কলেজ জীবনের প্রেমিকাকে ওবামার লেখা চিঠি প্রকাশ

এই পৃথিবীতে নিজের অবস্থান, অর্থ, বিত্ত, শ্রেণি আর বর্ণপরিচয় নিয়ে উদ্বেগ ছিল কলেজপড়ুয়া বারাক ওবামার মনে; শঙ্কা ছিল, কমিউনিটি সংগঠক হিসেবে কাজ করার মত যথেষ্ট টাকা তিনি জোগাড় করতে পারবেন কি না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2017, 06:24 AM
Updated : 20 Oct 2017, 06:36 AM

সাবেক প্রেমিকা আলেকসান্দ্রা ম্যাকনিয়রের পাশে কতটা মানানসই, সে প্রশ্নও ছিল তরুণ ওবামার মনে।

উনিশশ আশির দশকে ম্যাকনিয়রকে লেখা প্রেমপত্রের পাতায় পাতায় রয়েছে ভবিষ্যতের মার্কিন প্রেসিডেন্টের হৃদয়ের সেই দোলাচলের বিবরণ। গত তিন বছর ধরে এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে সংরক্ষিত ৩০ পৃষ্ঠার ওই নয়টি চিঠি সম্প্রতি গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। 

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ম্যাকনিয়রকে চিঠিগুলো লেখেন ওবামা। ক্যালিফোর্নিয়ায় একই কলেজে পড়ার সময় তাদের পরিচয়।

ওবামার সঙ্গে মিশেলের পরিচয় হয় আরও পাঁচ বছর পর, যা পরে পরিণয়ে গড়ায়।

শুরুর দিকের এক চিঠিতে ওবামা লেখেন, ম্যাকনিয়রকে নিয়ে তার ভাবনা যেন বাতাসের মত বিস্তৃত, ম্যাকনিয়রের প্রতি তার আস্থা সাগরের মতই গভীর। সেই ভালোবাসার দাম বড় বেশি, বড় বেশি বেদনাময়।   

টানা হাতে লেখা ওবামার চিঠিগুলোতে ওবামা তার প্রেমিকাকে সম্বোধন করেছেন ‘প্রিয় অ্যালেক্স’ বলে। আর চিঠির শেষ হয়েছে ‘লাভ, বারাক’ শব্দ দুটো দিয়ে। 

চিঠি লেখার ওই দিনগুলোতেই ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যান ওবামা। সেখান থেকে চলে যান শৈশবের দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। পরে বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে চাকরি নেন।  

দূর থেকে ম্যাকনিয়রের সঙ্গে ওবামার এই প্রেম ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। ১৯৮৩ সালে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “প্রায়ই তোমার কথা ভাবি। তবে আমার অনুভূতি আসলে কী বলছে, আমি নিশ্চিত নই।

“মনে হয়, যা পাওয়ার নয় তাই আমরা চাই। সেই চাওয়াই আমাদের মিলিয়ে দেয়, সেটাই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটায়।”

এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুয়ার্ট এ রোজ ম্যানুস্ক্রিপ্ট, আর্কাইভস অ্যান্ড রেয়ার বুক লাইব্রেরির পরিচালক রোজমেরি ম্যাগি বলেন, “এই চিঠিগুলো এক তরুণের অভিযাত্রার গল্প বলছে, যে খুঁজে বেড়াচ্ছে বেঁচে থাকার অর্থ, জীবনের উদ্দেশ্য আর আগামী দিনের দিক নিশানা। যে বুঝতে চাইছে, সময়ের বুকে কোথায় হবে তার স্বতন্ত্র অবস্থান।”

ওবামা লিখেছেন, বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে চাকরি হওয়ার পর সবাই খুব পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল। সেখানে তাকে বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল মানি রিপোর্টের জন্য নিউজলেটার লিখতে হত। কিন্তু সেই কাজে তিনি মোটেও আগ্রহ পাচ্ছিলেন না।

মনের সঙ্গে সেই টানাপোড়েনের কথা ১৯৮৩ সালে এক চিঠিতে ম্যাকনিয়রকে জানিয়েছিলেন ওবামা।

“কমিউনিটি অর্গানাইজেশনে কাজ করতে গেলে যা বেতন পাব, তা দিয়ে টিকে থাকা কঠিন। আশা করছি এ বছরটা এ চাকরি চালিয়ে যেতে পারলে ভবিষ্যতে নিজের পছন্দের কাজে মন দেওয়ার জন্য কিছু পয়সা জমাতে পারব।”  

ওবামার চিঠিগুলো বেশিরভাগই লেখা হয়েছে কলেজ নোটবুকের রুলটানা সাদা আর হলুদ পৃষ্ঠায়। একটি চিঠি ম্যাকনিয়রকে পাঠানো হয়েছে ‘বারাক ওবামা’ নামঙ্কিত বিজনেস ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনের খামে। 

একটি চিঠিতে ওবামা লিখেছেন সেই সময়ের কথা, যখন তার সব বন্ধুরা লেখাপড়া শেষ করে পারিবারিক ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছে। 

কিন্তু হাওয়াইয়ে এক কেনীয় বাবার ঘরে জন্ম নেওয়ার পর কৈশোরের বড় একটা সময় ইন্দোনেশিয়ায় কাটানো ওবামার জন্য বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।

সে সময় বন্ধুদের দেখে যে ঈর্ষা হয়েছিল, সে কথা ওবামা অকপটে স্বীকার করেছেন তার চিঠিতে।

ওই সমাজের কোনো শ্রেণি, কোনো কাঠামো বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ওবামা নিজেকে মেলাতে পারছিলেন না। তার মনে হচ্ছিল, ভবিষ্যৎ হয়ত অন্য কোনো পথ ঠিক করে রেখেছে তার জন্য।  

“কেবল একটি পথেই নিঃসঙ্গতার এ বোধ থেকে আমার মুক্তি মিলতে পারে, আর তা হল সব শ্রেণি, সব সংস্কৃতিকে নিজের করে নেওয়া, নিজেকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।”

ওবামার জন্য তা সহজ হয়নি।

১৯৮৩ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে তিনি আবিষ্কার করলেন, অনেক কিছুই আর আগের মত নেই। ইন্দোনেশিয়ার ভাষা তিনি আর ভালোভাবে বলতে পারছে না। সবাই তাকে অন্য চোখে দেখছে, কারণ তিনি তখন আমেরিকান।  

“আমার টাকা, আমার আমেরিকা থেকে আসার প্লেন টিকেট যেন আমার গায়ের রঙকে ঢেকে দিচ্ছে। 

“রাস্তাগুলো তেমনই আছে, মাঠের পাশে ঘরবাড়িগুলো আগের মতই ভাঙাচোড়া, আমার চেনা পথগুলো… কেবল সেখানে আমার প্রবেশাধিকার নেই।”  

রোজ লাইব্রেরির কর্মকর্তারা বলছেন, ‘কাব্যময়’ চিঠিগুলোতে তরুণ ওবামার মনোজগতে ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নেওয়ার তীব্র আকুতি ফুটে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত তা তাকে পৌঁছে দিয়েছে হোয়াইট হাউজে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

ওবামা ১৯৮৪ সালে ম্যাকনিয়রকে লেখেন, “স্কুলে পড়ার সময় আমার ধারণাগুলো যতোটা জমাট বাধা ছিল, এখন আর তেমনটা নেই। এখনকার ভাবনাগুলোর যে তাৎক্ষণিকতা আর ভার নিয়ে আসছে, তা হয়ত আরও বেশি  কার্যকর হবে, যদি আমি কেবল দর্শকের ভূমিকায় না থেকে আরও একটু সক্রিয় হই।”  

এসব চিঠির কিছু অংশ ইতোমধ্যে ওবামাকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ নয়টি চিঠি উন্মুক্ত হওয়ায় গবেষকদের জন্য তা নতুন ভাবনার খোরাক যোগাবে বলে আশা করছে এমরি কর্তৃপক্ষ।