জ্যাকোব মুন্ডেডাকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে স্বেচ্ছায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মুগাবে একটি চিঠিতে লিখেছেন।
১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর গত ৩৭ বছর ধরে দেশটি শাসন করে আসছেন মুগাবে। ৯৩ বছর বয়সী মুগাবেই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী নেতা।
দলের উত্তরসূরি নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে গত সপ্তাহে সেনাবাহিনী জিম্বাবুয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়, মুগাবেকে করে গৃহবন্দি। এরপর তার পদত্যাগ দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হলেও ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাওয়াকে তার উত্তরসূরি বিবেচনা করা হলেও গত মাসে হঠাৎ করে সরকার ও দলীয় পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করেন মুগাবে। স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে নানগাওয়াকের মতো অভিজ্ঞ নেতাকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
তার দুদিনের মাথায় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মুগাবের দল জিম্বাবুয়ের ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ পার্টির পক্ষ থেকেও জনপ্রিয়তা হারানো এই নেতাকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়।
সেই আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় রোববার জানু-পিএফ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মুগাবেকে দলীয় প্রধানের পদ থেকে বহিষ্কার করে, নানগাওয়াকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
ওই বৈঠক থেকেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য মুগাবেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে দেশকে স্বাধীন করে এক সময় পুরো মহাদেশে উপনিবেশবিরোধী মুক্তির নায়কে পরিণত হয়েছিলেন ‘গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান’ মুগাবে।
প্রতিবেশী দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৪ সালে জাতিগত বিদ্বেষের অবসানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান জানানো নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। জিম্বাবুয়েতে শ্বেতাঙ্গদের মালিকানাধীন কোম্পানির দখল নেয় তার মুগাবের অনুসারী মিলিশিয়া।
কালোদের নেতা মুগাবে পাশ্চিমা দেশগুলোতেও ‘থিংকিং ম্যানস গেরিলা’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। মুগাবে উচ্চশিক্ষার সাতটি ডিগ্রি নিয়েছিলেন, যার তিনটি অর্জন করেন কারাবাসে থেকে।
বিবিসি লিখেছে, জিম্বাবুয়ের অনেকের কাছে নিন্দিত রবার্ট মুগাবে দেশটির অনেকের কাছে নায়ক হয়ে থাকবেন, এমনকি তার বিদায়ের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অনেকের কাছেও। মুগাবেবিরোধী আন্দোলনের অনেকে তার এই অবস্থার জন্য স্ত্রী গ্রেস মুগাবে ও তার কাছের কিছু লোককে দায়ী করছেন।
সে সময় যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়, সেগুলোর অন্যতম ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ওই বিশ্ববিদ্যালয়।
সেখান থেকে ১৯৬০ সাল জন্মভূমি তৎকালীন রোডেশিয়ায় ফিরে রাজনীতিতে আসেন মুগাবে। চার বছরের মাথায় তাকে কারাবন্দি করে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের সরকার।
প্রায় এক দশক কারান্তরীণ থেকে মুগাবে যখন মুক্তি পান তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে থাকা প্রভাবশালী জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান লিবারেশন আর্মির শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসেন তিনি।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানে নেতৃত্ব দেওয়া গেরিলা যোদ্ধা মুগাবে স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন রবার্ট মুগাবে। দুই দফা প্রধানমন্ত্রী থাকার পর সংবিধান সংশোধন করে ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার কিছু দিন আগে মুগাবের প্রথম স্ত্রী স্যালি মারা যান। ১৯৯৬ সালে প্রায় ৪০ বছরের ছোট গ্রেস মারুফুকে বিয়ে করেন তিনি।
গত শতকের শেষ দিকে ভূমি সংস্কারে ধীরগতি নিয়ে কালোদের ক্ষোভের প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংশোধন নিয়ে গণভোটে হেরে যান মুগাবে। তারপর জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধা পরিচয় দেওয়া সশস্ত্র কালোরা শ্বেতাঙ্গদের মালিকানাধীন কোম্পানির দখল নেন।
তাকে উপনিবেশিক শাসনের অবিচারের প্রতিবিধান বলে বৈধতা দেন মুগাবে। তারপর থেকেই পশ্চিমাদের কঠোর সমালোচনার মুখে ছিলেন তিনি।
পরের বছর মুগাবে নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য সরকারে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন সাভাঙ্গিরাই। অর্থনৈতিক ধসের মধ্যে দায়িত্ব নেওয়া ওই সরকারের চার বছরে সাভাঙ্গিরাই জনপ্রিয়তা হারান। এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনে আবার জয়ী হন মুগাবে।
দেড় দশক আগে জিম্বাবুয়েতে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকট আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি মুগাবে। সমালোচকদের মতে, জাতীয় সম্পদ বণ্টন নিয়ে তিনি যতোটা ভেবেছেন, তা কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে ততোটা নজর দেননি।
মুগাবে বরাবরই জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক সমস্যাকে যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীনে পশ্চিমা দেশগুলোর তাকে উৎখাতের একটি চক্রান্ত বলে দোষারোপ করে এসেছেন। শ্বেতাঙ্গ-মালিকানাধীন ফার্মগুলো জব্দ করার কারণে পশ্চিমারা তাকে উৎখাতের এ চক্রান্ত করেছে বলে যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি।
এছাড়া মতবিরোধীদের থামাতে দমন-পীড়নের আশ্রয় নেওয়ায় নায়ক মুগাবে দিন দিন জনগণের চোখে ‘খলনায়কে’ পরিণত হতে থাকেন বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভাষ্য।