নাজি কারারক্ষীকে জার্মানিতে ফেরত পাঠালো যুক্তরাষ্ট্র

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডে হিটলারের নাজি বাহিনীর যে বন্দিশালায় একদিনে ছয় হাজার ইহুদী নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ক্যাম্পের একজন রক্ষীকে জার্মানিতে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2018, 06:13 PM
Updated : 21 August 2018, 06:13 PM

মঙ্গলবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯৫ বছর বয়সী ইয়াকিভ পালিকে নিয়ে একটি সামরিক বিমান জার্মানির ডুসেলডর্ফ বিমানবন্দরে পৌঁছায়। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বৃদ্ধাশ্রমে।

যুক্তরাষ্ট্র ২০০৪ সাল থেকেই পালিকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। অবশেষে ১৪ বছর পর জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেলের সম্মতি মেলায় তাদের সেই চেষ্টা সফল হল।

পোল্যান্ডে যেখানে পালির জন্ম হয়েছিল, সেই জায়গা এখন ইউক্রেইনের অংশ। তিনি কখনোই জার্মান নাগরিক ছিলেন না। আর জার্মানি, ইউক্রেইন বা পোল্যান্ড পালিকে নিতে আগ্রহী ছিল না। ফলে নিউ ইয়র্কের দীর্ঘদিনের এই বাসিন্দাকে গ্রেপ্তার করেও ফেরত পাঠাতে পারছিল না যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৪৩ সালের ৩ নভেম্বর পোল্যান্ডের ত্রাভনিকি লেবার ক্যাম্পে নিষ্ঠুর সেই গণহত্যা চালায় দখলদার নাজি বাহিনী। পালি ছিলেন ওই ক্যাম্পের একজন রক্ষী।

ওই হত্যাযজ্ঞের ছয় বছরের মাথায়, ১৯৪৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তার আট বছর পর, ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও পান।

হোয়াইট হাউজ বলছে,ওই সময় নাজিদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা গোপন করে পালি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন এই বলে যে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি খামার ও একটি কারখানায় কাজ করেছেন। 

পরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কাছে তিনি স্বীকার করেন যে, জার্মানরা পোলান্ড দখল করার পর ত্রাভনিকি লেবার ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন; সেটা ১৯৪৩ সালের ঘটনা।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ২০০৩ সালে পালির নাগরিকত্ব বাতিল করে। পরের বছর আদালত আদেশ দেয়- পালিকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু ইউরোপীয় কোনো দেশ তখন তাকে নিতে রাজি হয়নি। 

পালির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে হোয়াইট হাউজ বলছে, “নাজিদের প্রতি অনুগত থেকে একজন সশস্ত্র রক্ষী হিসেবে পালি বন্দি ইহুদিদের পালানোর পথ রুদ্ধ করেছিলেন। নাজিদের হাতে ত্রাভনিকি ক্যাম্পের ইহুদি বন্দিদের ওই ভয়ঙ্কর পরিণতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।”

তবে নাজি বর্বরতায় সহযোগী হওয়ার অভিযোগ পালি অস্বীকার করে আসছেন। ২০০৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, ওই ক্যাম্পে কখনও পা রাখেননি। নাজিরা তার পরিবারকে হত্যা করতে পারে- এই ভয়ে শুধু রক্ষী হিসেবে কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন।  

এখন তাকে জার্মানিতে পাঠানো সম্ভব হলেও বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে জার্মান কর্তৃপক্ষ ‘রাষ্ট্রহীন’ পালির বিচারের উদ্যোগ আদৌ নেবে কি না- তা এখনও স্পষ্ট নয়।

জামার্নিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রিচার্ড গ্রেনেল বলেন, “পেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আন্তরিক চেষ্টাতেই পালিকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছে।… আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, জার্মান সরকারের একটি নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে এবং তারা তা স্বীকারও করে।”

রয়টার্স লিখেছে, জার্মানি নাজি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে দ্বৈত নীতি দেখিয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে।

সমালোচকরা বলেন, অনেক উচ্চপদস্থ নাজি সেনা কর্মকর্তাকে তারা বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে রেখেছিল। শুধু মাঝারি ও নিচু পদের নাজিদের বিচার শুরু করা হয়েছিল, তাও কয়েক দশক পরে।

১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে আন্তর্জাতিক একটি সামরিক ট্রাইবুনালে হারমান গোয়েরিং ও রুডলফ হেসের মত শীর্ষ নাজি নেতাদের বিচারের পর জার্মানির দিক থেকে এ বিষয়ে খুব বেশি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

২০০৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৪৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে তদন্তাধীন এক লাখ ৭০ হাজার সন্দেহভাজন নাজি অপরাধীর মধ্যে ৬৬৫৬ জনকে জার্মানির আদালত দোষী সাব্যস্ত করে।

এর আগে ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত নাজি যুদ্ধাপরাধী জন ডেমিয়ানুককে ২০০৯ সালে জার্মানিতে ফেরত পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুই বছর পর মিউনিখের আদালত ডেমিয়ানুককে সোবিবর ডেথ ক্যাম্পে হত্যাযজ্ঞে সহায়তার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। পরের বছর মারা যান ডেমিয়ানুক, তখন তার বয়স ৯২ বছর।

বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এম রাশেদ চৌধুরী এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।

তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করার জোরালো দাবি থাকলেও এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনায় বড় কোনো অগ্রগতি এ পর্যন্ত হয়নি।