খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ এসেছিল ‘স্কাইপে’

তুরস্কের সৌদি কনসুলেটের ভেতর সাংবাদিক জামাল খাশুগজিকে হত্যার নির্দেশনা এসেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্কাইপের মাধ্যমে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2018, 07:09 AM
Updated : 23 Oct 2018, 07:17 AM

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানিই এ নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে দেশটির দুটি গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

বিয়ের কাগজপত্র যোগাড় করতে গত ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটে গিয়েছিলেন বছরখানেক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাস করা খাশুগজি। এরপর থেকেই ওয়াশিংটন পোস্টের এ কলামনিস্টের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

তাকে সৌদি কনসুলেটের ভেতরই খুন করা হয়েছে বলে তুরস্ক শুরু থেকেই দাবি করলেও রিয়াদ তা অস্বীকার করেছিল।

আন্তর্জাতিক চাপ ও তুরস্কের কর্মকর্তাদের তদন্তের মধ্যে দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর সৌদি আরব স্বীকার করে, কনসুলেটের ভেতরেই খাশুগজিকে খুন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় অন্তত ১৮ জনকে গ্রেপ্তার ও ৫ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে শনিবার জানায় দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। বরখাস্তদের মধ্যে প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা কাহতানিও আছেন।

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের এই ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাই লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরিকে রিয়াদে আটকে রাখা এবং সৌদি আরবের হাজারেরও বেশি অভিজাতকে গ্রেপ্তারের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বলে জানিয়েছে সৌদি সূত্রগুলো।

কাহতানিই ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো চালান। ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটে খাশুগজিকে নির্মমভাবে হত্যার নির্দেশও তার কাছ থেকেই এসেছিল, দাবি দুটি গোয়েন্দা সূত্রের।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কাহতানির ঘাড়ে ‘দোষ চাপলেও’ ক্রাউন প্রিন্সের ইশারা ছাড়া তিনি কোনো কিছু করবেন, এমনটা হতে পারে না বলেও অনুমান অনেকের।

রাজপ্রাসাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, মোহাম্মদের পারিষদবর্গের সদস্য কাহতানির প্রভাব গত তিন বছর ধরেই বাড়ছিল; তার প্রতি ক্রাউন প্রিন্সেরও ছিল বিশেষ নজর।  

সে কারণেই ক্রাউন প্রিন্সকে বাদ রেখেই যেভাবে কাহতানিকে সাংবাদিক হত্যার ‘মাস্টারমাউন্ড’ বানানোর চিত্রায়ন চলছে, তাতে বিশ্বাস রাখতে পারছেন না সৌদি কর্মকর্তারাই।

“এই পর্বে এমবিএসকে (মোহাম্মদ বিন সালমান) না সরানো হলেও এটি তার ভাবমূর্তিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যদি আদৌ এ ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার হয়, তাতেও লাগবে দীর্ঘ সময়। আপাতত বাদশা তাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন,” ভাষ্য রাজপ্রাসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের।

কাহতানি নিজেও একসময় বলেছিলে, বসের অনুমোদন ছাড়া তিনি কোনো কিছুই করেন না।

“আপনাদের কী ধারণা, নির্দেশনা ছাড়াই আমি সিদ্ধান্ত নিই? আমি একজন চাকরিজীবী, বাদশা ও ক্রাউন প্রিন্সের বিশ্বস্ত নির্বাহী,” গত গ্রীষ্মে টুইটারে এমনটাই বলেছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। টুইটারে তার জীবনবৃত্তান্তেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে; আগে তার পরিচয় লেখা ছিল সৌদি রাজপ্রাসাদের উপদেষ্টা, এখন দেখাচ্ছে সৌদি ফেডারেশন ফর সাইবার সিকিউরিটি, প্রোগ্রামিং অ্যান্ড ড্রোনের চেয়ারম্যান। মোহাম্মদ বিন সালমানের এ ঘনিষ্ঠ সহচর এ পদে আগেও ছিলেন।

শনিবার এক সৌদি কর্মকর্তা জানান, যে অভিযানে খাশুগজির মৃত্যু হয়েছে সে সম্বন্ধে ক্রাউন প্রিন্স কিছুই জানতেন না; তিনি এমনকি ‘সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে অপহরণ বা হত্যার নির্দেশও দেননি’।

খাশুগজিকে নিয়ে গত তিন সপ্তাহের সৌদি ভাষ্যেও হেরফের দেখা গেছে। প্রথম দিকে তারা রাজপরিবারের সমালোচক সাংবাদিকের কনসুলেটের ভেতর মৃত্যুর তথ্যই অস্বীকার করেছিল। দুই সপ্তাহ পর তারা জানায়, কনসুলেটের ভেতর ‘মুষ্টিযুদ্ধের’ এক পর্যায়ে খাশুগজির মৃত্যু হয়। এখন আবার বলছে, ওয়াশিংটন পোস্টের এ সাংবাদিক মারা গেছেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে।

সৌদি বক্তব্যের এ সংস্করণও অস্বীকার করেছে আঙ্কারা। তারা বলছে, কনসুলেটের ভেতর কি হয়েছে, তার অডিও রেকর্ড তাদের কাছে আছে।

গত বছর স্বল্প সময়ের জন্য লেবাননি প্রধানমন্ত্রী হারিরিকে আটকে রাখার সময় তাকে গালাগালি ও মারধর করা হয়েছিল। যে দলটি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল কাহতানি তার নেতৃত্বে ছিলেন বলেও আরব ও পশ্চিমা আটটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে।

ফ্রান্স সেসময় হস্তক্ষেপ করে হারিরকে দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। এ ঘটনার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো রিয়াদকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করানোয় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। 

সে তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। খাশুগজিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চাপও ছিল প্রবল, এমনকী সৌদি আরবের এসব বক্তব্যের বিষয়েও তারা সন্দিহান।

জার্মানি জানিয়েছে, তারা সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রাখবে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এক যৌথ বিবৃতিতে রিয়াদকে ‘২ অক্টোবর সত্যিকার অর্থে কী হয়েছিল, তার দ্রুত ব্যাখ্যা’ দাবি করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এ ঘটনায় তার অসন্তোষ চেপে রাখেননি। যদিও তিনি বলেছেন, ইস্তাম্বুলের কনসুলেটের ভেতর যা ঘটেছে তাতে রিয়াদে ওয়াশিংটনের অস্ত্র বিক্রি আটকাবে না।

সৌদি রাজপ্রাসাদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, কাহতানিকে সাংবাদিক হত্যার দায় নিতে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদই বলেছেন ।

বরখাস্তের পর থেকে প্রভাবশালী এ উপদেষ্টাকে আটকে রাখা হলেও তিনি টুইট করতে পারছেন বলে আরেক জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

রাজপ্রাসাদের ঘনিষ্ঠ আরেকটি সূত্র অবশ্য বলছে, কাহতানিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলেই ধারণা তাদের।

মোহাম্মদ বিন সালমান প্রশাসনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলোর মতো খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের সময়ও কাহতানির উপস্থিতি ছিল বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো; এবার অবশ্য এই উপস্থিতি ছিল ‘ভার্চুয়াল’।

যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক সাংবাদিক খাশুগজি ২ অক্টোবর স্থানীয় সময় বেলা ১টার দিকে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটে ঢুকেছিলেন।

তাৎক্ষণিকভাবে ১৫ সদস্যের একটি সৌদি গুপ্তচর দল তাকে কনসুলেট ভবনের ভেতরে বন্দি করে ফেলে বলে দাবি তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর।

ওই গুপ্তচররা এর কয়েক ঘণ্টা আগে দুটি বিমানে ইস্তাম্বুলে উড়ে এসেছিল এবং হত্যাকাণ্ডের অল্প সময় পর তারা তুরস্ক ছেড়ে যায় বলে দাবি তুর্কি কর্মকর্তাদের।

বন্দি খাশুগজিকে কনসুলেট ভবনের ভেতর একটি কক্ষে স্কাইপের মাধ্যমে কাহতানি জিজ্ঞাসাবাদ করেন বলে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা ও রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আরবের এমন এক উচ্চপদস্থ সূত্র জানিয়েছে।

আরব ও তুর্কি সূত্রগুলো বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে কাহতানি একের পর এক অপমান করলেও খাশুগজি নিজের মত করে সেসবের জবাব দিয়েছিলেন। তবে রাজপ্রাসাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত গুপ্তচর দলের সঙ্গে তার বিরোধ বেধে যায়। এরই এক পর্যায়ে কাহতানি তার লোকেদের খাশুগজিকে মেরে ফেলতে বলেন।

“কুকুরটার মাথা আমার কাছে নিয়ে এসো,” কাহতানি এমন নির্দেশনাই দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে এক তুর্কি গোয়েন্দা সূত্র।

পুরো হত্যাযজ্ঞ কাহতানি দেখেছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওই অভিযানকে উচ্চপদস্থ এক আরব সূত্র ‘বিশৃঙ্খল ও বিশ্রি অভিযান’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

কাহতানির ওই স্কাইপ কলের অডিও এখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট তায়িপ এরদোয়ানের কাছে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বেশ কয়েকটি সূত্র। ওই অডিওটি মার্কিনিদের দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এরদোয়ান।

মঙ্গলবার সাপ্তাহিক বক্তৃতায় তুরস্কের তদন্তে পাওয়া তথ্যগুলো উন্মোচন করবেন বলেও রোববার জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।

ওই বক্তৃতার আগে এ বিষয়ে কিছু জানাতে অস্বীকার করেছেন তিন তুর্কি কর্মকর্তা।

খাশুগজি কনসুলেট ভবনের ভেতর মারামারির এক পর্যায়ে মারা গেছেন, সৌদি আরবের এ আনুষ্ঠানিক অবস্থানের কথা যে কর্মকর্তা জানিয়েছেন তিনি হত্যাকাণ্ড সংঘটনে স্কাইপে কাহতানির নির্দেশনা বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে সৌদি আরবের তদন্ত এখনো চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।