নোবেলজয়ী লেখক ভি এস নাইপলের চিরবিদায়

ত্রিনিদাদে জন্মগ্রহণকারী নোবেলজয়ী ব্রিটিশ লেখক ভিএস নাইপল আর নেই; তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2018, 03:34 AM
Updated : 12 August 2018, 03:15 PM

ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই লেখকের হাত দিয়ে বিশ্বের পাঠক পেয়েছে ৩০টির বেশি সাড়া জাগানো বই, যার মধ্যে রয়েছে ‘ইন এ ফ্রি স্টেট’, ‘এ বেন্ড ইন দা রিভার’, ‘এ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ এর মত সাহিত্যকর্ম।

পরিবারের বরাত দিয়ে বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শনিবার লন্ডনে নিজের বাড়িতে চিরবিদায় নেন এই ঔপন্যাসিক।

স্ত্রী নাদিরা নাইপলের বর্ণনায় নাইপল ছিলেন ‘সব অর্জন মিলিয়ে বিরাট এক মানুষ ‘।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, নাইপল যাদের ভালোবাসতেন, যাদের সঙ্গে পার করেছেন অসাধারণ উদ্যমী আর সৃষ্টিশীল এক জীবন, তাদের সান্নিধ্যেই তার শেষ সময়টা কেটেছে।

স্যার বিদ্যাধর সূরজপ্রসাদ নাইপল যে সমকালীন ইংরেজি সাহিত্যের একজন বড় মাপের লেখক ছিলেন- এ নিয়ে সাহিত্য মহলে দ্বিমত নেই। গল্প বলিয়ে হিসেবে তার অনবদ্য দক্ষতা নিয়েও কারও প্রশ্ন নেই।

কিন্তু লেখনির জন্য জীবনভর তিনি যতটা প্রশংসিত হয়েছেন, ঠিক ততটাই নিন্দিত হয়েছেন ভারত, ইসলাম, উন্নয়নশীল বিশ্ব আর নারীদের নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমসাময়িক লেখকদের সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে।

ভক্তদের কাছে নাইপলের উপন্যাসগুলো হল রুক্ষ নির্দয় গদ্যে মনুষ্য জীবনের গ্লানি আর দুর্দশাকে বর্ণনা করার অসাধারণ নমুনা। আর তার ভ্রমণ বৃত্তান্তগুলো ভয় জাগানিয়া সত্য বর্ণনার উদাহরণ- যেখানে তিনি তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যকে আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপনের কোনো চেষ্টা করেননি।  

আর সমালোচকদের মতে, নাইপলের লেখা ভ্রান্তি আর বিদ্বেষে পূর্ণ, কখনও কখনও সেখানে মিশেছে গোঁড়ামী। সহিত্যকর্মের অসাধারণত্ব স্বীকার করে নিয়েই তারা নাইপলকে বর্ণনা করেছেন নিজের স্টেরিওটাইপে আটকে পড়া এক বুড়ো হিসেবে, যিনি নিজের ফেলে আসা জায়গাকে গালমন্দ করছেন সারাক্ষণ।  

অবশ্য সমালোচনাকে পাত্তা দেওয়ার মানুষ নাইপল ছিলেন না। অন্যের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টির ক্ষমতা যে তার মজ্জাগত, তাও তিনি জানতেন। বলতেন, এই গুণটি না থাকলে একজন আসলে মৃত।

১৯৭১ সালে ‘ইন এ ফ্রি স্টেট’ উপন্যাসের জন্য বুকার পান নাইপল। আর ২০০১ সালে পান সাহিত্যের নোবেল। ১৯৯০ সালে তাকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়। 

নোবেল কমিটির প্রশংসাপত্রে নাইপলকে বর্ণনা করা হয় জোসেফ কনরাডের উত্তরসূরি হিসেবে।

বিদ্যাধর সূরজপ্রসাদ নাইপলের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ক্যারিবিয়ার দ্বীপ ত্রিনিদাদে। তার দাদা আখের খামারের শ্রমিক হিসেবে আরও অনেক ভারতীয়র মত ত্রিনিদাদে পাড়ি জামিয়েছিলেন। আর বাবা ছিলেন লেখক, সাংবাদিক। পরে নাইপলও তাই হয়েছেন।

১৯৫০ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তিতে নাইপল ইংরেজি সাহিত্য পড়তে যান অক্সফোর্ডে। এরপর সেখানেই থেকে গিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বময়। কিন্তু কোথাও নিজেকে খুঁজে নিতে পারেননি। নিজেই নিজেকে বর্ণনা করেছেন একজন শেকড়হীন মানুষ হিসেবে। বলেছেন, তিনি তার লেখাগুলোর সমষ্টিমাত্র।

নাইপল যেখানে গেছেন, সেখান থেকেই তুলে এনেছেন লেখার উপাদান। নির্মম গদ্যে উপহার দিয়েছেন একের পর এক উপন্যাস অথবা ভ্রমণ বৃত্তান্ত। ভারত, আফ্রিকা বা ত্রিনিদাদে তিনি কখনও ভালো কিছু দেখেননি। তার চাঁছাছোলা ভাষার কর্কশ বর্ণনায় তৃতীয় বিশ্ব চিত্রিত হয়েছে বিভৎস ভূখণ্ড হিসেবে।  

২০১৬ সালে ঢাকা লিট ফেস্টের উদ্বোধনেও এসেছিলেন নাইপল। বলেছিলেন, “আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কি লিখবো তার কিছু্ই জানতাম না। কিন্তু লিখবো, এটা জানতাম। আমি বুঝতে পারলাম যে এজন্য আমাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব বিব্রতকর ছিল। আসলে লেখাঝোঁকা পাগলামি ছাড়া আর কিছু্ই না।”

দেশের মত নারীরাও নাইপলকে কখনও ধরে রাখতে পারেননি। নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই ভক্তদের ধাক্কা দিয়েছে।

অক্সফোর্ডে পড়ার সময় ইংরেজ মেয়ে প্যাট্রিসিয়া হেইলের সঙ্গে ভিদিয়া নাইপলের প্রেম, পরে বিয়ে। কাজের অভাবে নাইপল যখন দুর্দশার প্যাট্রিসিয়াই তার খরচ জুগিয়েছেন। কিন্তু এক সময় তাকে উপেক্ষা করেই অ্যাংলো-আর্জেন্টাইন মার্গারেট গুডিংকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন বিভিন্ন দেশে।

সেই মার্গারেটকেও নাইপল ত্যাগ করেছিলেন, কারণ তার ‘বয়স হয়ে গিয়েছিল’। প্যাট্রিসিয়া ক্যান্সারে মারা গেলে শেষকৃত্যের পরদিনই নাইপল ঘরে আনেন দ্বিতীয় স্ত্রী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক নাদিরা খানুম আলভিকে।

২০০১ সালে এক সাক্ষাৎকারে নাইপল বলেছিলেন, এক প্যারা পড়েই তিনি বলে দিতে পারেন, লেখক পুরুষ না নারী। তার ওই মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন নারীবাদীরা।

নাইপলের মৃত্যুর পর অনেকেই শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন, সাহিত্যের বিশ্ব কত বড় মাপের একজন লেখককে হারালো, সে কথা বলেছেন। 

সালমান রুশদি এক টুইটে লিখেছেন, “রাজনীতি বা সাহিত্য নিয়ে সারাজীবনে কখনোই আমরা একমত হতে পারিনি। আজ মনে হচ্ছে,আমার প্রিয় বড় ভাইকে আমি হারালাম। শান্তিতে থেকো ভিদিয়া।”