অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক আগে থেকেই এ কাজে জড়িয়ে থাকলেও সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকার অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণের পর রীতিমত ফুলে ফেঁপে উঠেছে এ ব্যবসা।
‘সাউথওয়েস্ট কি’ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তাদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র এবং ফেডারেল কাস্টডিতে থাকা অভিবাসী শিশুদের বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ৯৫৫ মিলিয় ডলারের কাজ পেয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির এমন একটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে দক্ষিণ টেক্সাসে। সেখানে ওয়ালমার্টের পুরনো একটি সুপারস্টোরে গড়ে তোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রটি। অভিবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্রের গড়ে তোলার নামে গজিয়ে ওঠা ওঠা লোভনীয় আর গোপন ব্যবসায় শুধু সাউথওয়েস্ট কি’ই নয়, অন্তত ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান শুধু টেক্সাসেই খুলে বসেছে ৩০টিরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র। দেশটির অন্য ১৬টি রাজ্যেও আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের শখানেক এমন স্থাপনা রয়েছে।
দক্ষিণ টেক্সাসের রিও গ্রান্ডে ভ্যালিতে যেভাবে অভিবাসী আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তাতে জায়গাটিকে আশ্রয়কেন্দ্রের ঘাঁটিই বলা যায়। সেখানে পুরনো দোকান, স্কুল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও গড়ে তোলা হয়েছে এসব আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বড় ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও এগুলোর ভেতরের খবর জানে না কেউ।
অবৈধ অভিবাসী পরিবারগুলোকে আটক রাখতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত বুধবারের ঘোষণা মূলত বেসরকারি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ কোম্পানি এবং প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের আরও লাখ লাখ ডলারের কাজ পাওয়ার দ্বার খুলে দিয়েছে।
টেক্সাস এবং পেনসিলভানিয়ায় অবশ্য বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে এমন ‘ফ্যামিলি ডিটেনশন সেন্টার’ এরই মধ্যে পরিচালনা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্টের নির্দেশনার আলোকে এসব ‘বেসরকারি কারাগারে’ সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে, প্রযোজন আইনি ভিত্তিও।
শুধু অলাভজনক প্রতিষ্ঠানই নয়, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও অভিবাসী আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছে।
অভিভাবক কিংবা পরিবারের কোনো সদস্য ছাড়া যেসব অভিবাসী তরুণ আমেরকায় আসে তাদের নিয়ে কাজ করে বিসিএফসি নামের একটি বৈশ্বিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের তথাকথিত ‘অভিভাবকহীন শিশু কর্মসূচির’ আওতায় ২০১৫ সাল থেকে ১৭৯ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ক্যাথলিক চ্যারিটিজের মতো ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও রয়েছে রয়েছে এই কর্মকাণ্ডে।
কিন্তু প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিরাপত্তা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানও এসেছে এই ব্যবসায়। এদের মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি জেনারেল ডাইনামিক্স এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইরাকে নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহ করা এমভিএম ইনকরপোরেটেড।
মূলত গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপশ্চিম সীমান্ত এলাকায় অভিবাসী পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে বড় আকারে অভিযান শুরুর পর থেকেই অভিবাসী-আশ্রয়ের ব্যবসা জমে উঠতে শুরু করে।
অবশ্য, আরও আগে থেকেই, এমনকি ওবামা প্রশাসনের সময়েও বাবা-মা ছাড়া অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা শিশু-কিশোরদের আশ্রয় দেওয়ার কাজটি করছে ঠিকাদাররা। সরকারের নতুন নীতির পর এর পালে হাওয়া লেগেছে। অভিবাসী পরিবারগুলো থেকে শিশুদের আলাদা করার হার বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে।
সাউথওয়েস্ট কি’র প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী হুয়ান সানচেজ অনেক বছর ধরেই দক্ষিণ টেক্সারের রাজনীতিতে পরিচিত মুখ। অনুপ্রবেশকারীদের থাকা-খাওয়া এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে তারা নিজেদের ভালো ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করে। কিন্তু বাবা-মার কাছ থেকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করা শিশুদের সংখ্যা যেভাবে খদ্দেরদের তালিকা বড় করছে, তাতে জনগণের কাছে তাদের সুনাম ক্ষুন্নই হয়েছে।
সমালোচকরা সানচেজের করের নথিপত্রও প্রকাশ করে দিয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে তাকে ৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে। নতুন নতুন আশ্রয়কেন্দ্র খোলা নিয়েও তার প্রতিষ্ঠান মানুষের তোপের মুখে রয়েছে। হিউস্টোনে আশ্রয়হীনদের একটি পুরনো স্থাপনাকে অভিবাসী তরুণদের আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরে সানচেজের পরিকল্পনা বাতিল করতে তার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মেয়র সিলভেস্টার টার্নারসহ ডেমোক্রেট কর্মকর্তারা। বিষয়টি তারা রাজ্য প্রশাসনের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন।
অনেকেই বলছেন, আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবসা বাড়তে থাকায় অভিবাসীদের আবাসন এবং শিশু-কিশোরদের ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসী তরুণদের বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে নানা ধরনের সমস্যাও দেখা দিয়েছে। অগ্নি দুর্ঘটনা, নির্যাতন, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বিনা কারণে ছাটাই এবং বতেন বকেয়া রাখার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
তবে এতকিছুর পরও আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তা, তাদের সমর্থক, এমনকি কেন্দ্রের কর্মকর্তারা অশ্রয়কেন্দ্রের এই ঠিকাদারী ব্যবস্থার পক্ষ নিয়েছেন।
সাউথওয়েস্ট কি’র অভিবাসী শিশু সেবা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালেক্সিয়া রদ্রিগুয়েজ বলেন, “সীমান্ত পেরিয়ে আসা শিশুদের সঙ্গে সরাসরি আদাদের দায়িত্ব জড়িয়ে আছে।”
নিজেদের আশ্রয়কেন্দ্রলোকে মানসম্পন্ন বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতিবছর যে বিপুল সংখ্যক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযো্গ ওঠে, তার অধিকাংশই তাদের নিজেদের কর্মকর্তা তদন্ত করেন, তারাই প্রতিবেদন দেন। এ প্রসঙ্গে রদ্রিগুয়েজের ভাষ্য, তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হয়।
গত তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল দশ হাজার। এর মধ্যে থেকে ১৫০টি ঘাটতি চিহ্নিত করা হয়েছে।
© 2018 New York Times News Service