‘জাদুটোনায়’ ২৪২ মিলিয়ন ডলার মেরে বিলাসী জীবন

দুবাই ইসলামিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। ১৯৯৫ সালের অগাস্টের কোনো একদিন। ফোতঙ্গা বাবানি সিসোকো নামে একজন এলেন গাড়ি কেনার ঋণ নিতে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক রাজি হলেন ঋণ দিতে, সিসোকো তাকে বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন নৈশভোজের।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2018, 09:09 PM
Updated : 18 Feb 2018, 10:30 AM

এভাবে সূচনা হয় বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে বড় প্রতারণাগুলোর একটির, যার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন বিবিসির প্রতিবেদক ব্রিজিট শেফার।

নৈশভোজ শেষে চমকে দেওয়া এক দাবি করেন সিসোকো। ব্যাংক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আইয়ুবকে তিনি বলেন, জাদুকরী ক্ষমতা আছে তার। এই ক্ষমতা দিয়ে টাকা দ্বিগুণ করতে পারেন তিনি।

আমিরাতি বন্ধুকে আবার আসার দাওয়াত দেন সিসোকো। এবার কিছু নগদ টাকা নিয়ে আসতে বলেন তাকে।

জাদুটোনা ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও অনেকেরই এতে বিশ্বাস রয়েছে। সেই বিশ্বাসের টানে মালির কোন এক গ্রাম থেকে উঠে আসা রহস্যজনক চরিত্র সিসোকোর ফাঁদে পড়েন আইয়ুব।

পরেরবার সিসোকোর বাসায় টাকা নিয়েই হাজির হন আইয়ুব। তিনি ঘরে ঢুকতেই একটি কক্ষ থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হন এক ব্যক্তি। ‘এইমাত্র জ্বিন আক্রমণ করেছে’ বলে চিৎকার করতে থাকেন তিনি। ওই ব্যক্তি আইয়ুবকে সতর্ক করে বলেন, যেন জ্বিনকে উত্তেজিত করা না হয়, তা হলে টাকা দ্বিগুণ হবে না।

আইয়ূব তার টাকা ওই জাদুর কক্ষে রেখে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে তার ভাষ্যে আসে, তিনি ওই সময় ওই কক্ষে আলো ও ধোঁয়া দেখেন, শুনতে পান ‘গায়েবি’ আওয়াজ। এক পর্যায়ে নেমে আসে নীরবতা।

“আইয়ূব বিশ্বাস করেছিল এটা ব্ল্যাক ম্যাজিক, যার মাধ্যমে সিসোকো অর্থ দ্বিগুণ করতে পারেন,” বলেন মিয়ামির অ্যাটর্নি এলান ফাইন, যিনি ব্যাংকটির হয়ে পরবর্তীতে ঘটনার তদন্ত করেছেন।

এলান ফাইন বিবিসিকে আরও বলেন, “তাই আইয়ুব সিসোকোকে অর্থ দিতেন-ব্যাংকের অর্থ-এবং তিনি আশা করছিলেন এই অর্থ তার কাছে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে।”

১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় থাকা সিসোকোর ব্যাংক হিসাবগুলোতে ১৮৩ দফায় অর্থ পাঠান আইয়ুব। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করেন সিসোকো, যার ব্যবস্থা করে দেন ব্যাংক ব্যবস্থাপক আইয়ুব।

১৯৯৮ সালে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক সঙ্কটে পড়ার গুঞ্জন শুরু হয়। ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়েছে বলে সে সময় সংবাদ প্রকাশ হয়।

এরপর ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে লাইন ধরেন গ্রাহকরা। সে সময় দুবাই কর্তৃপক্ষ বলে, “ছোট একটি সমস্যা হয়েছে, যাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বা আমানতকারীদের কোনো ক্ষতি হবে না।”

কিন্তু তাদের ওই বক্তব্য সঠিক ছিল না।

অ্যাটর্নি এলান ফাইন বলেন, “এতে ব্যাংকের মালিকরা বিশাল, বিশাল ধাক্কা খান। ব্যাংকটি ইন্স্যুরেন্সের আওতায়ও ছিল না। সরকার সহযোগিতা করায় ব্যাংকটি রক্ষা পেয়েছিল। তবে তার জন্য তাদের ব্যাংকটিতে অনেক অর্থ ঢালতে হয়েছিল।”

ব্যাংকটির যখন এই সংকটাপন্ন অবস্থা, তখন ফোতঙ্গা বাবানি সিসোকো ছিলেন অনেক দূরে। সিসোকোর একটি বড় সুবিধা ছিল টাকা পাওয়ার জন্য তার দুবাইতে থাকার দরকার হত না।

আইয়ুবের সঙ্গে এই জাদুকরী খেলের কয়েক সপ্তাহ পর ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে নিউ ইয়র্কে অন্য একটি ব্যাংকের শাখায় যান সিসোকো। সেখানে তিনি যা করেন, সেটা ছিল হিসাব খোলার চেয়ে একটু বেশি কিছু।

এলান ফাইনের ভাষ্যে, “একদিন তিনি কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই সিটিব্যাংকে যান। একজন টেলারের (সরাসরি গ্রাহক সেবায় নিয়োজিত) সঙ্গে সেখানে তার যে সাক্ষাৎ, সেটা বিয়েতে গড়ায়।

“এবং বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, ওই নারীই সিটি ব্যাংকের সঙ্গে তার আস্থার সম্পর্ক করে দেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, তারপর সেখানে খোলা হিসাবের মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়।”

সিটিব্যাংকের বিরুদ্ধে দুবাই ইসলামিক ব্যাংকের করা মামলার বরাতে জানা যায়, যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই এই ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১৫১ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ছাড় করেছিল সিটিব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত মামলাটি প্রত্যাহার হয়।

ব্যাংককেন্দ্রিক এই সহায়তার জন্য সিসোকো তার নয়া স্ত্রীকে পাঁচ লাখ ডলারের বেশি অর্থ দিয়েছিলেন।

তাদের বিয়ের বিষয়ে ফাইন বলেন, “আমি জানি না, কোন আইনে সিসোকো তাকে বিয়ে করেছিল। তবে সে তাকে স্ত্রী বলত এবং তিনিও নিজেকে স্ত্রী বলেই মনে করতেন।

“তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার (সিসোকো) আরও অনেক স্ত্রী আছে। কেউ কেউ আফ্রিকার, কয়েকজন মিয়ামির, কেউবা নিউ ইয়র্কের।”

এভাবে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার জন্য একটি এয়ারলাইন্স খোলার স্বপ্ন পূরণ করেন সিসোকো। একটি সেকেন্ডহ্যান্ড হকার-সিডলি ১২৫ ও এক জোড়া পুরাতন বোয়িং-৭২৭ এস উড়োজাহাজ কেনেন তিনি। এর মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু করে এয়ার ডাবিয়া, যা মালিতে তার নিজের গ্রামের নামে নামকরণ করা হয়।

কিন্তু ১৯৯৬ সালে সিসোকো গুরুতর ভুল করে বসেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার দুটি হুয়ে টু হেলিকপ্টার কিনতে গিয়ে। তবে কেনইবা তিনি সেই সময় কপ্টার কিনতে গেলেন তার কারণ স্পষ্ট নয়।

“এই হেলিকপ্টার কেনার পেছনে তার ব্যাখ্যা ছিল এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চালু করার। কিন্তু যেটা তিনি খুঁজছিলেন সেটা ছিল বেশ বড় আকারের, যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতাল ও ট্রমা সেন্টারগুলোতে ব্যবহৃত হেলিকপ্টারের মতো নয়, তার চেয়ে অনেক বড়,” বিবিসিকে বলেন ফাইন।

কারণ সেগুলো অস্ত্র ব্যবহারের উপযোগী করা যেত, হেলিকপ্টারগুলোর বিশেষ রপ্তানি লাইসেন্সের দরকার ছিল। সিসোকোর লোকজন শুল্ক কর্মকর্তাকে ৩০ হাজার ডলার ঘুষ দিয়ে সেটার রফা করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়ে যায়। সিসোকোকেও গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করে ইন্টারপোল। সিসোকো ধরা পড়েন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়, যেখানে তিনি গিয়েছিলেন আরেকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে।

সে সময় জেনেভার চ্যাম্প-ডোলন কারাগারে সিসোকোর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে তার আইনজীবী হিসাবে কাজ করতে যাওয়া মিয়ামির টম স্পেনসারের।

“আমি কারাগারের ওয়ার্ডেনের সঙ্গে কথা বলি; তিনি আমার কাছে সিসোকো যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন কি যাচ্ছেন না সে বিষয়ে জানতে চান।

“আমি বলি, ‘ঠিক আছে, আমরা দেখব’। তিনি বলেন, ‘আচ্ছা, যতটা সম্ভব এটা পিছিয়ে দিন’। আমি বলি, ‘তা কেন?’ ‍ওয়ার্ডেনের উত্তর আসে, ‘তিনি আমাদের জন্য প্রতি রাতে প্যারিস থেকে চমৎকার খাবার আনান’। এবং এটা ছিল আমার প্রথমবার বাবা সিসোকোর সঙ্গে অদ্ভুত রকমভাবে মুখোমুখি হওয়া।”

সিসোকোকে দ্রুততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হয়, সেখানে তিনি তার প্রভাবশালী অনুসারীদের সংগঠিত করা শুরু করেন।

সিসোকোর জামিনদার হতে কূটনীতিকদের আগ্রহে শুনানিতে থাকা বিচারক বিব্রত হন। আইনজীবী টম স্পেনসার বিস্মিত হন যখন দেখেন সাবেক সিনেটর বার্চ বেহ সিসোকোর আইনজীবী দলে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

অ্যাটর্নি ফাইন বলেন, “বেশ, আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন কেউ এভাবে একজন বিদেশি নাগরিকের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে, যার দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রে কোনো গুরুত্ব নেই? আমি এ প্রশ্নের উত্তর জানি না। তবে, এটা অনেক কৌতূহল ‍উদ্দীপক একটা বিষয়।”

ফ্লোরিডায় সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সিসোকোকে কারাগারে আটকে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০ মিলিয়ন ডলারে জামিন পেয়ে যান তিনি।

এরপর দেদারছে খরচ করতে থাকেন সিসোকো। পক্ষের আইনজীবীরা পুরস্কার হিসেবে পান মার্সিডিজ বা জাগুয়ার। তবে তা ছিল শুরু মাত্র।

ফাইন বলেন, কেবল একটি গহনার দোকানে কেনাকাটায় সিসোকো খরচ করেন ৫ লাখ ডলার। অন্যান্য জায়গায়ও লাখ লাখ ডলার ঢালেন তিনি। একটি পুরুষের পোশাকের দোকানে তিনি খরচ করেন দেড় লাখ ডলারের বেশি।

গাড়ির ডিলার রনিল ডুফরেনে বলছিলেন, “তিনি আসতেন এবং একসঙ্গে দুই-তিন-চারটা গাড়ি কিনতেন। আবার আরেক সপ্তাহে এসেও একসঙ্গে দুই-তিন-চারটা গাড়ি কিনতেন। এটা এমন ছিল যে, টাকা যেন বাতাসের মতো।”

সিসোকোর কাছে ৩০ থেকে ৩৫টি গাড়ি বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।

মিয়ামিতে সেলিব্রেটি বনে যান সিসোকো। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন স্ত্রী থাকলেও তিনি বিয়ে করা থামাননি। শহরে ২৩টি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন তিনি।

“প্লেবয় হচ্ছে তাকে বর্ণনার সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দ। কারণ তিনি ছিলেন খুব অভিজাত ও হ্যান্ডসাম। পোশাক-পরিচ্ছদ পরতেন সুবিশেষ ধাঁচে। মিয়ামিতে তিনি অনেক অর্থ উড়িয়েছেন,” বলেন সিসোকোর কাজিন মাকান মুসা।

খরচের একটি বড় অংশ সিসোকো দিতেন ভালো কাজেও। কারণ তিনি জানতেন ভালো কাজের প্রচারের মূল্য। থ্যাংকসগিভিং ডে প্যারেডে অংশ নিতে যাওয়া হাই স্কুল ব্যান্ডকে ৪ লাখ ১৩ হাজার ডলার দিতে দেখেছেন বলে জানান মাকান মুসা।

বৃহস্পতিবারগুলোতে সিসোকো গৃহহীনদের মাঝে টাকা বিলি করতে বের হতেন বলে জানান তার আরেক আইনজীবী অধ্যাপক এইচ টি স্মিথ।

“আমি চিন্তা করতাম, একি আধুনিক রবিন হুড? কেন আপনি টাকা চুরি করছেন এবং দিয়ে দিচ্ছেন? এটা কোনো অর্থ তৈরি করত না,” বলেন তিনি।

স্মিথ বলেন, “সে চলে যাওয়ার পর মিয়ামি হেরাল্ড একটি খবর প্রকাশ করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, তারা সেখানে ১৪ মিলিয়ন ডলার খরচের হিসাব বের করেছিল। সে এখানে ১০ মাসের মতো ছিল, তার মানে প্রতি মাসে এক মিলিয়ন ডলারের বেশি।”

তবে তার এই দাতাগিরিকে সন্দেহের চোখে দেখেন এলান ফাইন। নিজের প্রচার ও আসল ঘটনা ঢাকতে সিসোকো এগুলো করতেন বলে মনে করেন তিনি।

“সে যা করেছে, তার সবটাই ভাবমূর্তি তৈরির জন্য। মানুষের কাছে নিজেকে অনেক প্রভাবশালী ও অতিমাত্রায় সম্পদশালী হিসাবে দেখাতে চেয়েছিল সে। আমার জানা মতে, প্রচার পায়নি এমন কোনো দান সে কখনও করেনি।”

এমন জনসংযোগমূলক কাজের মধ্যেও কোর্টে মামলার শুনানিতে আইনজীবীদের পরামর্শ না মেনে দোষ স্বীকার করতেন তিনি। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, এতে তারা টাকা-পয়সা নিয়ে প্রশ্ন কম উঠবে।

তার শাস্তি হয়েছিল ৪৩ দিনের কারাদণ্ড ও আড়াই লাখ ডলার জরিমানা। জরিমানার অর্থ দুবাই ইসলামিক ব্যাংক থেকেই পরিশোধ করা হয়।

মোট সাজার অর্ধেক দিন খাটার পর এক গৃহহীনকে এক মিলিয়ন ডলার দেওয়ার বিনিময়ে ছাড়া পান সিসোকো। কারাদণ্ডের বাকি দিনগুলো মালিতে গৃহবন্দি অবস্থায় কাটানোর শর্তে ছাড়া পেলেও নায়কের বেশে ঘরে ফেরেন তিনি।

তার বাড়ি ফেরা এমন সময়ে হয়েছিল, যখন দুবাই ইসলামিক ব্যাংকের নিরীক্ষকরা দেখতে পাচ্ছিলেন, কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটেছে। আইয়ুবও ভীত হয়ে উঠছিলেন, ততক্ষণে সিসোকো তার ফোনের জবাব দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত আইয়ুব ঘটনা স্বীকার করেন তার এক সহকর্মীর কাছে। ওই সহকর্মী ‘কত টাকা হাওয়া হয়েছে’ জানতে চাইলে লজ্জায় মুখে বলতে পারেনি আইয়ূব; এক টুকরো কাগজে লিখে দেন, ‘৮৯০ মিলিয়ন দিরহাম’, যা ২৪২ মিলিয়ন ডলারের সমান।

প্রতারণার দায়ে তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। জাদুটোনায় বিশ্বাস দূর করতে তাকে ভূত তাড়ানোর চিকিৎসা দেওয়া হয় বলেও গুজব ছড়িয়েছিল।

সিসোকো কখনও বিচারের মুখোমুখি হননি। তার অবর্তমানে দুবাইয়ের একটি আদালত তাকে প্রতারণা ও জাদু চর্চার কারণে তিন বছরের জেল দেয়। ইন্টারপোল তার নামে পরোয়ানা জারি করে এবং তিনি ওয়ান্টেড হিসাবেই রয়েছেন।

সিসোকোর বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলার বিচার কার্যক্রমের নথিপত্র পাওয়া যায়। প্যারিসের একটি আদালতে তার আইনজীবী দাবি করেন, আইয়ুবের কাজের ‘বলির পাঠা’ বানানো হয়েছে তাকে এবং তাদের এই অর্থ অন্য কোথাও গেছে। তবে কোর্ট এই বক্তব্য গ্রহণ না করে সিসোকোকে অর্থপাচারে দোষী সাব্যস্ত করে।

২০০২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১২ বছর মালির পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন সিসোকো, যা তাকে বিচার থেকে রেহাই দেয়। এখন পার্লামেন্টে না থাকলেও গত চার বছর ধরে নিরাপদেই আছেন তিনি, কারণ মালির সঙ্গে অন্য কোনো দেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই। তবে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক এখনও তাকে আদালতের মাধ্যমে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

মালির রাজধানী বামাকোতে সিসোকোর পোশাক তৈরিকারী একজন নারী দর্জি সম্প্রতি তাকে বর্ণনা করেন একজন পছন্দসই ব্যক্তি হিসাবেই।

ওই নারী বলেন, “সর্বশেষ আমি তাকে দুই-তিন বছর আগে দেখেছি, তখন তাকে একটি কাপড়ের স্যুটকেস বানিয়ে দিই। যদি তিনি উপহার দিতে না পারতেন তাহলে খুশি হতেন না। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। তিনি মানুষকে কিছু দিতে পছন্দ করেন।”

তার গাড়িচালক লুকালি ইব্রাহিম বলেন, “তার ভালো দিক হচ্ছে, যখন সব কিছু ঠিকঠাক চলে তখন আপনি তার কাছ থেকে অনেক উপহার প্রত্যাশা করতে পারেন। তিনি মানুষকে তাদের সমস্যায় সহায়তা করতে পছন্দ করেন।

“আর খারাপ দিক হচ্ছে, তিনি এমন ব্যক্তি, আপনাকে সত্যটা হয়ত বলবেন না, কিন্তু আশা সঞ্চারিত রাখেন; মানে আপনাকে তার পিছনে ঘোরাতে থাকেন।”

একটি বাজারে গিয়ে একজন স্বর্ণকারকে পাওয়া গেল, যার কাছে তার একজন ক্রেতার বিষয়ে কেবল প্রশংসাই শোনা যাচ্ছিল, যিনি ফোন করতে পারেন এবং বলতে পারেন তার বন্ধুদের জন্য কিছু উপহার তৈরি করতে।

জানা যায় তাকে তার নিজের গ্রাম ডাবিয়ার আশপাশের কোনো এলাকায় পাওয়া পেতে পারে। যে গ্রাম থেকে তার অল্প দিন টিকে থাকা এয়ারলাইন্স নাম পেয়েছিল। এর অবস্থান গিনি ও সেনেগাল সীমান্তে। দীর্ঘ যাত্রার পর এমন একটি বাড়ি পাওয়া যায়, যেটা তার বাড়ির বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়।

হুট করে সশস্ত্র পাহারার মধ্যিখানে পাওয়া যায় তাকে। বাবানি সিসোকো নিজেই, এখন যার বয়স সম্ভবত ৭০ বছর।

সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন তিনি। নিজের পৃথিবীতে আসা সম্পর্কে বলার মধ্য দিয়ে কথা শুরু করেন তিনি।

“আমার নাম সিসোকো ফোতঙ্গা দিত বাবানি। আপনি জানবেন, যেদিন আমি জন্মাই সেদিন এখানকার গ্রামবাসী চিৎকার করতে করতে জড়ো হয়েছিল, ‘ম্যারিয়েত্তোর ছেলে হয়েছে’।

“…চারিদিকে ছিল প্রচুর আনন্দ-আয়োজন।”

পরে তিনি এই গ্রামের পুনর্গঠনে নিজের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন, যেটা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। কথা বলেন টাকা করা নিয়েও। সিসোকো বলেন, এক পর্যায়ে তার ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ হয়েছিল।

তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, দুবাই ইসলামিক ব্যাংক থেকে ২৪২ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে।

উত্তরে সিসোকো বলেন, “ম্যাডাম, ২৪২ মিলিয়ন ডলার কিছুটা পাগলাটে গল্প। ব্যাংকের ভদ্রলোকদের ব্যাখ্যা করা উচিত, এই টাকা তারা কীভাবে হারাল। ২৪২ মিলিয়ন ডলার। এই টাকা কীভাবে যেতে পারল? এটাই সমস্যা। এই ট্রান্সফারগুলো অনুমোদনের দায়িত্বে কেবল এই ব্যক্তি (আইয়ুব) একা নন। যখন কোনো ব্যাংক অর্থ ট্রান্সফার করে তখন সেটা কেবল একজন ব্যক্তির মাধ্যমে হয় না, কয়েকজনকে করতে হয়।”

জাদুটোনা নিয়ে আইয়ুবের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যে ভদ্রলোকের কথা আপনি বলছেন, তাকে আমি দেখেছিলাম এবং সাক্ষাৎ হয়েছিল আমাদের।”

তবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন সিসোকো।

“তার সঙ্গে আমার একবারই যোগাযোগ হয়েছিল যখন আমি একটি গাড়ি কিনতে যাই। ব্যাংক আমাকে এটি কিনে দেয় এবং আমি তাদের ঋণ শোধ করে দিই। এটা ছিল জাপানি গাড়ি।”

জাদুটোনা দিয়ে লোকজনকে প্রভাবিত করেছিলেন কি না-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ম্যাডাম, যদি একজন মানুষের এমন ক্ষমতা থাকে তাহলে সে কেন কাজ করবে? যদি আপনার সেই ক্ষমতা থাকে তাহলে আপনি পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় থেকে সব ব্যাংক ডাকাতি করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, যে কোন জায়গায়। এমনকি এই আফ্রিকায়ও। চাইলে সব ব্যাংকই আপনি ডাকাতি করতে পারতেন।”

এখনও সম্পদশালী কি না জানতে চাইলে সিসোকোর উত্তর ছিল স্পষ্ট; “না, আমি এখন আর ধনী নই। আমি গরিব।”

সব অর্থ অপব্যয় এবং কখনও মালি থেকে বেরোতে না পারলেও বিভিন্ন দেশের পরোয়ানা নিয়ে ২০ বছর পার করে দিয়েছেন সিসোকো। ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক ব্যাংক ডাকাতির’ জন্য একদিনও জেল খাটেননি তিনি।