৭ এপ্রিল আসাদবাহিনী দৌমায় ক্লোরিন গ্যাস হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ পশ্চিমা শক্তিগুলোর; যার শাস্তি হিসেবে সপ্তাহখানেক পর দামেস্ক ও হোমসের তিনটি স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসী বিমান।
পশ্চিমা শক্তিগুলোর এ হামলা সিরিয়ায় চলা বহুপক্ষীয় যুদ্ধের গতিপথ একটুও বদলায়নি বলে মন্তব্য রয়টার্সের, যতখানি বদলেছে দৌমায় সরকারি বাহিনীর সন্দেভাজন রাসায়নিক হামলায়।
বছরখানেক ধরে আসাদ সমর্থক বাহিনীর ধারাবাহিক আক্রমণের পরও দামেস্কের কাছের এ শহরটি দাঁড়িয়ে ছিল বিদ্রোহীদের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে; সন্দেহভাজন ওই গ্যাস হামলার কয়েক ঘণ্টা মধ্যেই ওই অবস্থার বদল ঘটে।
অবরুদ্ধ অধিবাসীদের চাপ এবং একই ধরনের আরও হামলার হুমকির মুখে জইশ আল ইসলাম দৌমা ছেড়ে তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার দিকে চলে যেতে রাজি হয় বলে দাবি করেছেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির শীর্ষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলৌশের।
সপ্তাহখানেক পর পশ্চিমারা যখন হামলা চালাচ্ছে, গৌতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসাদ তখন সিরিয়ায় নিজের ক্ষমতা আরো সংহত করেছেন।
শনিবার প্রথম প্রহরে চালানো পশ্চিমা সামরিক হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে রাশিয়া ও সিরিয়া; দৌমায় কোনো ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কথাও অস্বীকার করছে তারা।
মস্কো বলছে, যুক্তরাজ্যের সহযোগিতায় এ মিথ্য নাটক সাজানো হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের দাবি, গোয়েন্দা তথ্য এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দৌমায় রাসায়নিক হামলার পেছনে যে সিরীয় সরকারের হাত ছিল তার ইঙ্গিত মিলেছে।
যাই ঘটুক না কেন, কথিত ওই হামলার দিনটির পর গৌতার যুদ্ধক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।
উত্তরের পুরোটা, পূর্বের বেশিরভাগ অংশ এবং দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের কিয়দংশে, যেখানে বিদেশি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র তৎপর, এখনো প্রেসিডেন্ট আসাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু রাজধানীর আশপাশে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাত বছরের গৃহযুদ্ধ জয়ের অনেক কাছে চলে এসেছেন দেড় যুগ ধরে সিরিয়ার ক্ষমতায় থাকা আসাদ।
গত মাসে পূর্ব গৌতার পতনের পর দৌমাই ছিল সরকারিবাহিনীর প্রধান আক্রমণস্থল; সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী জইশ আল ইসলামের সদস্যরা বাসে চেপে তুর্কি সীমান্তের দিকে চলে যাওয়ায় আসাদকে আর কাছাকাছি এলাকা থেকে বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে না।
রুশ বাহিনীর নির্দেশনাতেই সিরীয়রা গৌতায় সর্বাত্মক অভিযান চালায় বলে সরকার সমর্থক জোটের এক আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডার রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছেন। ওই অভিযানে অন্তত এক হাজার ৭০০ মানুষ নিহত হয়েছে বলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে।
প্রতিপক্ষ বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব এবং ধারাবাহিক বোমা বর্ষণে বিপর্যস্ত আসাদবিরোধী গোষ্ঠীর সদস্যরা বাধ্য হয়ে তুর্কি সীমান্তের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলে যেতে রাজি হয়।
দৌমার শক্তিশালী রক্ষণব্যুহের কারণে ‘অন্যদের মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হবে না’ বলে মনে করেছিল জইশ আল ইসলাম। শহরটি ঘিরে সরকারি বাহিনীর একের পর আক্রমণেও তাদের পর্যদুস্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না।
আলৌশ বলছেন, যুদ্ধের সময় দৌমায় বানানো অস্ত্র কারখানার কারণেই তখন তারা আসাদ সমর্থকদের যুদ্ধাস্ত্রের ভালোই জবাব দিচ্ছিলেন। অধিবাসীদের বছরখানেকের খাদ্যও মজুদ ছিল।
“রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে, একের পর এক বোমাবর্ষণ করে, চিরাচরিত অস্ত্র দিয়েও সিরীয় বাহিনী আমাদের হারাতে পারছিল না। সে কারণেই তারা বিকল্প হিসেবে রাসায়নিক হামলার পথ বেছে নেয়,” বলেন তিনি।
রাসায়নিক হামলার চালানোর দুদিন আগেও রুশদের সঙ্গে জইশ আল ইসলামের শীর্ষ নেতৃত্বের দরকষাকষি চলছিল বলে জানান এ বিদ্রোহী নেতা।
ওই নেতারা রাজনৈতিক দল হিসেবে জইশ আল ইসলামের আত্মপ্রকাশ, দৌমায় রুশ পুলিশ প্রবেশের সুযোগ দেওয়া, সিরীয় বাহিনীকে বাদ দিয়ে জইশ আল ইসলামের সদস্যদের হাতে শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রুশ মধ্যস্থতাকারীরা সেসময় জইশ আল ইসলামের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করারও আশ্বাস দিয়েছিলেন।
তবে হামলার পরদিনই তাদের রূপ বদলে যায় বলে অভিযোগ করেছেন আলৌশ।
“হুমকি আসে, ‘কি হয়েছে দেখেছ তোমরা, এটা ইশারা, এরপরও থাকতে চাইলে আরও হামলা হবে এবং কেউই এ শহর ছেড়ে বের হতে পারবে না’,” বলেন আলৌশ।
তার এ মন্তব্যের বিষয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাইলেও জবাব মেলেনি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
জইশ আল ইসলামের নেতারা তখন বেসামরিক নেতাদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। একের পর এক মৃত্যু দেখে হতচকিত বেসামরিক নেতারা তখন বিদ্রোহীদের শহরটি ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ জানান।
“তারা বলে, আমরা বেশিদিন আর এ শহর ধরে রাখতে পারবো না। যদি তোমরা না যাও, তাহলে আমরা আসাদবাহিনীর কাছে চলে যাবো,” অধিবাসীদের মনোভাব তুলে ধরে বলেন আলৌশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আসাদ সমর্থক বাহিনীর এক কমান্ডার জানান, জইশ আল ইসলাম শহরটি ছাড়তে রাজি না হয়ে নানান ‘অগ্রহণযোগ্য দাবি’ তুলতে থাকলে ৬ এপ্রিল থেকে তারা শহরটিতে সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। বিদ্রোহীদের প্রস্তাবে রুশ কমান্ডাররা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন বলেও দাবি তার।
“রাশিয়ানরা তাদের ওপর খুবই ক্ষেপে গিয়েছিল। এ ধরনের ‘অসম্ভব শর্ত কেন’, তাদেরকে তাও জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল,” বলেন ওই আসাদপন্থি সামরিক কর্মকর্তা।
সিরীয়বাহিনীর অবস্থানও ছিল পরিস্কার, বিদ্রোহীদের দৌমা ছেড়ে তুর্কি সীমান্তবর্তী জারাব্লুসে চলে যেতে হবে।
যদিও বিদ্রোহীরা বলছেন, রুশ মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছিল দৌমায় থাকার বিষয়ে, ছেড়ে যেতে নয়।
আলৌশ জানান, রাসায়নিক হামলার আগের দিনের বোমাবর্ষণে ডজনের ওপর ব্যক্তির মৃত্যুও শহরটির অধিবাসীদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল।
“এটা ছিল ভিন্ন, রাসায়নিক হামলা তাদেরকে আরও সন্ত্রস্ত করেছিল,” দাবি তার।
সন্দেহভাজন ওই হামলায় অর্ধশতাধিক বেসামরিক নিহতের দাবি জানিয়ে আসছে পশ্চিমা বিভিন্ন সংগঠন। সেখানে কর্মরত সংস্থাগুলোর কর্মীদের সরবরাহ করা এক ভিডিওতে মেঝেতে পড়ে থাকা ডজনের ওপর নারী, পুরুষ ও শিশুর লাশ দেখা যায়, যাদের অনেকের মুখে ছিল ফেনা।
হামলার কয়েক ঘণ্টা পর জইশ আল ইসলামের মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে ফের বৈঠক হয় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের, জানান আলৌশ। ওই বৈঠকেই শহরটি ছেড়ে চলে যেতে চূড়ান্ত হুমকি দেওয়া হয়।
দৌমার বাসিন্দাদের সুরক্ষা দিতে জইশ আল ইসলাম তার সদস্যদের শহরটিতে থাকতে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও তা খারিজ হয়ে যায়।
রাসায়নিক হামলার পর বিভিন্ন স্থাপনা এবং হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যারেল বোমা ফেলা হয় বলেও দাবি করেন আলৌশ, যার কারণে অসুস্থদের চিকিৎসা দেওয়ার উপায়ও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। এরপরই শহরটি ছেড়ে যেতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে জইশ আল ইসলাম।