পুতিনের সঙ্গে বৈঠক শুভ সূচনা: ট্রাম্প

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দুই ঘণ্টার মুখোমুখি বৈঠক শেষে একে ‘শুভ সূচনা’ বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2018, 04:39 AM
Updated : 17 July 2018, 09:28 AM

পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ভোজনের শুরুতে শীর্ষ কর্মকর্তা পরিবেষ্টিত একটি কনফারেন্স টেবিলে সাংবাদিকদের সামনে ট্রাম্প ওই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “এ এক শুভ সূচনা। প্রত্যেকের জন্যই একটি শুভ সূচনা।” আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ এবং ভালোভাবে শেষ হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ট্রাম্প।

ওদিকে, পুতিন বলেন, “অনেক সমস্যাই রয়ে গেছে। আমরা সব বাধা দূর করতে পারিনি... কিন্তু আমি মনে করি এ পথে আমরা প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পেরেছি।”

ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা ‘খোলাখুলি’ এবং ‘গঠনমূলক’ হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন তিনি।

ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে সোমবার প্রথমবারের মত মুখোমুখি বৈঠকে বসেন বিশ্বের প্রভাবশালী এ দুই নেতা। বৈঠক শুরু হয় পূর্ব নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ পর। তাদের এ বৈঠকে কেবল দোভাষীরাই উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শুরুর আগে পুতিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই সফলভাবে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের জন্য তাকে অভিনন্দন জানান ট্রাম্প। এটি সেরা আয়োজনগুলোর অন্যতম ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এরপর ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পুতিনের পাশে বসে ঊষ্ণ বক্তব্য দিয়ে বৈঠক শুরু করেন ট্রাম্প। আর তখনই রাশিয়ার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনেক দিন থেকেই তিনি দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছেন।

ট্রাম্প বলেন, “আমি মনে করি আমরা একটি অসাধারণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব। আমি সেটিই আশা করি। আমি একথাই বলে আসছি। আমি নিশ্চিত যে আপনারাও কয়েকবছর ধরে একথা শুনে এসেছেন। আমি প্রচার চালিয়ে বলেছি, রাশিয়ার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ভাল ব্যাপার, খারাপ কিছু না।”

অন্যদিকে পুতিন বলেন, “বিশিষ্ট প্রেসিডেন্ট, ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে আমি আনন্দিত। যদিও আমাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ আছে...আমরা ফোনে কথা বলেছিএবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে আমাদের বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।

“তবে অবশ্যই নিজেদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার এবং বিশ্বের সমস্যাপূর্ণ অনেকগুলো এলাকা নিয়ে আলোচনার এটাই সময়।”

২০১৪ সালে ইউক্রেইনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ মস্কোর দখল করে নেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়লাভে ক্রেমলিনের সহায়তার অভিযোগ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে।

এ পরিস্থিতিতে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র নতুন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে দুই দেশের নেতা দীর্ঘপ্রতিক্ষীত এ বৈঠক করলেন। ক্রেমলিনও এ বৈঠককে মস্কো এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের পথে প্রথম ধাপ হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছে।

ট্রাম্প বলেছেন, আজকের বৈঠক রাশিয়ার সঙ্গে বলিষ্ঠ আলোচনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করেছে। ভবিষ্যতে দু’দেশ এরকম আরো আলোচনায় বসবে বলে ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেন।

বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে:

সিরিয়া থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়টিসহ কোরিয়া উপদ্বীপ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়েও বৈঠকে কথা হয়েছে। আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে ১২ রুশ অভিযুক্ত হওয়ার বিষয়টিও।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে ট্রাম্প কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন পুতিন। তবে ওই নির্বাচনে রাশিয়ার হাত থাকার কথা পুতিন জোরালভাবেই নাকচ করেছেন বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।

বৈঠকে দু’নেতার মধ্যেই ঐক্য দেখা গেছে। মস্কো এবং ওয়াশিংটন উভয়ে মিলেই নির্বাচনী প্রচারে রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হ্যাকিংয়ের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পারেন এমন আভাসও দিয়েছেন তারা।

পুতিন বলেছেন, “স্নায়ুযুদ্ধের যুগ শেষ হয়েছে। এখন আমেরিকা এবং রাশিয়ার একসঙ্গে মিলে সব সমস্যা সমাধান করা উচিত।”

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘তথ্য হাতানোয়’ অভিযুক্ত ১২ রুশের বিষয়ে পুতিন বলেন তাদেরকে হস্তান্তরের বিষয়টি দেখবেন তিনি।

এ বিষয়ে পারষ্পরিক আইনি সহায়তা বিষয়ক ১৯৯৯ সালের একটি চুক্তি অনুযায়ী কাজ করার পরামর্শ দিয়ে পুতিন বলেন, এর আওতায় মার্কিন কর্মকর্তারা রুশ কর্তৃপক্ষকে ১২ অভিযুক্তকে জেরা করার অনুরোধ জানাতে পারে। সেক্ষেত্রে জেরার সময় মার্কিন কর্মকর্তাদেরকে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের প্রচার শিবিরের কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের ঘটনায় ১২ রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন বিচার বিভাগ অভিযোগ আনার পর ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের এ বৈঠক হল। অনেক মার্কিন রাজনীতিবিদই ওই হ্যাকিংয়ের ঘটনার কারণে পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকে আপত্তি জানিয়েছিলেন।

কিন্তু ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জন্য তার পূর্বসূরিদের বোকামিকে দায়ী করার পাশাপাশি বর্তমানে নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ এবং হ্যাকিংয়ের অভিযোগের বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক উইচ-হান্ট’ আখ্যা দিয়ে ওই আপত্তি অগ্রাহ্য করে বৈঠক করলেন।

বৈঠকে পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে দু'নেতা ভারসাম্য বজায় রাখা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে একমত হন।

পুতিন বলেন, “বৃহত্তর পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ দায়িত্ব আছে। আর তাই আমি মনে করি এটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং এটি নিয়ে সংলাপ আয়োজনের জন্য আমরা আলোচনা করেছি।”

তাছাড়া, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধেও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। রাশিয়ার এ প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করেছেন তিনি।

ওদিকে, কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা কমিয়ে আনার জন্য ট্রাম্পই কৃতিত্বের দাবিদার বলে তার পাল্টা প্রশংসা করেছেন পুতিনও।

ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ঠেকানোর প্রশ্নে দু’নেতা একে অপরের দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে অবাধ যোগাযোগ রক্ষা করতে রাজি হয়েছেন।

সিরিয়া যুদ্ধে হাজারো নিরীহ প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার আরো সহযোগিতা কামনা করেছেন ট্রাম্প। সংঘর্ষ এবং বৈরিতার চেয়ে কূটনীতি এবং আলোচনার পথই বেছে নেওয়া ভাল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে (আইএস) লড়াইয়ে ইরানকে তারা কোনোভাবেই উপকৃত হতে দেবেন না বলে জানান ট্রাম্প।

ক্রিমিয়া উপদ্বীপ প্রসঙ্গে পুতিন বলেন, “এ বিষয়টিকে ট্রাম্প বলেন অবৈধ। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। ফলে এ বিষয়ে আর প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই।”

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের পর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া:

বৈঠকে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়াকে জবাবদিহি করতে ব্যর্থতার জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে রজনীতিকরা।

ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের অনেক সদস্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সমালোচনা করেছেন। 

অ্যারিজোনার রিপাবলিকান সিনেটর জেফ ফ্লেক এক টুইটে প্রেসিডেন্টের বৈঠককে ‘লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার আগ্রসনের জন্য নিজের দেশকেই দোষারোপ করবে এমন দিন কখনো দেখতে হবে চিন্তাও করেননি বলে জানান ফ্লেক।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার পল রায়ান বলেন, রাশিয়া যে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে তা প্রশ্নাতীত। কারণ, এ নিয়ে গোয়েন্দা তথ্য আছে এবং কংগ্রেসের ভিন্ন দুটি কমিটি তদন্ত করছে।

সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, ট্রাম্প এবারের বৈঠকে ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্য রাশিয়াকে কড়া জবাবদিহি করানোর সুযোগ হাতছাড়া করলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক পরিচালক আরো কড়া ভাষায় সমালোচনা করে এক টুইটে বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট যা করলেন তা দেশদ্রোহের চেয়ে কম কিছু না।”

নেব্রোস্কার সিনেটর বেন সেসে এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জন্য ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করাটা “খুবই উদ্ভট এবং ভুল কথা।”

অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটিক দলের সিনেটররাও ট্রাম্পের বৈঠককে খুবই বিরক্তিকর, লজ্জাজনক, মানহানিকর, বিব্রতকর এবং আমেরিকার জন্য দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেছেন।