AM

তুরস্কের সৌদি কনসুলেটের ভেতর গত মাসে সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের পর যে আন্তর্জাতিক চাপ ও সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যেই চলতি সপ্তাহে বাদশার এ সফর করছেন, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

অভ্যন্তরীণ এ সফরের অংশ হিসেবেই মঙ্গলবার সালমান ও মোহাম্মদ মধ্যাঞ্চলীয় আল-কাসিম প্রদেশে পৌঁছালে সেখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও শিশুরা ফুল দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানায়।

বাদশার আগমন উপলক্ষে কাসিমের সড়কগুলোতে সারি করে লাগানো হয় সৌদি আরবের পতাকা; স্থান পায় বাদশা ও ক্রাউন প্রিন্সের বড় বড় ছবিও।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসপিএ জানায়, কাসিম সফরে সালমান বেশ কয়েকটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন, যার আনুমানিক ব্যয় প্রায় ১১২ কোটি ডলার।

বাদশার সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে কট্টর রক্ষণশীল এ প্রদেশটির কারাগার থেকে বেশকিছু বন্দিকেও মুক্তি দেওয়া হয়।

৮২ বছর বয়সী সালমানের সাম্প্রতিক এ জনসমক্ষে আসার প্রধান কারণ ছেলের প্রতি সমর্থন দেখানো, বলছেন পর্যবেক্ষকরা।

সৌদি আরবের প্রতিদিনের শাসনকাজের প্রায় সবকিছুই ক্রাউন প্রিন্স দেখভাল করলেও খাশুগজির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মোহাম্মদের ভাবমূর্তি এখন অনেকটাই তলানিতে।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্সই খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন বলে দাবি তুরস্কের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সাংবাদিক হত্যার নৈতিক দায় মোহাম্মদের ওপরই বর্তায়, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।

অক্টোবরের ওই ঘটনার পর পশ্চিমা বেশ কয়েকটি দেশ সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার কথা জানিয়েছে। কনসুলেটের ভেতর সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় পশ্চিমারা রিয়াদে অনুষ্ঠিত একটি বিনিয়োগ সম্মেলনও বয়কট করেছে। 

পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাঠে নামতে হয় বাদশা সালমানকেই। তুরস্কের সঙ্গে কথা বলতে নিজের এক বিশ্বস্ত উপদেষ্টাকে দেশটিতে পাঠান তিনি। খাশুগজি হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন ১৮ জনকে গ্রেপ্তারের খবর জানায় এসপিএ; বরখাস্ত করা হয় মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ এক সহচরসহ উর্ধ্বতন ৫ সৌদি কর্মকর্তাকে।

কয়েক সপ্তাহ আড়ালে থাকার পর সামনে আসেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্সও। ২৫ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে খাশুগজি হত্যায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন।

সম্প্রতি ইয়েমেন সীমান্তের কাছে মোতায়েন করা সৈন্যদের সঙ্গেও মোহাম্মদ দেখা করেছেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

সোমবার অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে ক্রাউন প্রিন্সকে এক সৈনিকের সঙ্গেও দেখা গেছে। ভিডিওতে সৈনিকটিকে ‘নায়ক’ হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেন সিংহাসনের এ উত্তরাধিকার।

“খাশুগজির ঘটনার পর সৌদিদের মধ্যে নানা ধরনের ভয়, আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা কাজ করেছে।  এ কারণেই বিভিন্ন অঞ্চলে বাদশার এ সফর, তিনি যে এখনো তার অবস্থানে আছেন এবং তিনিই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর, সফরে সেটি নিয়েই পুনরায় আশ্বস্ত করা হবে,” বলেছেন আল-সৌদ বংশের সমালোচক হিসেবে পরিচিত লন্ডনভিত্তিক সৌদি লেখক মাদাউয়ি আল-রাশিদ।

টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসাগরীয় রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক গ্রেগ গস বলছেন, বাদশা ও ক্রাউন প্রিন্সের সফরও দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতাকে শান্ত করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

“তবে কোনো কিছুই এখন আর সমস্যা হবে না, বাদশা সম্ভবত এ বিষয়ে আস্থা ফিরে পেয়েছেন,” ভাষ্য গ্রেগের।

৩৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ সৌদি রাজ পরিবারের নতুন প্রজন্মের শীর্ষ প্রতিনিধি হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে রয়েছেন বলেও মত পর্যবেক্ষকদের। এর আগে দেশটির বাদশা ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ও তার সন্তানরা।

নিয়ম অনুযায়ী, পরিবারের সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে বাদশা তার আপন ও অন্যান্য জ্ঞাতি ভাইদের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে বসান।

কিন্তু ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকে মোহাম্মদের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ রাজপরিবারের ভেতরকার চাপা দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার পথ করে দিয়েছে। দায়িত্ব নিয়েই রাজপরিবারের প্রভাবশালী অনেক সদস্যকে গৃহবন্দি করেন মোহাম্মদ; দুর্নীতি দমন অভিযানের নামেও অনেককে মাসের পর মাস আটকে রাখেন।

খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এ পরিস্থিতির সামান্য বদল ঘটেছে। তারই সূত্র ধরে দেশের বাইরে থাকা বাদশার ছোট ভাই প্রিন্স আহমেদ বিন আবদুলআজিজ গত সপ্তাহে সৌদি আরব ফিরেছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

গত বছর আটক করা বাদশার দুই ভাতিজাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশকিছু ছবিতে বোঝা যাচ্ছে। 

এতকিছুর পরও সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের ক্ষমতায় লাগাম টানা যাবে না বলে ধারণা কূটনীতিকদের।

“এমবিএস (মোহাম্মদ বিন সালমান) কোথাও যাচ্ছেন না। পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হচ্ছেন এবং তারা তার পেছনে দাঁড়াচ্ছেন.” বলেন এক জ্যেষ্ঠ আরব কূটনীতিক।

সিংহাসনে মোহাম্মদের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষদের গত বছর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন বাদশা, যে কারণে ‘ফেরার কোনো পথ নেই’ বলেও মন্তব্য তার।

“বাদশা ক্রাউন প্রিন্সকে পুনর্গঠিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও দায়িত্ব দিয়েছেন, খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের পর যেগুলোতে অদল বদল করতে হয়েছিল। এটিই ইঙ্গিত- ক্রাউন প্রিন্স এখনো ‘ধরাছোঁয়ার বাইরে’,” বলেন এ কূটনীতিক।