ক্ষমতা নেওয়ার আগে হট্টগোলে ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করার পর এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তার দায়িত্ব নেওয়ার আর বাকী মাত্র চারদিন। এরই মধ্যে নানা সংঘাত, হুমকি আর হঁশিয়ারির হট্টগোলে পড়েছেন ট্রাম্প।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2017, 07:21 PM
Updated : 16 Jan 2017, 08:07 PM

পট প্রস্তুত হচ্ছে নাটকীয় পরিবর্তন, দলীয় কোন্দল আর অনিশ্চিত ফলাফলের একটি টালমাটাল শাসনামলের।

ট্রাম্প তার আগের অনেক প্রেসিডেন্টের তুলনায়ই কম জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিচ্ছেন। আমেরিকানদের অনেকেই তার এ দায়িত্ব সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান।

দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন ট্রাম্প। সংবাদ জগতের সঙ্গেও তার আছে দ্বন্দ্ব। রাশিয়ার প্রতি তার উষ্ণ মনোভাবের কারণে এটি নিয়েও সমালোচনার ঝড় মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে তাকে।

তাইওয়ান নিয়ে ট্রাম্পের কার্যকলাপে তাকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে চীন। তাইওয়ান নিয়ে ট্রাম্প চীনকে উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করলে বেইজিং এর শক্ত জবাব দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে এরই মধ্যে।

ওদিকে, মেক্সিকো হুমকি দিয়ে বলেছে, ট্রাম্প সীমান্ত কর আরোপ করলে এর জবাব দেবে তারা।

অন্যদিকে, তার ওপর ডেমোক্র্যাটদের আক্রোশ তো আছেই। সবচেয়ে বাঘা বাঘা ডেমোক্র্যাটরাও ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়েননি।

দায়িত্ব নিতে চলা যে কোনও প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রেই এত বিতর্ক, এত সংকট নতুন হোয়াইট হাউজের জন্য আগাম রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসার সংকেতই বয়ে আনবে।

সাধারণভাবে এত হট্টগোলের ঘেরাটোপে কোনও রাজনীতিবিদের মুষড়ে পড়ার কথা। কিন্তু ট্রাস্প দিব্যি কোনওকিছুর তোয়াক্কা না করেই চলছেন।

দেশে প্রেসিডেন্সির দুই শতাব্দী ধরে যে রীতি চলে আসছে তাও ট্রাম্প ওলট-পালট করে দিতে মনস্থির করেছেন। তার শাসন চালানোর সক্ষমতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন তাদের দিকে নজর দেওয়ারও যেন তার সময় নেই।

মোট কথা, তার দায়িত্ব নিতে চলার এ সময়টিতে নানা রাজনৈতিক ঝড় উঠেছে, যে ঝড়ের সূচনা করেছেন খোদ ট্রাম্পই।

সাফল্যের সোপান

“কেবল সময়ই বলতে পারে ট্রাম্প একজন নেতা হিসাবে সফল হবেন কিনা”, বলেছেন এক মার্কিন ইতিহাসবিদ। 

সতর্ক করে দিয়ে ইতিহাসবিদ টিমোথি নাফতালি বলেন, “ট্রাম্প প্রায়ই আলাদা নিয়ম-কানুন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু ইতিহাস তা করবে না।”

তিনি বলেন, “আমরা জানি সাফল্যের সোপানগুলো বদলায়নি। এখনও সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে: জনমত, বিল পাস হওয়া, বিশ্বব্যাপী আস্থা অর্জন, দেশে আস্থা গড়ে তোলা, অর্থনীতি মজবুত হওয়া। এগুলো সব একই আছে।”

“ট্রাম্প নতুন ধারার প্রেসিডেন্ট আমলের সূচনা করার পথে হাঁটছেন। প্রতিটি প্রেসিডেন্টের তা করার অধিকারও আছে। কিন্তু তিনি যতই নতুনের পথে হাঁটুন তাকে মানুষ পরীক্ষা করবে সেই পুরোনো বিষয়গুলোর নিরীখেই।”

ট্রাম্প তার প্রশাসনের কাজ শুরু করবেন জনমতে একটা অনেক বড় ঘাটতি নিয়ে।

অভিষেকের এক সপ্তাহ আগে গ্যালোপ জরিপে ট্রাম্পের পক্ষে জনমত দেখা গেছে মাত্র ৪৪ শতাংশ। অথচ তার আগে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নিজের অভিষেকের আসন্ন সময়টিতে জনসমর্থন ছিল ৮৩ শতাংশ। জর্জ ডব্লিউ বুশ ৬১ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং বিল ক্লিনটনের জনসমর্থন ছিল ৬৮ শতাংশ।

পিউ রিসার্চ জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৯ শতাংশ আমেরিকান ট্রাম্প যে নীতিমালার রূপরেখা দিয়েছেন সেটিকে সমর্থন করে। আবার গত সপ্তাহে কুইনিপিয়াক জরিপে ট্রাম্পের জনসমর্থন দেখা গেছে, মাত্র ৩৭ শতাংশ।

গ্যালোপ জরিপে আরও দেখা গেছে, ট্রাম্প সামরিক বাহিনীঠিকমত সামাল দিতে পারবেন কিনা, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংকট সামলাতে পারবেন কিনা এবং নিজ প্রশাসনে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি এড়াতে পারবেন কিনা তা নিয়ে ৫০ শতাংশ মানুষের প্রশ্নের মুখে আছেন তিনি।

অর্থনীতি সামাল দেওয়ার বিষয়টিতে ট্রাম্প কিছুটা সবল হলেও অন্যান্য প্রেসিডেন্টদের অভিষেকের এই একইরকম সময়টিতে তিনি তাদের চেয়ে জনসমর্থনে অনেক পেছনে পড়ে আছেন।

এত কম জনসমর্থন নিয়ে শাসনামল শুরু করলে ট্রাম্পকে প্রতি পদক্ষেপেই খুব সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ, ভুল করার কোনও সুযোগ তার থাকবে না বললেই চলে।

জনমত জরিপে পিছিয়ে থাকা প্রেসিডেন্টরা সাধারণত সংকটের সময় জনমত নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে তেমন সক্ষম হন না।

আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ‘থ্যাংক ইউ’ ট্যুরে গিয়ে সমর্থকদেরকে পাশে রাখতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। তার অভিষেক নিয়ে উদ্বিগ্ন লাখ লাখ আমেরিকানের সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলার ব্যাপারে তিনি প্রায় কিছুই করেননি।

আর ওই সময় থেকে শুরু করে অভিষেকের আগ পর্যন্ত এ সময়টিতে তিনি ব্যস্ত থাকছেন ট্যুইটারে ব্যক্তিগত বিরোধ উগরে দেওয়া নিয়ে, সিএনএন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের সমালোচনা করে এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কথার চেয়ে রাশিয়া আর উইকিলিক্স ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জের কথার ওপর বেশি ভরসা করে।

তবে টাম্প ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রেসিডেন্টের কাজে দক্ষতা দেখাতে পারলে অবশ্য তার জনসমর্থন চট করে বেড়ে যেতে সময় লাগবে না।

ভবিষ্যৎ সমস্যা

প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরবর্তী সময়ে ট্রাম্পের জন্য কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে এবং তার শাসনামলজুড়ে প্রশাসনিক পর্যায়ে সে সমস্যাগুলো বিরাজ করতে পারে।

এর আগে অনেক ধনী ব‌্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেও ট্রাম্পের মতো আর কেউ সম্পদের এত বিশাল ভান্ডার নিয়ে হোয়াইট হাউজে পৌঁছাননি। ব‌্যবসার দায়িত্ব সন্তানদের ওপরই ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে এসেছেন ট্রাম্প।

কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে করে ব‌্যবসায়িক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে ট্রাম্প পুরোপুরিভাবে হয়ত দূরে থাকতে পারবেন না।

ফলে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ছাদের নিচে থাকা বিপুল ও জটিল ব‌্যবসায়িক নেটওয়ার্ক- যার মধ‌্যে রয়েছে বহু বিদেশি বিনিয়োগ ও দায় তা নজিরবিহীন স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে।

ব্যবসার দায়িত্ব সন্তানদের ওপর থাকলেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তার সম্পদ পরোক্ষোভাবে বাড়াতেও পারতে পারেন।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ওবামাকেয়ার ইস্যু।  প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এ স্বাস্থ্যসেবা আইন বাতিলের পথে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যেও এটি বাতিলের কথা ছিল।

কিন্তু ওবামাকেয়ার বাতিলের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলেও এর বিকল্প কোনও ব্যবস্থা না থাকায় কংগ্রেসের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, উভয় দলের সদস্যরাই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ওবামাকেয়ারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দুই কোটিরও বেশি নাগরিক চিকিৎসা সেবার আওতায় এসেছিল। এখন রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের খেলায় তা বাতিল হলে এদের কী হবে তা একটি বড় প্রশ্ন। এর এখনও কোনও কার্যকর পরিকল্পনা নেই যেটি কংগ্রেসে পাস হতে পারে।

মন্ত্রিসভার সঙ্গে ট্রাম্পের দ্বন্দ্ব

ট্রাম্পের নিজের মন্ত্রিসভাতেই মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার মনোনীত প্রার্থীরাই নিজেদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে গিয়ে যে সব বক্তব্য রাখছেন তাতে ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য স্পষ্ট ধরা পড়ছে।

রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প উষ্ণ সম্পর্কের আগ্রহ প্রকাশ করলেও তারই মনোনীত প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল জেমস মাটিস এবং  গোয়েন্দা প্রধান মাইক পম্পিও রাশিয়াকে হুমকি হিসাবেই তুলে ধরেছেন সিনেট কমিটির বক্তব্যে। রাশিয়াকে নিয়ে অত্যন্ত কড়া কথা বলেছেন দুইজনই।

তাছাড়া, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি, নির্যাতন এবং যুক্তরাষ্ট্রের জোটগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয় নিয়েও ট্রাম্পের সঙ্গে তার মনোনীত কর্মকর্তাদের মতপার্থক্য দেখা গেছে।

তাদের এ অবস্থানের কারণে প্রশ্ন উঠেছে, বৈদেশিক নীতির ঐতিহ্যকে বদলে ফেলার অভিপ্রায় নিয়ে ক্ষমতায় বসতে চলা একজন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা কিভাবে মানিয়ে নেবেন তা নিয়ে।

ট্রাম্প অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না একেবারেই। গত শুক্রবারই এক ট্যুইটে তিনি বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে নিষেধ করেছেন।

বলেছেন, “আমার মন্ত্রিসভার সব মনোনীতরাই বেশ ভাল কাজ করছেন। আমি চাই তারা তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনাই প্রকাশ করুক, আমারটা নয়!”