২০১৭: নতুন অস্থিরতার আঁতুড়ঘর

আইএস এর জঙ্গি প্রতাপ ২০১৭ সালে নিভে এসেছে অনেকটাই, কিন্তু দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর মিছিল থামেনি। জাতিবিদ্বেষের শিকার রোহিঙ্গারা প্রাণ হাতে ছুটছে সীমান্তের পথে; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান মিয়ানমারকে টলাতে পারছে না।

মীর মোশাররফ হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2017, 03:46 AM
Updated : 26 Dec 2017, 10:22 AM

যৌন হয়রানীর প্রশ্নে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিশ্বের নারীরা; প্যারাডাইস পেপারসে আবারও ক্ষমতাশালীদের গোমর ফাঁস হয়েছে, আরবে বইতে শুরু করেছে উদরনীতির হাওয়া। কিন্তু পরমাণু অভিলাষে উত্তর কোরিয়া হয়ে উঠেছে আরও বেপরোয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভূমিকম্প ঘটিয়েছেন. তার অনুরণন সারা বিশ্বের মানুষ অনুভব করেছে পুরো ২০১৭ সাল জুড়ে।

নতুন মেরুকরণে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে যোগ হওয়া নতুন উত্তেজনা, সিরিয়া ঘিরে ক্রেমলিন-পেন্টাগনের দাবা খেলা আর জেরুজালেম প্রশ্নে ট্রাম্পের নতুন পদক্ষেপের পর আরব বিশ্বে নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে ২০১৮ সালে প্রবেশ করতে যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ।   

ট্রাম্পের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় ছিল সারা বছর। জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে এ বছর টানাপোড়েন দেখা গেছে। ফিলিস্তিনের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে অক্টোবরে ইউনেস্কো ছাড়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।  

বিদায়ী বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে মস্কোর প্রভাব আরও বেড়েছে। ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক দৃশ্যত ভালো থাকলেও গত বছর ওয়াশিংটন থেকে কূটনীতিক বহিষ্কারের পাল্টায় এ বছর ৭৫৫ মার্কিন কূটনীতিককে রাশিয়া ছাড়া করেন ভ্লাদিমির পুতিন।

২০১৭ সালে প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে চীনের অবস্থানও। বছরের শেষভাগে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সম্মেলন এবং শি জিনপিংয়ের ক্ষমতা আরও সংহত হওয়ার বিষয়টি ছিল আলোচনায়। 

দক্ষিণ এশিয়ায় নরেন্দ্র মোদীর ভারতের প্রভাব কি খানিকটা খর্ব হয়েছে চীনের কাছে? নেপালের নির্বাচনে বাম জোটের এগিয়ে যাওয়া এবং শ্রীলঙ্কার বন্দর চীনকে ইজারা দেওয়ার ঘটনা দিল্লির কপালে ভাঁজ বাড়িয়েছে, সন্দেহ নেই।

এদিকে দক্ষিণপন্থার অগ্রযাত্রায় এ বছর  লাতিন আমেরিকায় একের পর এক বামঘাঁটি ধসে পড়েছে, ক্ষমতায় ফিরছে রক্ষণশীলরা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম জার্মানির পার্লামেন্টে আসন পেয়েছে কট্টর ডানপন্থিরা; ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলেও উগ্র ডানরা দুর্বল হয়েছে বলা যাবে না। এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে পুননির্বাচিত হয়েছেন হাসান রুহানি।

ইউরোপ আর এশিয়ায় দুটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকার স্বাধীনতার চেষ্টা ছিল ২০১৭ সালের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। গতবছরের আলোচিত ব্রেক্সিট নিয়ে এ বছরও অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হতে আরও অনেক আলোচনা বাকি।

ক্ষমতা পোক্ত করতে এ বছর আগাম নির্বাচন দিলেও আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় কার্যত আরও দুর্বল হয়েছে মের সরকার, শক্তিশালী হয়েছে লেবার পার্টি। আধুনিক জাপানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সম্রাটের অবসরে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। 

এ বছর দুই দফা বড় আকারের সাইবার হামলা কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে বিশ্বকে। পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেটের সফল উৎক্ষেপণ আর আইনস্টাইন তরঙ্গের গবেষণায় সাফল্য ছিল বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অন্যতম আলোচিত বিষয়।

প্রতিবছরের মত এবারও বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হয়েছে পৃথিবীর মানুষকে; ছিল ভূমিকম্প, বন্যা, অতিবৃষ্টি। আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এবার দেখা মিলেছে ধ্বংসাত্মক সব ঝড়ের।   

অস্থিরতার বুদবুদ

নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব সংঘাত আর ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণে বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল মধ্যপ্রাচ্য।

দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ও সৌদি আরবের মুখোমুখি অবস্থান এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আরবের রাজনীতিতে উত্তাপ যুগিয়েছে। ঘরে বাইরে সৌদি আরবের যে নীতিগত পরিবর্তন এ বছর শুরু হয়েছে, তার ফল আরও স্পষ্ট বোঝা যাবে ২০১৮ সালে।      

প্রথম বিদেশ সফরে সৌদি আরব গিয়ে সেখানে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেন ট্রাম্প; তখন থেকেই অঞ্চলজুড়ে নতুন করে অস্থিরতা শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছিল।

সন্ত্রাসবাদে সহযোগিতা ও তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির অজুহাতে বছরের মাঝামাঝি কাতারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটনায় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও বাহরাইন। দোহা ওই অভিযোগ অস্বীকার করলেও তাতে কান দেয়নি চার দেশ। পরে অবরোধপীড়িত কাতারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়া।

প্রায় একইসময়ে সৌদি রাজপরিবারেও ক্ষমতার রদবদল ঘটে। সৌদি বাদশাহ সালমান ভাতিজা নায়েফকে সরিয়ে নিজের ছেলে মোহাম্মদকে যুবরাজ ঘোষণা করেন। দায়িত্ব পেয়েই রক্ষণশীল সৌদি আরবকে আমূল পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন মোহাম্মদ। নতুন প্রশাসন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়, দেয় স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার অধিকার। বদলের হাওয়ায় আগামী বছর সিনেমা হলও খুলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে।

 

এদিকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে একের পর এক প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী, প্রিন্সদের গ্রেপ্তার এবং শতকোটি ডলারের বিনিময়ে মুক্তির ঘটনার পেছনেও যুবরাজের ক্ষমতা সংহত করার চেষ্টা দেখতে পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে উদারপন্থাকে সামনে নিয়ে এলেও যুবরাজ মোহাম্মদের সৌদি আরব কূটনৈতিক ও সামরিক অবস্থানের দিক দিয়ে ক্রমশ আগ্রাসী রূপ ধারণ করছে।

হুতিদের সঙ্গে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এ বছর ইয়েমেন ঘিরে কঠোর অবরোধ দিয়ে দেশটির দুই কোটি মানুষকে অনাহার ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ঠেলে দেয় সৌদি সামরিক জোট। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরির আকস্মিক পদত্যাগের ঘোষণার পেছনেও সৌদি নতুন প্রশাসনের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আসে।

জাতিসংঘের চাপে বছরের শেষে এসে ইয়েমেনে অবরোধ খানিকটা শিথিল হয়, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় সাদ হারির পদত্যাগকাণ্ডেরও ইতি ঘটে। তবে সব ঘটনাতেই ইরান ও সৌদি আরবের মুখোমুখি অবস্থান ছিল স্পষ্ট। আগামীতে এই দ্বন্দ্ব আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।

বছরের একেবারে শেষ দিকে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতাকে আরও উসকে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই ঘোষণায় আরব ও পশ্চিমা মিত্রদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ শুরু হয়, হামাস নতুন ইন্তিফাদার ডাক দেয়। মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি ট্রাম্পের ঘোষণার পাল্টায় পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানায়।

 

 ট্রাম্প ধাক্কা

ভোটের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছিলেন, গত এক বছরে তার অনেকগুলোই তিনি পূরণ করেছেন বা কাজ শুরু করেছেন। 

বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত অবস্থান ও মন্তব্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সারা বরছরই ছিলেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে।

গত বছর নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্পের কর্মীদের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগের অভিযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তদন্ত শুরু হয়েছে এ বছর।

মস্কো ওই অভিযোগ অস্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো বলছে, ট্রাম্পকে জেতাতে ভূমিকা ছিল ক্রেমলিনের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বরাবরই ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার মাসখানেকেরও কম সময়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এক বৈঠক ঘিরে মিথ্যা বলার অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ট্রাম্পের সঙ্গে মতানৈক্য আর নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে ওভাল অফিস ছাড়তে হয়েছে তার ঘনিষ্ঠ অনেককেই।

নিজের দলের নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব এবং সিনেটে ডেমোক্রেট- রিপাবলিকান ব্যবধান কম হওয়ায় ওবামাকেয়ার বাতিলে ট্রাম্প প্রশাসনের বেশ কয়েকটি চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে। অবশ্য বছরের শেষ দিকে অভ্যন্তরীণ কর সংস্কারের একটি আইন প্রণয়নে সফল হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

 

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ ঠিকই কঠিন করে তুলেছেন ট্রাম্প। মানুষের প্রতিবাদ ও আদালতের বাধায় ট্রাম্পের প্রথম আদেশ আটকে গেলেও, পরের দফায় আংশিক সফল হন তিনি। পরে আদালত ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে সায় দিলে ছয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ কঠিন হয়ে যায়।

মিত্র দেশগুলোর সমালোচনার পরও ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের কাজেও খানিকটা এগিয়েছেন। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়েও অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তার বিরোধ স্পষ্ট।

বছরের মাঝামাঝি শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের পাশাপাশি তাদের বিরোধীদেরও দোষারোপ করে তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়েন ট্রাম্প। পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে রেক্স টিলারসনের সঙ্গে ট্রাম্পের দ্বন্দ্বের কথা প্রায়ই এসেছে মার্কিন গণমাধ্যমে।

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে উত্তেজনার এই সময়েও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পূর্ব এশিয়া সফর করেছেন, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতেও তার আগ্রহ বেশ স্পষ্ট।

বর্ণময় চরিত্রের এ রিপাবলিকান যে অনেক কিছুই ওলট পালট করে দিতে চান, পুতিন ও শি জিনপিংয়ের খোলামেলা প্রশংসায় সে ইঙ্গিতই মিলছে।   

যুক্তরাষ্ট্রে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনা থেমে নেই। অক্টোবরে লাসভেগাসে একটি ক্যাসিনো থেকে উন্মুক্ত কনসার্টে গুলি চালিয়ে ৫৮ জনকে হত্যা করা হয়। পরে বন্দুকধারী স্টিফেন প্যাডকের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রে একক কোনো বন্দুকধারীর গুলিতে এটিই হতাহতের সবচেয়ে বড় ঘটনা।

 

কোন পথে উত্তর কোরিয়া?

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও চাপ উপেক্ষা করে এ বছরও একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে উত্তর কোরিয়া। চালিয়েছে ষষ্ঠ ও সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা।

দুই দফা তাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের ওপর দিয়ে সাগরে পড়েছে। বছরের শেষ প্রান্তে পিয়ংইয়ং যে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় তা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের যে কোনো জায়গায় আঘাত হানতে সক্ষম বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরাও।

উত্তর কোরিয়ার এ কর্মসূচি বিশ্বজুড়ে নতুন উন্মাদনার শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ অনেক দেশই নিন্দা জানিয়েছে, দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অনেকেই পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করে এনেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা কখনোই পারমাণবিক শক্তিধর উত্তর কোরিয়াকে মেনে নেবে না। যুদ্ধ বাধলে দেশটির কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ওয়াশিংটন।

অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া বলছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি যুদ্ধের জন্য নয়, আত্মরক্ষার জন্য। কোরীয় অঞ্চলে মার্কিন আগ্রাসন এবং মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক মহড়ার কারণই অস্ত্র কর্মসূচি জোরদার করছে তারা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা কথার লড়াইয়েও জড়িয়েছেন উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উন। তারা দুজনই দুজনকে আখ্যায়িত করেছে ‘পাগল’ হিসেবে।

চলতি বছর উত্তর কোরিয়ার সেনাসদস্যের দেশত্যাগের ঘটনাও দেখেছে বিশ্ব, জাপান উপকূলে বেড়েছে উত্তর কোরিয়া থেকে ভেসে আসা মাছ ধরার নৌকার সংখ্যা।

ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে রাসায়নিক প্রয়োগে উনের সৎভাই কিম জং ন্যামকে হত্যার ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। সে সময় মালয়েশিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কেরও অবনতি ঘটে। ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পিয়ংইয়ংয়ের হাত আছে বলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া দাবি করে। বেশ কিছুদিন টানাপড়েনের পর মালয়েশিয়া ন্যামের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়।

রোহিঙ্গা সঙ্কট

বিদায়ী বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযান, যাকে জাতিসংঘ বর্ণনা করেছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। 

আর ওই অভিযানের কারণে পৌনে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে; সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কটের।

অগাস্টের শেষ সপ্তাহে কয়েক ডজন নিরাপত্তা চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে সেনাবাহিনীর ওই অভিযান শুরু হয়, পুড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকশ গ্রাম, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, ধর্ষণের শিকার হন অসংখ্য নারী।  

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই অভিযান বন্ধের আহ্বান জানায়; নেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতিও। দেশটির নেত্রী অং সান সু চি জাতিগত নির্মূল অভিযানের অভিযোগ অস্বীকার করে এবং রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধের উদ্যোগ না নেওয়ায় পশ্চিমা মিত্রদের কাছেও সমালোচিত হন।

তবে লাখো শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা হয়েছে। চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতেও রাজি হয়েছে মিয়ানমার।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বছরের শেষ দিকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার পর গঠন করা হয়েছে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। ঠিক হয়েছে, ফেব্রুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরু করবে মিয়ানমার।  

এদিকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের তুমুল চাপ এবছরও থামেনি। ছোট নৌকা ও ট্রলারে করে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সময় এ বছরও সেখানে অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটে।

 

আইএস খেলাফতের ‘পতন’

ইরাক ও সিরিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ হারিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আইএসের মানচিত্র প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে এসেছে এ বছর, তারপরও বছরের প্রথম দিনটি থেকে প্রায় প্রতি মাসেই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও তাদের সমর্থকদের হামলার ঘটনা ঘটেছে।

২০১৭ সালের প্রথম প্রহরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে একটি নাইট ক্লাবে এক বন্দুকধারী বিদেশি পর্যটকসহ ৩৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। পরে ওই ঘটনার দায় স্বীকার করে আইএস।

এরপর গত এক বছরে কয়েক দফা আক্রান্ত হয়েছে যুক্তরাজ্য। ২২ মার্চ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে এক জঙ্গি হামলায় পুলিশসহ পাঁচজন নিহত হন। মে মাসে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে আরিয়ানা গ্রান্ডের কনসার্টে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয় ২২ জন। পরের মাসেই লন্ডন ব্রিজে ভিড়ের মধ্যে ভ্যান চালিয়ে দিয়ে এবং ছুরি মেরে সাতজনকে হত্যা করা হয়।

অক্টোবরে সোমালিয়ার মোগাদিসুতে ট্রাক বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় পাঁচশ। পরের মাসে মিশরের সিনাই উপত্যাকায় মসজিদে বন্দুকধারীদের হামলায় তিন শতাধিক মুসল্লীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নাইজেরিয়ায় আরেক মসজিদে হামলায় অন্তত ৫০ জন নিহত হন। 

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে একটি মাজারে আত্মঘাতী হামলায় ৮০ জন নিহত হন। অক্টোবরে একই দিনে আফগানিস্তানের দুটি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৭২ জনের মৃত্যু হয়।

এ বছরই আইএস প্রথমবারের মতো ইরানে হামলা চালায়। পার্লামেন্টসহ দুই জায়গায় একসঙ্গে ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসলামী রেভ্যুলেশনারি গার্ড সিরিয়ায় আইএস ঘাঁটিতে ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

বার্সেলোনায় নিহতদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। রয়টার্স

অগাস্টে স্পেনের পর্যটন নগরী
চালিয়ে দিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করা হয়। নভেম্বরে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে
তুলে দিয়ে আটজনকে হত্যা করার অভিযোগে আইএস অনুসারী এক উজবেক অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করে মার্কিন পুলিশ।

বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে নিউ ইয়র্কের বাস টার্মিনালে আত্মঘাতী হামলাচেষ্টার ঘটনায় এক বাংলাদেশি অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক যুবকের নাম আসে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনাতেও

মার্কিন ও রুশ নেতৃত্বাধীন আলাদা দুটি সামরিক জোটের ধারাবাহিক আক্রমণ ও বিমান হামলায় বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে একের পর এক বড় শহর হাতছাড়া হয় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের। জুলাইয়ে মসুল, অক্টোবরে রাকা, নভেম্বরে দেইর আল জোর ও আল কাইম থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয় তাদের।

বিদ্রোহীদের ওপর আসাদবাহিনীর রাসায়নিক হামলার অভিযোগে এপ্রিলে সিরিয়ার একটি বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ওয়াশিংটন-মস্কোর সম্পর্কে অবনতি ঘটে। আফগানিস্তানে আইএস ঘাঁটিতে ‘মাদার অব অল বমস’ ছোড়ে পেন্টাগন। ফিলিপিন্সের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরও বেশ কয়েকমাস আইএস সমর্থকদের দখলে থাকে।

সিরিয়া ও ইরাকি বাহিনী আইএস এর বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করলেও এই জঙ্গি দলটির শীর্ষ নেতা আবু বকর আল বাগদাদিকে নিয়ে পরস্পরবিরোধী খবর এসেছে বিভিন্ন সময়ে। 

রাশিয়া দাবি করেছিল, বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন বাগদাদি। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তার একটি অডিও বার্তা প্রকাশিত হয়। আর নভেম্বরে হিজবুল্লাহ পরিচালিত একটি সাইটে বলা হয়, আইএস নেতা বাগদাদিকে সিরিয়ায় দেখা গেছে। তার মৃত্যু হয়েছে, না তিনি বেঁচে আছেন- তা স্পষ্ট হয়নি বছর শেষেও। 

স্বর্গপত্রে গোমর ফাঁস

গতবছরের পর এবার ফেটেছে ‘প্যারাডাইস পোপার্স’ বোমা; বারমুডাভিত্তিক ল ফার্ম প্রতিষ্ঠান অ্যাপলবির এক কোটি ৩৪ লাখ গোপন নথিতে ফাঁস হয়েছে বিভিন্ন দেশের বহু প্রভাবশালীর গোপন সম্পদের খবর। 

অফশোরে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে কর ফাঁকির পথ বাতলে দিত অ্যাপলবি। প্যারাডাইস পেপার্স নামে ফঁস করা এসব নথিতে ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ, প্রিন্স চার্লস, মার্কিন মন্ত্রী উইলবার রসসহ অনেক রথী মহারথীর নাম এসেছে।

অ্যাপল, নাইকি ও উবারসহ প্রায় ১০০ বহুজাতিক কোম্পানির কর পরিকল্পনার বিস্তারিত প্রকাশ পেয়েছে এসব নথিতে। কানাডার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির প্রধান তহবিল সংগ্রাহক স্টিভেন ব্রনফম্যান এবং যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যান ও অন্যতম অর্থদাতা লর্ড অ্যাশক্রফটের অফশোর বিনিয়োগের তথ্যও ফাঁস হয়েছে।

গত বছর ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সের রেশ ছিল এ বছরও। অফশোর বিনিয়োগে পরিবারের সদস্যদের নাম আসার খেসারত দিতে হয়েছে পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফকে। আদালতে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে তাকে।

 

# মি টু

শুরুটা হার্ভি ওয়েইনস্টিনকে দিয়ে। হলিউডের নামকরা এ প্রযোজকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দুটি পত্রিকায় এলে সিনেজগতে হই চই পড়ে যায়। এরপর খ্যাতনামা অভিনেত্রীরাও ওয়েইনস্টিনকে নিয়ে অভিযোগ জানাতে শুরু করলে নড়েচড়ে বসে হলিউড। তারপর যেন খুলে যায় ‘ফ্লাড গেইট’।

গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও একের পর এক নির্যাতন, হয়রানি ও অসদাচরণের অভিযোগ আসতে থাকে। জনপ্রিয় উপস্থাপক, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর এমনকি সাবেক মার্কি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আসতে থাকে।

টুইটার ও ফেইসবুকে এ বিষয়ে সরব হয়ে ওঠেন নারীরা। চালু হয় ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগ। যুক্তরাষ্ট্রের গণ্ডি পেরিয়ে সে আন্দোলন ঢেউ তোলে সমগ্র বিশ্বে। যুক্তরাজ্যে যৌন অসাদচরণের অভিযোগ ওঠার পর পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইকেল ফেলন; পদত্যাগের ঘোষণা আসে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট সিনেটর আল ফ্রাঙ্কেনের কাছ থেকেও।

গতবছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ করা তিন নারী এবছর মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেশনাল তদন্তের দাবি তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন।

নারীদের এ আন্দোলন যে রাজনীতিতেও বিরাট প্রভাব ফেলেছে তার প্রমাণ মেলে আলাবামার সিনেট নির্বাচনে। রক্ষণশীলদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ওই স্টেটে রিপাবলিকান প্রার্থী রয় মুরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন নারী অভিযোগ করেন। তারা বলেন, কিশোর বয়সেই তারা মুরের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। মুর অস্বীকার করলেও দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ওই অভিযোগ। মোট ভোটের ২ শতাংশেরও কম ভোটে ডেমোক্রেট প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন মুর। সেখানে নারী ভোটারদের ভূমিকা গণনার সময়ই স্পষ্ট হয়।

নারীদের এ অভূতপূর্ব আন্দোলনকে ২০১৭ সালে বর্ষসেরার স্বীকৃতি দেয় টাইম ম্যাগাজিন।

মার্কিন মুল্লুক নারীদের গণজোয়ার দেখেছিল বছরের শুরুতেও। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথের পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষ নারীদের ডাকে উইমেন্স মার্চে সংহতি জানায়।

 

অধরা স্বাধীনতা

স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে এ বছর জোর চেষ্টা চালিয়েছিল কাতালুনিয়া। স্পেনের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটি এজন্য একটি গণভোটেরও আয়োজন করে, যা নিয়ে মাদ্রিদের সঙ্গে তুমুল বিরোধ সৃষ্টি হয়। গণভোটকে অবৈধ ঘোষণা করে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত, ভোটের দিন পুলিশ চালায় নির্যাতন, ধর-পাকড়।

গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনের সূত্র ধরে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় কাতালান পার্লামেন্ট। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেয় মাদ্রিদ, পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় নতুন নির্বাচনের ডাক।

বিদ্রোহ ও অর্থ অপচয়ের অভিযোগে কাতালান মন্ত্রীদের বিচারও ‍শুরু হয়। আটকের ভয়ে বেলজিয়ামে পালিয়ে যান স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা কাতালান প্রেসিডেন্ট কার্লেস পুজদেমন। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও পরে তা তুলে নেওয়া হয়।

মাদ্রিদের বিরোধীতা ও কোনো দেশের স্বীকৃতি না মেলায় বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। কাতালান নেতারাও আঞ্চলিক পার্লামেন্টের নতুন নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হন।

বছরের শেষে এসে সেই নির্বাচনেও স্বাধীনতাপন্থিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এই বিজয়ে সঙ্কটের সমাধানে স্পেন সরকারের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেন কার্লেস পুজদেমন।

স্বাধীনতার স্বপ্নে সেপ্টেম্বরে গণভোট হয় উত্তর ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তানেও, যাকে অবৈধ অ্যাখ্যা দেয় বাগদাদ। ভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পেয়ে স্বাধীন কুর্দিস্তানের পথে এগিয়ে যায় আঞ্চলিক সরকার। যদিও এ নিয়ে বাগদাদের পাশাপাশি হুঁশিয়ারি আসে তুরস্ক, ইরান ও সিরিয়ার কাছ থেকেও। আইএসের সঙ্গে লড়াইয়ে কুর্দি পেশমেরগা বাহিনী কিরকুক শহরের নিয়ন্ত্রণ নিলেও গণভোট নিয়ে টানাপোড়েনে বাগদাদের কাছে শহরটির নিয়ন্ত্রণ হারায় তারা।

মুগাবে যুগের সমাপ্তি

নভেম্বরের শুরুতে ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়াকে বরখাস্ত করা নিয়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বে এ বছর ক্ষমতাচ্যুত হন ৩৭ বছর ধরে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা রবার্ট মুগাবে। নানগাগওয়াকে মুগাবের উত্তরসূরি ভাবা হলেও তাকে বরখাস্তের পর সে জায়গায় ফার্স্ট লেডি গ্রেস মুগাবের নাম সামনে চলে আসে। 

রাজনৈতিক ওই টালমাটাল পরিস্থিতিতে ১৫ নভেম্বর রাতে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন স্টেশন দখল করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়, আটক করা হয় গ্রেসের অনুসারী মন্ত্রী ও যুব নেতাদের।

দলের ভেতরে প্রচণ্ড চাপে পড়ে ছয় দিন পর ‘গৃহবন্দি’  মুগাবে প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন; হারারাতে শুরু হয় উল্লাস। অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পালন করার জন্য এমনানগাওয়া যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ঠাঁই হয় সেনা কর্মকর্তাদেরও।

দুর্যোগ, দুর্ঘটনা

এ বছর তিন সপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যাবিরীয় অঞ্চল। অগাস্টের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে চার মাত্রার ঝড় হার্ভি ও এরপর সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় হিউস্টনের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। ৯০ জনের মৃত্যু ছাড়াও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৯৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এর আগে এত ক্ষতি কখনো হয়নি।

দশ দিনের ব্যবধানে এর চেয়েও শক্তিশালী ঝড় আরমা ক্যারিবীয় দ্বীপের দেশগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এক শতকের মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগর ও মেক্সিকো উপকূলে সৃষ্ট সবচেয়ে শক্তিশালী এ ঝড়ে অন্তত ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়। ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় ৬৩ বিলিয়ন ডলার।

দুই সপ্তাহের মধ্যে হারিকেন মারিয়া পাঁচ মাত্রার ঝড় হয়ে ডোমিনিকায় আঘাত হানে; এ ঝড়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ৯৪, ক্ষতি ১০৩ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্বজুড়ে এ বছর ঝড়, ভূমিকম্প ও বন্যার মাত্রা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বরে মেক্সিকোর কেন্দ্রে ৭ দশমিক ১ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে সাড়ে তিনশর বেশি মানুষ নিহত হয়; দুই মাসের মাথায় ইরাক-ইরান সীমান্তে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে যায়।

তামিলনাড়ু বন্যা, রেকর্ড বৃষ্টিতে জাপানে বন্যা ও ভূমিধস, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় কয়েক দফা দাবানল, আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে খরা ও অনাবৃষ্টি, বছরের শেষ প্রান্তে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট আগুংয়ে অগ্ন্যুৎপাত সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।

দুর্যোগের সঙ্গে বড় কয়েকটি দুর্ঘটনাও এ বছর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

জুনে পশ্চিম লন্ডনের ২৪ তলা
অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৭৯ জনের মৃত্যুর খবর পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ায় একটি বোর্ডিং স্কুলে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ২৩ জনের, যাদের অধিকাংশই শিশু। 

পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর জুনে তেলের লরিতে লাগা আগুনে পুড়ে অন্তত ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়। নভেম্বরে কঙ্গোতে একটি ট্রেনে আগুন ধরে গেলে অন্তত ৩০ জনের প্রাণ যায়। 

জানুয়ারিতে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে ট্রেন দুর্ঘটনায় ৩৬ জন এবং অগাস্টে মুজাফফরনগরের ২৩ জন মারা যায়। মে মাসে উত্তর প্রদেশে একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত হয় অন্তত ২২ জন।  

পদ্মফুলে কাঁটা

ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিজয় রথ বছর জুড়ে যে বেগে ধাবিত হচ্ছিল, শেষ দিকে নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাটের ভোটে এসে তার গতি খানিকটা কমে এসেছে। 

গোয়া, উত্তরখাণ্ড, উত্তরপ্রদেশ ও মণিপুর রাজ্যের মত হিমাচলেও বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্মফুল। কিন্তু গুজরাটে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ডানপন্থি এ দলটিকে ভাবিয়ে তুলেছে।

উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেই রাজ্যের সব কসাইখানা বন্ধের নির্দেশ দেয়া যোগী আদিত্যনাথও এ বছর ভারতের রাজনীতির অন্যতম আলোচিত চরিত্র। গোমাংস খাওয়া ও বিক্রিকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুরা বেশ কয়েকজন মুসলমানকে হত্যা করেছে এ বছর। উগ্রপন্থিদের হামলায় এ বছরই নিহত হয়েছেন বামপন্থি সাংবাদিক গৌরি লঙ্কেশ

এ বছরই ভারতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষ হয় বাঙালি প্রণব মুখার্জির, তার স্থলাভিষিক্ত হন রামনাথ কোবিন্দ। বছরের শেষভাগে এসে নেতৃত্বের বদল ঘটে ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসেও। সোনিয়া গান্ধী তার ১৯ বছরের দায়িত্ব ছাড়েন ছেলে রাহুল গান্ধীর হাতে।

জম্মু ও কাশ্মিরের বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতাকে আটক করে ভারতীয় পুলিশ,
হন কয়েকজন। আলাদা রাজ্যের দাবিতে চলতি বছর উত্তাল ছিল
। ধর্ষণের মামলায় বিতর্কিত ধর্মগুরু
সাজা নিয়ে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় তুলকালাম বেঁধে যায়।

বছরের মাঝামাঝি ভুটান সীমান্তের ডোকলামে সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন মুখোমুখি অবস্থানে গেলেও পরে তা বেশি দূর এগোয়নি।

বেশ কয়েকটি জঙ্গি দল এ বছরও পাকিস্তানে বেশ কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে। আদালতের আদেশে মুক্তি হয়েছে বিতর্কিত নেতা হাফিজ সাঈদের। আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছে কট্টরপন্থি গোষ্ঠীগুলো।

নেপালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে এ বছর জয়ী হয়েছে বামপন্থি জোট। দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধ শেষে, রাজতন্ত্রের পতনেরও এক দশক পর নতুন সংবিধানের অধীনে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে তারা নেপালি কংগ্রেসের জোটকে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে ধরাশায়ী করে।

নেপালে বামদের এই বিজয় দেশটিতে চীনের প্রভাব আরও পোক্ত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাধ্যন্য বিস্তারের ক্ষেত্রে আরও খানিকটা এগিয়ে গেছে চীন।