সিরিয়ায় ফের হামলা হলে বৈশ্বিক গোলযোগ তৈরি হবে: পুতিন

সিরিয়ায় ফের পশ্চিমারা হামলা চালালে বৈশ্বিক গোলযোগ তৈরি হবে বলে সতর্ক করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

>>রয়টার্স
Published : 15 April 2018, 07:19 PM
Updated : 15 April 2018, 07:31 PM

বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে নিজের নাগরিকদের ওপর রাসায়নিক হামলার অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরদিন রোববার ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে টেলিফোন আলাপে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।

ক্রেমলিনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, পশ্চিমাদের এই হামলা সিরিয়ায় গত সাত বছর ধরে চলমান গৃহযুদ্ধের অবসানে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে পুতিন ও রুহানি একমত হয়েছেন।  

“ভ্লাদিমির পুতিন বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন যে, জাতিসংঘ সনদের লংঘন করে এই ধরনের পদক্ষেপ যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অবশ্যই তা আন্তর্জাতিক পরিসরে গোলযোগ তৈরি করবে।”

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

ওয়াশিংটন বলছে, এক সপ্তাহ আগে দৌমায় রাসায়নিক হামলার জবাবে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচির প্রাণ কেন্দ্রে এই হামলা চালানো হয়েছে। হামলায় অংশ নেওয়া তিন দেশই দাবি করেছে, তাদের এই হামলার পেছনে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত বা দেশটির গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিপ্রায় তাদের ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সফল হয়েছে বলে প্রশংসা করলেও আগ্রাসন আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়েছে দামেস্ক ও তার মিত্ররা। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ এই হামলাকে বলেছেন ‘অগ্রহণযোগ্য ও বেআইনি’।

তবে রোববার পুতিনের এই সতর্ক বার্তা আসার কিছুক্ষণ আগেই রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই রিবাকোভ বলেছেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন সব প্রচেষ্টা নেবে মস্কো।

পশ্চিমা দেশগুলো জাতিসংঘে যে প্রস্তাবে তুলছে তার সঙ্গে রাশিয়া কাজ করবে কি না সে প্রশ্নের জবাবে তিনি তাস বার্তা সংস্থাকে বলেন, “এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি খবুই উত্তেজনাপূর্ণ, পরিবেশ খুবই উত্তপ্ত। তাই আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না।

“বর্তমানের অশান্ত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সব সুযোগ ব্যবহার করে আমরা শান্তভাবে ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করব।”

এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ভ্লাদিমির এরমাকোভ বলেছেন, ওই হামলার পর কৌশলগত স্থিতিশীলতা নিয়ে মস্কোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছে ওয়াশিংটন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

এদিকে দামেস্কে রাসায়নিক অস্ত্র নিরোধ আন্তর্জাতিক সংস্থা-ওপিসিডব্লিউর পরিদর্শকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সিরিয়ার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মেকদাদ। রাশিয়া ও সিরিয়ার জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তিন ঘণ্টার ওই বৈঠক হয়।

আগামী ৭ এপ্রিল দৌমায় সন্দেহভাজন গ্যাস হামলাস্থল পরিদর্শন করার কথা ছিল ওপিসিডব্লিউর পরিদর্শকদের। সে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে রাসায়নিক হামলার অভিযোগ তুলে সিরিয়ায় পশ্চিমাদের এই হামলার কঠোর সমালোচনা করছে মস্কো।

রাশিয়াবিরোধী প্রচার

সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে দৌমায় রাসায়নিক হামলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে মস্কো বলছে, রাশিয়াবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিতে এই নাটক সাজিয়েছে যুক্তরাজ্য।

তবে পশ্চিমারা উত্তেজনা না বাড়িয়ে কমানোর পক্ষে বলে ইঙ্গিত এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন উভয়ই বলেছে, শনিবারের তাদের এই সামরিক পদক্ষেপের লক্ষ্য বাশার আল-আসাদ নয়, শুধু তার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ওপর।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন

ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বিবিসিকে বলেছেন, পশ্চিমা শক্তিগুলোর আরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরিকল্পনা নেই, তবে দামেস্ক ফের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করলে করণীয় নিয়ে ভাববে তারা।

“এটা সরকারের পরিবর্তনের জন্য নয়…এটা সিরিয়ায় সংঘাতের ধারা পরিবর্তনের চেষ্টা নয়।”

সিরিয়ায় সংঘাত নিরসনে সমঝোতার জন্য আসাদকে চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা একমাত্র রাশিয়ার আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হেলি বলেন, সম্পর্ক ‘খুবই নাজুক’। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও সম্পর্কোন্নয়নের আশা করছে।

হেলি বলেন, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে না যুক্তরাষ্ট্র। রোববার ফক্স নিউজকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি লক্ষ্য রয়েছে-কোনোভাবে যেন রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার না হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে; ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত এবং ইরানের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি।

জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে অভিযানে সহযোগিতার লক্ষ্যে সিরিয়ায় প্রায় দুই হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যাদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধে সিরিয়ায় হামলা নিয়ে স্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরমি করবিন।

বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি, আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, এই আইনি বৈধতা কোথায়?”

‘অদম্য’

দামেস্কে সফররত একদল রুশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বলেছেন, পশ্চিমাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা একটি আগ্রাসনমূলক পদক্ষেপ।

বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি গবেষণাগারের ধ্বংসস্তূপের ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছে সিরিয়া। আবার ‘অদম্য সকাল’ ক্যাপশন দিয়ে আসাদের অন্যদিনের মতো অফিসে যাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেছে তারা। হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতেরও কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

রুশ পার্লামেন্ট সদস্যদের উদ্ধৃত করে দেশটির বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, বাশার আল-আসাদ ‘ফুরফুরে মেজাজে’ আছেন। পশ্চিমাদের হামলা প্রতিহতে ব্যবহৃত সোভিয়েত আমলের এয়ার ডিফেন্সের কার্যকারিতার প্রশংসা করেছেন তিনি। রাশিয়া সফরের আমন্ত্রণও গ্রহণ করেছেন।

বিদ্রোহীদে বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সিরীয় সৈন্যদের উৎসাহ দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ (ছবি: সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের টুইটার পাতা)

হামলার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটে ‘মিশন অ্যাকোমপলিশড’ লিখে প্রশংসা করলেও পেন্টাগনে ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি সিরিয়া সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সিরিয়া আবারও রাসায়নিক হামলা চালাতে সক্ষম হবে না সে রকম নিশ্চয়তাও দিতে পারেননি তিনি।

সিরিয়ায় এই গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল কথিত আরব বসন্তের উত্তাল সময়ে, এরপর সাত বছর ধরে দেশটিতে বহুপক্ষের অংশগ্রহণে গৃহযুদ্ধ চলছে। এরমধ্যে বিদ্রোহীদের দেওয়া পশ্চিমাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। ওই জঙ্গিদের দমনে ইরাক ও সিরিয়ায় সামরিক পরামর্শক হিসেবে সৈন্য পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

এরপর সিরিয়ায় জঙ্গিদের লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিমান হামলার পাশাপাশি বাশার আল-আসাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয় রাশিয়া। এক পর্যায়ে রাশিয়ার বিমান হামলা বন্ধ হলেও সিরীয় বাহিনীর সঙ্গে রুশ সৈন্য ও ইরানি সেনারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। দুই দেশের সহযোগিতায় বিদ্রোহীদের হটিয়ে একের পর এক এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় আসাদ বাহিনী।

বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ এলাকা দৌমায় অভিযানের মধ্যে গত সপ্তাহে রাসায়নিক হামলায় ৪০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তার জন্য বাশার সরকারকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হামলায় নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর এই সংঘাত।