চীনের নোবেল জয়ী লিউ জিয়াওবো মারা গেছেন

নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী চীনা ভিন্নমতাবলম্বী লিউ জিয়াওবো মারা গেছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2017, 02:32 PM
Updated : 13 July 2017, 05:10 PM

চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শেনইয়াং নগরীর সরকার বৃহস্পতিবার এ মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে। সেখানে তার লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল।

শেনইয়াংয়ের ‘ব্যুরো অব জাস্টিস’ এক বিবৃতিতে তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, ৬১ বছর বয়স্ক লিউয়ের কয়েকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অচল হয়ে পড়েছিল। ফলে তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

চীনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য কাজ করে যাওয়া লিউ ২০১০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার অভিযোগে তাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল চীন সরকার। 

চীনে আমূল রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে ‘চার্টার ৮’ শীর্ষক একটি পিটিশনও সই করেছিলেন লিউ। এটি ছিল চীনে একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনার আহ্বান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর থেকে মানবাধিকার প্রচারকর্মী হওয়া লিউকে অপরাধীর তকমা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তার মৃত্যুর জন্য চীন সরকার ‘গুরুতরভাবে দায়ী’ বলেই জানিয়েছে নোবেল কমিটি।

কে এই লিউ জিয়াওবো?

লিউ জিয়াওবো ১৯৫৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর চীনের জিলিন প্রদেশের চাংচুং শহরে এক শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।

১৯৭৭ সালে জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন। এরপর  ১৯৮২ সালে গ্রাজুয়েশন করে বেইজিংয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা সাহিত্যের গবেষণা ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন। ১৯৮৪ সালে এম.এ. পাশের পর একই বিভাগের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন।

তিনি একাধারে লেখক, চীনা সাহিত্য সমালোচক এবং মানবাধিকার কর্মী।

১৯৮৯ সালের জুনে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আলোচনার মধ্য দিয়ে বিক্ষোভকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে তিনি কয়েকশ’ প্রতিবাদকারীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন।

তিয়েনআনমেন স্কয়ারে আটক বিক্ষোভকারীদের মুক্তির দাবি জানানোয় তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯১ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এরপর তিনি আবারও গণতন্ত্রের জন্য প্রচারাভিযান শুরু করেন।

চীনা মূল ভূখন্ডের বাইরের প্রচারকর্মীদের কাছেও লিউ গণতন্ত্রের পক্ষে সরব একজন ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত ছিলেন। জেলে থাকা অবস্থাতেই তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য লিউকেই সম্ভবত সবচেয়ে চড়া মূল্য দিতে হল বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে নোবেল কমিটি।

রাজনৈতিক বিরোধিতার মূল্য

চীন কর্তৃপক্ষ মৃত্যুমুখেও লিউ এর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল। বরং রাষ্ট্রের কড়া নজরদারির মধ্যেই লিউ মারা গেলেন।

এই নোবেল জয়ীর জীবন এবং মৃত্যুই দেখিয়ে দিয়েছে চীনে রাজনৈতিক বিদ্রোহের মূল্য কি হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নির্বিঘ্নই ছিল লিউয়ের জীবন। কিন্তু তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের গণহারে হত্যার ঘটনাটিই লিউয়ের চলার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

রক্তক্ষয়ী সেই বিক্ষোভের পর অনেকেই গণতন্ত্রের দাবি ছেড়ে দিলেও লিউ অটল ছিলেন এবং কর্তৃপক্ষ তাকে বার বার জেলে পাঠিয়েছে। ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সময়টিতেও তিনি ১১ বছরের জেল খাটছিলেন।

জেল থেকে হাসপাতালে

লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর কারাগার থেকে লিউকে শেনইয়াংয়ের একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

এরপর থেকেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দেশের বাইরে পাঠাতে চীনের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ে।

মৃত্যুর কিছুদিন আগে লিউয়ের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

কয়েকটি পশ্চিমা দেশ চীনকে লিউয়ের সুচিকিৎসার জন্য অন্য কোনও দেশে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল।

জার্মানি এবং আমেরিকা থেকে দুজন ডাক্তারও শেনইয়াংয়ের হাসপাতালে লিউয়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে পরীক্ষা করার পর বলেছিলেন, বিদেশে ভ্রমণ করার মতো শারিরীক অবস্থা তার আছে।

কিন্তু চীনা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, লিউ বিদেশে ভ্রমণ করতে সক্ষম নন।

শেনইয়াং এর ফার্স্ট হসপিটাল জানায়, হাসপাতালে ভর্তি করার পরপরই লিউয়ের অবস্থার অবনতি হয়েছিল। কয়েকদিন ধরে তাকে ইনফেকশন প্রতিরোধী চিকিৎসা দিয়ে এবং রক্তের চিকিৎসা করেও অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি।

মৃত্যুর আগে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে পড়ে এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তাকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই বিফলে যাওয়ায় তার মৃত্যু হয়।