রোহিঙ্গা নিপীড়ন: জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের ফল কী হবে?

রাখাইনে রোহিঙ্গা ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ হোতা হিসেবে মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তার ফল কী হতে পারে তা নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2018, 03:07 PM
Updated : 28 August 2018, 03:37 PM

বিবিসি তাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জোনাথন হেড এবং জেনিভা প্রতিনিধি  ইমোজেন ফুকসের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করেছে,  ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশ কীভাবে কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব, রাখাইনের পরিস্থিতি ওই প্রতিবেদনের ফলে কতটা বদলাতে পারে।

পরিস্থিতি আদৌ বদলাবে?

জোনাথন হেড: জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনে সাধারণের তুলনায় অনেক বেশি কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। তদন্তকারীরা শব্দপ্রয়োগে কোনো রাখঢাক করেননি, মিয়ানমারের জেনারেলদের তারা বর্ণনা করেতে গিয়ে তারা অত্যন্ত কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন।

তদন্তকারীরা বলছেন, গণহত্যার অভিযোগে বিচার চালানোর মত জোরালো প্রমাণ তদন্তে মিলেছে। মিয়ানমারে যে সেনা কর্মকর্তাদের ওই বিচার সম্ভব নয়, সে বিষয়েও জোর দিয়েছেন তদন্তকারীরা। বিষয়টি তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে দিতে বলছেন।

কীভাবে সেটি করা যায় তা খুঁজে দেখতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের কাছ থেকে আরও উদ্যোগী ভূমিকা নতে হবে। রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে এর আগে যেসব আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রতিবেদন এসেছে, সেগুলো বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে মিয়ানমার সরকার।

কিন্তু জাতিসংঘের এবারের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত তিনজন আইন বিশেষজ্ঞ এ কাজটি করেছেন। এ প্রতিবেদন জাতিসংঘের ভেতরে অনেকের সমর্থন পাওয়ার কথা। ফলে এবারের প্রতিবেদন উড়িয়ে দেওয়া মিয়ানমারের পক্ষে কঠিন হবে।

রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে মিয়ানমার যেসব তদন্ত চালানোর কথা বলেছে, সেগুলোকে ‘অর্থহীন’ বলে খারিজ করে দিয়েছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। ফলে ‘তদন্তে কিছু পাওয়া যায়নি’ বলে চাপ এড়ানো এখন মিয়ানমারের জন্য এবার কঠিন হবে।

এই প্রতিবেদন মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে তুলবে। শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের ঠেলে দেবে নিকৃষ্ট শ্রেণির মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের কাতারে।কিন্তু তাতে মিয়ানমারের ভেতরের পরিস্থিতি বদলাবে বলে মনে হয় না।

ইমোজেন ফুকস: জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলছেন, মিয়ানমারে বিষয়টি বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানো উচিত। সেটা করতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি দেশ- চীন খুব সম্ভবত তাতে ভিটো দেবে। 

মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেওয়া না গেলে রুয়ান্ডা বা সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধের বিচারের মত রাখাইনের ঘটনা নিয়েও স্বাধীন একটি অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন তদন্তকারীরা।

তত্ত্বীয়ভাবে দেখলে নিরাপত্তা পরিষদে ভিটোর বিষয়টি এড়িয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মাধ্যমেই এ ধরনের একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সম্ভব। কিন্তু সেই ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি কার্যকর করতে হলে মিয়ানমারের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে, যাতে অভিযুক্তরা আদালতে সোপর্দ করা যায়।

এর আগে সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু সেজন্য দীর্ঘ সময় লেগেছিল। 

জাতিসংঘ কি ট্রাম্প কার্ড খেলে ফেললো?

ইমোজেন ফুকস: মিয়ানমারের সেনা প্রধানসহ শীর্ষ ছয় জেনারেলের নাম ধরে অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ অন্য যে কোনো ঘটনার চেয়ে বড় একটি পদক্ষেপ ফেললো।

সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নিয়ে অনেক তদন্ত হয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের তালিকা সেখানে যথেষ্ট দীর্ঘ। সে তালিকায় সিরিয়ার সেনাবাহিনী এবং সরকারের শীর্ষ স্থানীয়দের নাম আছে বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু প্রকাশ্যে কখনোই নাম ধরে কোনো অভিযোগ করা হয়নি।

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা হয়ত মনে করছেন, নির্দিষ্ট করে নাম বললে কোনো সুবিধা হতে পারে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৈঠক ডেকেছে, সেখানে জাতিসংঘের তদন্তকারীদের বক্তব্য শোনা হবে। আর ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের পৃষ্ঠা তারা বন্ধ করে দিচ্ছে।

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা যেমন সুপারিশক করেছেন, সে রকম নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হতে পারে। প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে, তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি, সম্পদ জব্দ করার মত পদক্ষেপ নিতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।

অং সান সু চি বা অন্য কাউকে বাস্তবে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব?

ইমোজেন ফুকস: আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কিংবা অন্য কোনো ধরনের ট্রাইব্যুনাল ছাড়া কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব না। জাতিসংঘের প্যানেল কেবল তদন্ত করতে পারে, বিচার করার এখতিয়ার তাদের নেই। তবে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন যে ধরনের তথ্য-প্রমাণের কথা বলেছে, তাতে মনে হয় কোনো না কোনোভাবে এর বিচার হতেই হবে, সেটা যত বছর পরই হোক না কেন।

জনাথন হেড: অং সান সু চির বিচারের মুখোমুখি হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে যে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ওপর বেসামরিক প্রশাসনের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনার বিষয়টি সরকার জানত- এমন কোনো তথ্য জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আসেনি। সেখানে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা নিপীড়ন থামানোর জন্য অং সান সু চি তার নৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেননি।

ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে, স্বাধীন তদন্তকারীদের ঘটনাস্থলে যেতে বাঁধা দিয়ে এবং সেনাবাহিনীর অন্যায়কে অস্বীকার করার মাধ্যমে সু চির সরকার রাখাইন অঞ্চলে অপরাধ সংগঠনে ভূমিকা রেখেছে বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন।

তবে তারা বলেছেন, বিচারের ক্ষেত্রে মূল মনোযোগ দিতে হবে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের ওপর, কেননা তাদের অপরাধের প্রাথমিক প্রমাণ তদন্তে এসেছে।

জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের ফলে সু চির ওপর সবচেয়ে খারাপ যে প্রভাব পড়তে পারে- তা হল তিনি এখন নিজেকে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পাশে দেখতে পাবেন, কারণ তিনি রাখাইনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্যকেই সমর্থন যুগিয়ে এসেছেন।

রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাব দেওয়ার যে অধিকার সেনাবাহিনীর রয়েছে তাতে সমর্থন দিয়েও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের পথ সু চি খোলা রাখতে পারতেন। তা তিনি করেননি এবং গতবছরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার ভাবমূর্তির বারোটা বেজে গেছে।

ইমোজেন ফুকস: জাতিসংঘ হয়ত আশা করছে, ক্ষমতায় থাকতে হলে কিংবা সত্যিকার অর্থে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হলে সু চিকে যে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে সমর্থন করতে হবে- তা বুঝতে এই প্রতিবেদন হয়ত তাকে সাহায্য করবে। 

গণহত্যা শব্দটি ব্যবহারে এত সতর্কতা কেন?

ইমোজেন ফুকস: আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার সংজ্ঞা খুবই সুনির্দিষ্ট। এটা প্রমাণ করতে হলে দেখাতে হবে যে পুরো একটি গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা সেখানে হয়েছে। বিচ্ছিন্ন সহিংসতা বা কোনো গ্রামে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব ‘গণহত্যা’ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হবে না।   

তবে শীর্ষ পর্যায়ের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থেকে থাকলে সে অনুযায়ী সেনাবাহিনী নির্দিষ্ট কোনো জাতি, ধর্ম বা গোত্রের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালালে, তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার মত ঘটনা ঘটলে তা ‘গণহত্যা’ হিসেবে গণ্য হবে।    

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।