স্টিভেন হকিংয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

স্টিভেন হকিংকে বিশ্বের মানুষ কীভাবে মনে রাখবে? 

মীর মোশাররফ হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2018, 04:59 PM
Updated : 15 March 2018, 06:25 AM

তার নাম শুনলেই চোখে ভাসবে মোটরচালিত হুইলচেয়ারে বসা ভগ্নস্বাস্থ্যের এক লোকের ছবি, যার মাথা এক দিকে কাত হয়ে আছে। আর হুইলচেয়ারের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার চেষ্টায় দুই হাত লম্বা করে রাখা আছে হাঁটুর কাছাকাছি।

কিন্তু তিনিই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার সময়ের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে সম্মানিত, সবচেয়ে মেধাবী বিজ্ঞানীদের একজন হিসেবে, যিনি মোটর নিউরন নামের এক দুরারোগ্য ব্যধির কারণে তারুণ্যে চলৎশক্তি হারিয়েও ৭৬ বছর বয়স পর্যন্ত নিজেকে নিয়োজিত রাখেন বিজ্ঞানের সাধনায়; আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্বকে দিয়ে যান নতুন আকৃতি।

আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষবাদের সঙ্গে বোর-হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মিলিয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্যের ব্যাখ্যা করাই হকিংয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বলে বিবেচনা করা হয়।

তিনি ধারণা দেন, স্থান আর কালের সূচনা হয়েছিল বিশ্বজগতের সৃষ্টির সময়, এক মহা বিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের মধ্যে দিয়ে। আর এর ইতি ঘটতে পারে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরে।

সূক্ষ্ম রসবোধের জন্য পরিচিতি স্টিভেন হকিং ওই হুইল চেয়ারে বসেই তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার জটিল বিষয়গুলো নিয়ে সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে গেছেন।   

তার লেখা ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ এর বিক্রি ছিল বিস্ময়কর। বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি তিনি যে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যেত তার যে কোনো বক্তৃতায় সাধারণ মানুষের বিপুল উপস্থিতি থেকে। 

গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক তিনশ বছর পর ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্ম নেন স্টিভেন উইলিয়াম হকিং।

আর ১৪ মার্চ যে দিন তার মৃত্যু হল, পৃথিবীর মানুষ তা স্মরণ করে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার আরেক দিকপাল আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন হিসেবে। 

 

ব্যধির সঙ্গে বসবাস

হকিংয়ের বাবা ফ্র্যাঙ্ক হকিং আর মা ইসোবেল ছিলেন উত্তর লন্ডনের বাসিন্দা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা যখন ‘তুলনামূলক নিরাপদ শহর’ অক্সফোর্ডে চলে আসেন, হকিং তখন মায়ের গর্ভে।

তার আট বছর বয়সে পুরো পরিবার উত্তর লন্ডন থেকে ২০ মাইল দূরের সেইন্ট আলবানস শহরে চলে যায়। ১১ বছর বয়সে এখানকার সেইন্ট আলবানস স্কুলে ভর্তি হন হকিং, এরপর যান বাবার পুরনো শিক্ষাঙ্গন অক্সফোর্ডে।

হকিংয়ের ইচ্ছা ছিল গণিত নিয়ে পড়বেন। কিন্তু রিসার্চ বায়োলজিস্ট বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। শেষ পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ডে পড়েন পদার্থবিদ্যা। পরে কেমব্রিজে যান কসমোলজির ওপর স্নাতকোত্তর করতে। 

কিশোর বয়সে ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসতেন হকিং। কিন্তু ২১তম জন্মদিনের কিছুদিন পর ১৯৬৩ সালে হকিংয়ের এক ধরনের মোটর নিউরন রোগ এএলএস ধরা পড়ে। তার প্রায় পুরো শরীর অসাড় হয়ে পড়ে, বাকশক্তি লোপ পায়; চলাফেরা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে হুইল চেয়ারে।

১৯৬৪ সালের জুনে হকিং যখন বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন চিকিৎসক সাফ জানিয়ে দেন, তার হাতে বড়জোর আর দুই কি তিন বছর আছে।

চিকিৎসকরা যতটা ভয় পাচ্ছিলেন, ততটা দ্রুত বাড়েনি হকিংয়ের রোগ। প্রথম স্ত্রী জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে তার সংসারে তিন সন্তানের জন্ম হয়। বিশেষভাবে তৈরি ভয়েস সিন্থেসাইজার দিয়ে হকিংয়ের ভাব প্রকাশের ব্যবস্থা হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে তিনি ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ শেষ করেন।

কসমোলজি নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য লেখা হকিংয়ের ওই বই বিক্রি হয় এক কোটি কপির বেশি। অবশ্য কতজন পাঠক ছোট্ট ওই বইটি পড়ে শেষ করতে পেরেছেন সে প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারে।

প্রথম স্ত্রী জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে হকিং

স্পেনের সান লরেঞ্জো সৈকতে দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যালেইনের সঙ্গে

১৯৬২ সালের অক্টোবরে স্টিভেন হকিং যখন ডেনিস সিয়েমার অধীনে কসমোলজি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন কেমব্রিজে আর কেউ ওই বিষয়ে কাজ করছিল না। ১৯৬৫ সালে যে থিসিসের জন্য তিনি পিএইচডি ডিগ্রি পান, তার শিরোনাম ছিল ‘প্রপার্টিজ অব এক্সপান্ডিং ইউনিভার্স’।

ওই বছরই গনভিল অ্যান্ড সেইয়াস কলেজের রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ শুরু করেন হকিং। ‘সিঙ্গুলারিটিজ অ্যান্ড দ্য জিওমেট্রি অব স্পেস টাইম’ রচনার জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি পান মর্যাদাপূর্ণ অ্যাডামস প্রাইজ।

হকিং ১৯৬৮ সালে ইন্সটিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমিতে কাজ করতে যান। পাঁচ বছর পর সহকারী গবেষক হিসেবে যোগ দেন কেমব্রিজের ফলিত গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখানেই জর্জ এলিসের সঙ্গে তার প্রথম অ্যাকাডেমিক বই ‘লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেস টাইম’ প্রকাশিত হয়।

১৯৭৫ সালে কেমব্রিজের ওই বিভাগের রিডার এবং তার দুই বছর পর অধ্যাপক হন হকিং। ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন লুকাসিয়ান অধ্যাপক, যে পদে এক সময় ছিলেন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন।

হকিংয়ের কাজের ক্ষেত্র ছিল পদার্থবিদ্যার সেইসব মৌলিক সূত্র নিয়ে, যেগুলোর মাধ্যমে এই মহাবিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহকর্মীদের নিয়ে তিনি কৃষ্ণগহ্বরের ইনফরমেশন প্যারাডক্স নিয়ে কাজ করছিলেন।

‘এ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ ছাড়াও হকিংয়ের ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার অ্যাসেস’, ‘দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’. ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ ও ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি’ বইগুলো বেস্ট সেলার হয়েছে।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হকিং ছিলেন যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো; ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস অ্যান্ড পন্টিফিকাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য।

 

‘থিওরি অব এভরিথিং’

হকিং একবার বলেছিলেন, অসুস্থতা তাকে কিছু সুবিধাও দিয়েছে। অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন । 

খাতাকলমে অংক করা বা গবেষণাগারে পরীক্ষা ছাড়াই মানসচোখে সমস্যার সমাধান খুঁজে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত ছিলেন হকিং। 

এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে, তা অপেক্ষবাদ ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যম ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। স্যার রজার পেনরোজের সঙ্গে করা যৌথ গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, স্থান-কালের শুরু বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে, আর সমাপ্তি কৃষ্ণগহ্বরে।

কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল থেকে শক্তি নিঃসরণের ফলে কৃষ্ণগহ্বর একসময় হারিয়ে যায় বলে তিনি ধারণা দেন, পরে তা হকিং রেডিয়েশন নামে পরিচিতি পায়।

কৈশোর, তারুণ্যে স্টিভেন হকিং

‘দ্য থিওরি অব এভরিথিংয়ের’ প্রিমিয়ারে হকিং

অবশ্য ২০১৪ সালে হকিংকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘থিওরি অব এভরিথিং’-এ যখন তিনি বলেন, এই মহাবিশ্বের সবকিছু খুব স্পষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলছে বলে তার মনে হয়েছে, সে বিষয়টিই সাধারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল।   

“এই মহাবিশ্বের সূচনা আসলে কীভাবে হয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর হয়ত আমরা ওইসব নিয়মের মধ্যে পেতে পারি।

কোথায় চলেছি আমরা? এই মহাবিশ্বের কি শেষ আছে? যদি তাই হয়, সেই সমাপ্তি কীভাবে ঘটবে? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা খুঁজে পাই, আমরা তাহলে ঈশ্বরের মনও পড়তে পারব।”    

তাত্ত্বিক গবেষণার বাইরে জনপ্রিয় কয়েকটি টেলিভিশন শোতেও হকিংকে দেখেছে এই পৃথিবীর মানুষ।এর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য সিম্পসনস’, ‘রেড ডোয়ার্ফ’ ও ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’।স্টার ট্রেক সিনেমায় দেখানো হয়েছে তার হলোগ্রাম ছবি।  ভয়েস সিন্থেসাইজার দিয়ে বলা তার কথা ব্যবহার করা হয়েছে রক ব্যান্ড পিঙ্ক ফ্লয়েডের এক অ্যালবামে।

 

অসুস্থতা হকিংকে পুরোপুরি অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছিল। এ জন্য হকিং বিভিন্ন সময়ে প্রথম স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, যিনি প্রায় ২০ বছর এই বিজ্ঞানীর দেখভাল করেছেন।  

ফলে সেই হকিং যখন ১৯৯৫ সালে নিজের নার্স অ্যালেইন ম্যসনকে বিয়ে করলেন, বন্ধু আর কাছের মানুষরাও বিস্মিত হয়েছিলেন।

২০০০ সালের দিকে হকিংকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে যেতে হয় শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত নিয়ে। তিনি কোনোভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন কি না, সেই সন্দেহ থেকে পুলিশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করে। তবে হকিং সবসময়ই বলেছেন, ওইরকম কোনো ঘটনা কখনো ঘটেনি। পুলিশও আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।  

জীবিত থাকতেই কিংবদন্তির খ্যাতি পাওয়া এ বিজ্ঞানী ২০০৭ সালে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মহাশূন্যের মত ভরহীন অবস্থার অভিজ্ঞতা নেন। তিনি বলেছিলেন, ওই কাজ তিনি করেছিলেন মহাকাশ ভ্রমণে মানুষকে আগ্রহী করে তোলার জন্য। 

“পারমাণবিক ও জীবাণু অস্ত্রের যুদ্ধ এবং অন্যান্য বিপদ এখন যে হারে বেড়েছে, তাতে পৃথিবী থেকে প্রাণের বিনাশ ঘটার ঝুঁকি এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলে আমার মনে হয়।  আমার ধারণা, মহাকাশে নতুন আবাস খুঁজে না নিতে না পারলে মানবজাতির কোনো ভবিষ্যত নেই। এ কারণে আমি সবাইকে মহাকাশ ভ্রমণে আগ্রহী করতে চাইছি।”

ডিসকোভারি চ্যানেলের এক সিরিজে হকিং বলেছিলেন, সৌরজগতের বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণী থাকার ধারণা খুবই যৌক্তিক। সেজন্য মানুষের সতর্ক থাকা দরকার, কারণ সেই বুদ্ধিমান প্রাণীরা নিজেদের রসদের প্রয়োজনে পৃথিবীতে অভিযান চালাতে পারে। 

হকিং লিখেছিলেন, মোটর নিউরন তার যৌবনের প্রায় পুরোটা সময় কেড়ে নিলেও দারুণ একটি পরিবারের সঙ্গ পাওয়া থেকে বা কাজে সফল হওয়া থেকে ওই রোগ তাকে বঞ্চিত করতে পারেনি।

“এর মানে হল, কোনোভাবেই আশা ছাড়লে চলবে না।”

আধুনিক কসমোলজির এ দিকপাল বুধবার ভোরে তার কেমব্রিজের বাড়িতে মারা যান।

হকিংকে উদ্ধৃত করে তার তিন সন্তান লুসি, রবার্ট ও টিম এক বিবৃতিতে বলেন, “একবার তিনি (বাবা) বলেছিলেন, ‘এটা যদি আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলোর আবাসভূমি না হত, তাহলে এটা মহাবিশ্বই হত না,’ আমরা তাকে কখনো ভুলব না।”

[প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য বিবিসি, গার্ডিয়ান, রয়টার্স ও হকিং ডট অর্গ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।]