মুগাবে হিরো না ভিলেন?

গত ৩৭ বছর ধরে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা রবার্ট মুগাবে পদত্যাগ করেছেন। একাধিক কাজের জন্য তিনি যেমন প্রশংসা পেয়েছেন, তেমনি অনেককিছুর জন্যই নিন্দা-সমালোচনার পাত্র হয়েছেন দেশে এমনকি বিদেশেও।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2017, 06:23 PM
Updated : 22 Nov 2017, 10:51 AM

তাই চারদশকের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো মুগাবেকে এখন মানুষ ‘হিরো’ নাকি ‘ভিলেন’ কোন চোখে দেখবে প্রশ্ন সেটি।

বিষয়টি নিয়ে এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বিবিসি বলছে, কারও কারও কাছে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে আসা এবং শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসনের অবসান ঘটানো মুগাবে একজন ‘হিরো’ হয়েই থাকবেন। এমনকি তার প্রতিকূলে যারা কাজ করেছেন তাদেরও কেউ কেউ তাকে নায়কের আসনে বসাতে পারেন।

কিন্তু যারা উত্তোরত্তর তার সমালোচনা করে চলেছেন তাদের কাছে এই উচ্চশিক্ষিত, চতুর রাজনীতিবিদ মুগাবে আফ্রিকান স্বৈরশাসকের এক ব্যঙ্গচিত্র রূপেই থেকে যাবেন। যিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে গোটা দেশকেই ধ্বংস করে দিয়েছেন।

১৯৮০ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর গত ৩৭ বছর ধরে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন মুগাবে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া মুগাবে আফ্রিকার জাতির পিতাদের একজন। স্বাধীনতার একজন যোদ্ধা হিসাবে ক্ষমতায় এসে জিম্বাবুয়ের ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’ হিসাবে বীরোচিত সম্মান ও খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি।

১৯৮১ সালে মুগাবে নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন। প্রতিবেশী দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৪ সালে তিনি জাতিগত বিদ্বেষ অবসানের অন্যতম দৃঢ় সমর্থক ছিলেন।

জিম্বাবুয়ে ও ব্রিটেনের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে অবদানের জন্য নাইট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছিলেন মুগাবে। ১৯৯৪ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে  নাইটহুড দেন। তারপরও যুক্তরাজ্যে তিনি  থেকেছেন ভিলেনের আসনেই।

ওদিকে, আফ্রিকায় অনেক মানুষের ধারণা, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থেকে মুগাবে জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি, গণতন্ত্র এবং বিচার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। বিরোধীদের দমনে তিনি নৃশংসতার আশ্রয়ও নিয়েছেন।

গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কারণে মুগাবের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। মতবিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন নায়ক মুগাবেকে দিন দিন জনগণের চোখে ‘খলনায়ক’ করে তুলেছে।

২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে যে মুগাবে বলেছিলেন “নির্বাচনে হার মানেই জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে, তাহলেই বুঝতে হবে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে।” কিন্তু সেই মুগাবেই নির্বাচনে মর্গান সাভাঙ্গিরাইয়ের কাছে হারের পর ক্ষমতায় অটল থেকে বলেছিলেন, “কেবল ঈশ্বরই তাকে সরাতে পারেন।”

এরপরই মুগাবের ক্ষমতার হাল শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টায় ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। সাভাঙ্গিরাই তার অনুসারীদের জীবন বাঁচাতে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। মুগাবে পরে চার বছরের জন্য দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বাধ্য হলেও প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যান।

তার সঙ্গে কয়েকবছরের কাজে সাভাঙ্গিরাই বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর পর ২০১৩ সালের নির্বাচনে আরেকবার জয় পান মুগাবে। কিন্তু তারপরও দেশে অর্থনৈতিক সংকট ঘণীভূত হওয়াও ছিল তার জনপ্রিয়তা কমার আরেকটি কারণ।

মুগাবে বরাবরই জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক সমস্যাকে যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীনে পশ্চিমা দেশগুলোর তাকে উৎখাতের একটি চক্রান্ত বলে দোষারোপ করে এসেছেন। শ্বেতাঙ্গ-মালিকানাধীন ফার্মগুলো জব্দ করার কারণে পশ্চিমারা তাকে উৎখাতের এ চক্রান্ত করেছে বলে যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি।

তবে তার সমালোচকরা বলে আসছেন, আধুনিক অর্থনীতি কিভাবে পরিচালিত হয় সে বিষয়টিই মুগাবে বোঝেন না। অর্থনীতির বিকাশ কিভাবে ঘটানো যাবে সে বিষয়টি তিনি কখনও গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি।

২০০০ সালে রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টায় জিম্বাবুয়ের অর্থনীতির মেরুদণ্ড শ্বেতাঙ্গ-মালিকানাধীন ফার্মগুলো জব্দ করার মাধ্যমে মুগাবে দেশের বহুমুখী অর্থনীতির ধ্বংস ডেকে এনে প্রথম জোরাল বিরোধিতার মুখে পড়েন। এরপর আরও ১৭ বছর ক্ষমতায় থেকে যান তিনি।

২০০৯ সালে জিম্বাবুয়েতে অর্থনৈতিক ধসের মাঝে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন সাভাঙ্গিরাই। টালমাটাল ওই জাতীয় ঐক্য সরকারে তিনি মুগাবের সঙ্গে চার বছর নেতৃত্ব দেন।

মুগাবের কঠোর নীতি দেশকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে। শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ দেশের অর্থনীতিকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে গেছে। কমে গেছে কৃষিখাতে অবদান। বেড়ে গেছে মুদ্রাস্ফীতি।

অর্থনীতিতে এমন ধসের পরও মুগাবে আর তার স্ত্রীর বিলাসবহুল জীবনযাপনও দশকের পর দশক ধরে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে।

সর্বশেষ এ বছর মুগাবে তার দীর্ঘদিনের মিত্র ভাইস প্রেসিডেন্ট নানগাওয়াকে বরখাস্ত করার পদক্ষেপ নিলে তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পট প্রস্তুত হয়।

সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাওয়াকে তার উত্তরসূরি বিবেচনা করা হলেও গত মাসে হঠাৎ করে সরকার ও দলীয় পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করেন মুগাবে। স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে নানগাওয়াকের মত অভিজ্ঞ নেতাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

দলের উত্তসূরি নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে সেনাবাহিনী এক সপ্তাহ আগেই জিম্বাবুয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুগাবেকে গৃহবন্দি করে এবং শেষপর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।