ফিদেল কাস্ত্রো: বিদায় ‘কমান্দান্তে’

তার নামে কোনো রাস্তা নেই কিউবায়, নেই কোনো মূর্তিও; এসবের প্রয়োজনও অবশ‌্য নেই ফিদেল কাস্ত্রোর; দেশের সীমানা ছাড়িয়ে কোটি মানুষের মনে তার নাম।

মীর মোশাররফ হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2016, 10:18 AM
Updated : 26 Nov 2016, 01:32 PM

দেশে বিরোধীদের চোখে তিনি ‘স্বৈরাচার’, কট্টর পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাছে তার পরিচয় ‘একনায়ক’; বিপরীতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তিনি ‘আস্থার প্রতীক’, অনুসারীদের কাছে তিনি ‘এল কমান্দান্তে (দি কমান্ডার)’, মুক্তি সংগ্রামী সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘কিংবদন্তি’।

ক‌্যারিবীয় সাগরের যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের অবকাশ যাপনের একটি বিনোদন কেন্দ্র কিউবাকে পুরোপুরি বদলে দিয়ে, ওয়াশিংটনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেখানে লাল পতাকা উড্ডীন রেখে ৫ দশকজুড়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।

“১৯৫৯ সালে যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন খুব কম লোকই ভাবছিল ফিদেল ক‌াস্ত্রো কিছু করতে পারবেন,” বলছেন কিউবা বিষয়ক আমেরিকান বোদ্ধা ড‌্যান এরিকসন।

কিন্তু থেমে থাকেননি ফিদেল; বিপক্ষ মত, দেশের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ, হত‌্যার ষড়যন্ত্র পেরিয়ে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি; যা টিকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও।

ভগ্নস্বাস্থ‌্য নিয়ে চলতে চলতে ৯০ বছর বয়সে শনিবার বিদায় নিলেও সব কিছু বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় কোলের মধ‌্যে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তা টিকিয়ে রাখার জন‌্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়ও হয়ে থাকবেন ফিদেল কাস্ত্রো।

আর তাই আদর্শ ভিন্ন হলেও মৃত‌্যুর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এই ফিদেল কাস্ত্রোকে বিংশ শতকের প্রতীক বলে অভিহিত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।

২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল দলের কংগ্রেসে- ছবি: রয়টার্স

১৯২৬ সালের ১৩ অগাস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় ‍ওরিয়েন্তে প্রদেশে বিরান শহরের কাছে জন্ম ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুসের। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় ফিদেলের বাবা ছিলেন ধনী চিনিকল মালিক অ্যাঞ্জেল কাস্ত্রো। ফিদেলের মা লিনা রুজ গনজালেস। ভাই রাউল ও র‌্যামন ছাড়াও ফিদেল বড় হয়েছেন বোন অ্যাঞ্জেলা, এমা ও অগাস্টিনার সাহচর্যে।

স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত অ্যাঞ্জেল তখন মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করতেন।

ফিদেলের পড়াশোনা শুরু হয় প্রাইভেট জেসুইট বোর্ডিং স্কুলে; এরপর সান্তিয়াগোর ডলোরস কলেজ এবং হাভানার বেলেন কলেজ পেরিয়ে কাস্ত্রো ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব হাভানার ল’ স্কুলে।

স্কুলে থাকতেই পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় খ্যাতি ছিল ফিদেলের। সব মিলিয়ে স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে হিসেবে আইনজীবী হয়ে সহজ-সরল দিন কাটানো তার জন‌্য কঠিন ছিল না।

কিন্তু ফিদেল বেছে নেন বন্ধুর পথ। হাভানার ল স্কুলে এসে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ওই সময়েই তার মনে কিউবান জাতীয়তাবোধ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাতের ছাপ পড়ে।

১৯৪৭ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকে তখনকার স্বৈরশাসক রাফায়েল ত্রুজিলোকে উৎখাতে এক বিদ্রোহে অংশ নেন ফিদেল। তাতে ব্যর্থ হলেও দমে যাননি তিনি। পরের বছর চলে যান কলম্বিয়ার বোগোতায়। সেখানে তাকে দেখা যায় সরকারবিরোধী দাঙ্গায়।

একই বছর কাস্ত্রো যোগ দেন সংস্কারপন্থি দল ‘পার্টি দো অর্তোদক্সোতে (অর্থোডক্স পার্টি)’। কমিউনিস্টবিরোধী ওই দলের প্রার্থী এদুয়ার্দো চিবা ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও ফিদেল তাকে পুনরায় নির্বাচন করতে প্রেরণা জোগান।

খেলার প্রতি তুমুল আগ্রহ ছিল ফিদেলের, চে গেভারার সঙ্গে গলফে মগ্ন- ছবি: রয়টার্স

রাজনৈতিক দলে যোগদানের সময়ই বিয়ে করেন ফিদেল। প্রথম স্ত্রী মিরতা দিয়াজ বালার্তের কোলে জন্ম নেয় তার সন্তান ফিদেল জুনিয়র।

ওই সময়ই মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন ফিদেল; একইসঙ্গে কিউবান কংগ্রেস নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৫২ সালে জেনারেল বাতিস্তা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পরবর্তী নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করলে কাস্ত্রো ও তার দলের কয়েক সদস্য মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন।

এজন্য তারা ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। ১৯৫৩-র ২৬ জুলাই দ্য ‍মুভমেন্টের ১৫০ সদস্য কিউবার সান্তিয়াগোতে থাকা মানকাদা মিলিটারি ব্যারাকে আক্রমণ করে।

ওই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বাতিস্তা সরকার কাস্ত্রোকে বন্দি করে। এরপর এক ‘প্রহসনের’ বিচারে তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিচারকালে ফিদেলের ভাষণ তাকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘আমাকে অপরাধী বানাতে পার, কিন্তু ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে।”

বিচারে ফিদেলের জীবিত সহযোগীদেরও নানা মেয়াদে সাজা হয়, এর মধ্যে তার ছোটভাই রাউলও ছিলেন।

জেলে থাকার সময় ফিদেল তার দলের নাম বদলে রাখেন ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই ‍মুভমেন্ট’। দুই বছর পর এক ‍চুক্তির বলে মুক্তি পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল।

সেখানেই দেখা হয় আর্জেন্টাইন চে গেভারার সঙ্গে; চিকিৎসক গেভারাও তখন স্বপ্ন দেখছেন পুরো দক্ষিণ আমেরিকার বদলে দেওয়ার। এজন্য সহিংস হতেও আপত্তি নেই তার। 

১৯৬৩ সালে বন্ধু চে গেভারার (বাঁয়ে) সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রো, মাঝে রাউল কাস্ত্রো- ছবি: রয়টার্স

মেক্সিকোতেই ফিদেল, রাউল ও চে পরিকল্পনা করেন কিউবায় পুনরায় ফিরে গিয়ে বাতিস্তা সরকার উৎখাত করবেন। ১৯৫৬-র ২ ডিসেম্বর ফিদেল আর তার ৮১ জন সহযোগী অস্ত্রশস্ত্রসহ ছোট্ট নৌকা ‘গ্রানমা’য় চেপে কিউবার উত্তরাঞ্চলের মানজানিলোতে নামার পরিকল্পনা করেন।

তাদের আসার খবর পেয়ে বাতিস্তা সেখানে বাহিনী পাঠান। ফিদেলরা নামার সময় গুলি চালানো হলে বেশ কয়েকজন নিহত হন। চে আর রাউলসহ বাকিদের নিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রোর পার্বত‌্য জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন ফিদেল, সেখানে ঘাঁটি গাঁড়েন।

সরকারি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ শুরুর পর জনগণের তুমুল সমর্থন নিয়ে ১৯৫৮-র শেষ দিক থেকে ফিদেল বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে।

চূড়ান্ত লড়াইয়ে ১৯৫৯-র জানুয়ারিতে কিউবা দখলে নেয় ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই ‍মুভমেন্ট’; বাতিস্তা পালিয়ে আশ্রয় নেন ডমিনিকান রিপাবলিকে।

ফিদেল কাস্ত্রোর সমর্থন নিয়ে ওই বছরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যানুয়েল উরুতিয়া; হোসে মিরো কর্দোনা হন প্রধানমন্ত্রী। ফিদেলকে দেওয়া হয় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব।

পরের মাসেই মিরো পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেল। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কারখানা এবং খামারগুলোকে জাতীয়করণ করেন তিনি, করেন ভূমি সংস্কার।

রুশ মহাকাশচারী ইউরি গ‌্যাগারিনকে পদক দিচ্ছেন- ছবি: রয়টার্স

এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে ফিদেল নেতৃত্বাধীন সরকারের। ওই সময় কাস্ত্রো বারবার বলেছেন, তিনি ‘কমিউনিস্ট’ নন, যদিও তার সরকারের রূপরেখার সঙ্গে সোভিয়েত ঘরানার মিল পাওয়া যাচ্ছিল।

ওই বছরের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ফিদেল। তবে বারবার চেষ্টা করেও পরাশক্তি প্রতিবেশী দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেন হাওয়ারের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি।

পরের মাসে কিউবাতে ফিরে করেন ‘ফার্স্ট এগ্রেরিয়ান রিফর্ম অ্যাক্ট’। ওই আইনের অধীনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং একইসঙ্গে কিউবায় বিদেশি কোম্পানির সম্পদ জাতীয়করণ করেন।

ওই বছরের শেষ দিক থেকে সোভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে জোর প্রচেষ্টা চালান ফিদেল। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তেল কেনার চুক্তি করেন।

যুক্তরাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ওই তেল পরিশোধনে আপত্তি জানালে ফিদেল তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে চিনি কেনার নির্ধারিত কোটা বাতিল করে; চাপিয়ে দেয় নিষেধাজ্ঞা।

ক্ষমতা নেওয়ার পর ১৯৬১ সালই ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য সবচেয়ে সঙ্কটকালীন বছর। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে ছেদ টানে।

ওই বছরের এপ্রিলের ফিদেল কাস্ত্রো কিউবাকে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেন।

সিআইয়ের প্রশিক্ষণে ওই বছরই কিউবা থেকে পালিয়ে যাওয়া ১৪শ’ দেশত্যাগী কিউবার ‘বে অফ পিগে’ ফিরে ফিদেলকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়।

১৯৬১ সালে বে অফ পিগ অভ‌্যুত্থানকারীদের বিচার দেখতে ফিদেল কাস্ত্রো- ছবি: রয়টার্স

কিউবার বিপ্লবীবাহিনী ওই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে। প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র এ বিদ্রোহের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও পরে উন্মোচিত হয়- ওই বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল মার্কিনের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, হাতে তুলে দিয়েছিল মার্কিন অস্ত্র।

এরপর নিজেকে মার্কস-লেনিনের অনুসারী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং জানান, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক নীতিকে দেশ পরিচালনায় বেছে নেওয়া হয়েছে।

পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওই বছরের অক্টোবরে তুরস্কে মার্কিন জুপিটার মিসাইল বসানোর পাল্টা হিসেবে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল বসানোর গোপন পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো ও ক্রুশ্চেভ।

গোয়েন্দা তথ্যে এ ব্যাপার নিশ্চিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কিউবা থেকে মিসাইল সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানায়; একইসঙ্গে তার দেশের বাহিনীকে কিউবার জলসীমা অভিমুখী সব জলযানে তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দেয়।

টান টান উত্তেজনায় ১৩ দিনের আলাপ-আলোচনার পর কিউবায় মিসাইল বসানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বদলে যুক্তরাষ্ট্র  তুরস্ক থেকে তাদের মিসাইল সরিয়ে নেয় এবং কিউবায় হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।

১৯৬৫ সালে কাস্ত্রো কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নিজের দলকে একীভূত করেন, নিজে হন দলের প্রধান। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আবির্ভূত হন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একনিষ্ঠ সমালোচক হিসেবে।

১৯৭২ সালে নরওয়েতে অবকাশে- ছবি: রয়টার্স

১৯৬৬ সালে কাস্ত্রো এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে গড়ে তোলেন নানান সহায়ক প্রতিষ্ঠান। পরের বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন লাতিন আমেরিকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, যার হাত ধরে এর পরের কয়েক দশকে ওই অঞ্চলের অনেকগুলো দেশেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়।

১৯৭০ এর দশকে কাস্ত্রো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সোভিয়েত বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যেতে সামরিক সহায়তাও পাঠান। তার পাঠানো সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনে।

ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে সাহায্য করলেও বিভিন্ন দেশে সেনাসাহায্য পাঠাতে গিয়ে টান পড়ে কিউবার অর্থনীতিতে; পরে এ ধরনের অভিযান থেকে সরে আসেন ফিদেল।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলনে যোগ দেন কাস্ত্রো। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয় তার। দুই নেতাই একে অপরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।

এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় সামরিক আগ্রাসন না চালালেও ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যায় বলে গণমাধ‌্যমে খবর আসে।

২০০৫ সালে হাভানায় মে দিবসের অনুষ্ঠানে-- ছবি: রয়টার্স

কিউবার গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, কেবল সিআইএ কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য ৬৩৮টি চেষ্টা চালিয়েছে, যার মধ্যে আছে সিগারেটে বিস্ফোরক বা স্কুবা ডাইভিং স্যুটে বিষ মাখিয়ে; ছিল মাফিয়া স্টাইলে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ধারাবাহিক চেষ্টাকে নিয়ে কৌতূকও করেছেন ফিদেল কাস্ত্রো। বলেছেন- “হত্যার চেষ্টা এড়িয়ে যাওয়ার যদি কোনো অলিম্পিক ইভেন্ট থাকত, তাহলে নির্ঘাত তাতে স্বর্ণপদক জিততাম আমি।”

ফিদেল কাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবাজুড়ে ১০ হাজার নতুন স্কুল খোলা হয়; শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া হয় পাহাড়ি, দুর্গম প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে। এর ফলও মেলে হাতেনাতে; অল্প সময়ের মধ্যে কিউবার স্বাক্ষরতার হার হয়ে দাঁড়ায় ৯৮ শতাংশ।

কাস্ত্রোর হাত ধরেই কিউবা গড়ে তোলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা; কিউবানরা এখন এমন এক সমাজব্যবস্থায় বসবাস করছেন যেখানে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে মাত্র ১১ জন।

কাস্ত্রোর সমালোচনাও কম নয়। পশ্চিমারা তাকে ‘অধিকার হত্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। তার আমলে বন্ধ হয়েছে পেশাজীবী আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়নের ধর্মঘট করার অধিকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি গণমাধ্যম, বিপাকে পড়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়ন ও সেসব দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন এবং জোরপূর্বক দেশত্যাগ করানোরও অভিযোগ আছে ফিদেলের ‍বিরুদ্ধে।

১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবার অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়। সোভিয়েতের দেশগুলোতেই সিগারেট এবং অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করত কিউবানরা; ওই জোটের কাছ থেকে কম মূল্যে পেত তেলও।

১৯৯৫ সালে জাতিসংঘে বিল ক্লিনটনের সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে- ছবি: রয়টার্স

ধস ঠেকাতে নতুন পন্থা নেন ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে তার দেশের উপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাপ দেওয়া শুরু করেন। এ সময় কিউবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্ত বাজার অর্থনীতি পদ্ধতি চালু হয়। উৎসাহ দেওয়া হয় বিদেশি বিনিয়োগকেও।

ডলারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সঙ্গে স্বল্প আকারে পর্যটনও চালু করেন ফিদেল। প্রায় চার দশক পর ১৯৯৬ সালে আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ফিদেল; এ সময় দেশত্যাগী কিউবানদের নিজ দেশে ফিরে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান তিনি।

২০০১ সালে হারিকেন মিশেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কিউবায় যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠাতে চাইলেও তা ফিরিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নগদ টাকায় খাদ্য কেনার প্রস্তাব দেন ফিদেল।

জ্বালানি সরবরাহের পরিমাণ কমে গেলে তিনি ১১৮টি কারখানা বন্ধের আদেশ দেন এবং ভেনিজুয়েলায় চিকিৎসক পাঠিয়ে সেদেশ থেকে আমদানি করা তেলের অর্থ শোধ করেন। 

নব্বই দশকের শেষদিক থেকে কাস্ত্রোর বয়স ও সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু করে। ২০০৬ সালে কিউবার সরকার জানায়, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনালে রক্তক্ষরণ হওয়ায় কাস্ত্রোর একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

ওই বছরেরই ৩১ জুলাই আচমকা এক ঘোষণায় ছোটভাই ও সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা রাউলের হাতে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেন ফিদেল।

উগো চাবেস (প্রয়াত) প্রায়ই ছুটে যেতেন ফিদেলের কাছে- ছবি: রয়টার্স

২০০৮ এর ১৯ ফেব্রুয়ারি কাস্ত্রো আনুষ্ঠানিকভাবে কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ৭৬ বছর বয়সী ছোট ভাই রাউলের হাতে ছেড়ে দেন। কিউবার জাতীয় কংগ্রেস রাউলের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। ফিদেল হন কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি।

২০১১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে রাউলকেই শীর্ষনেতা মনোনীত করে দলের নেতাকর্মীরা। হোসে রেমন মাচাদো ভেনট্যুরা হন দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা।

ফিদেল কাস্ত্রো তখন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, পাঁচ বছর আগেই তিনি দলের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, বাকিটুকু ছিল আনুষ্ঠানিকতা।

অবসরে নিজের অভিজ্ঞতা ও মত পত্রিকায় প্রকাশ করতে ‘রিফ্লেকশন অব ফিদেল’ নামে কলাম লেখা শুরু করেন ফিদেল। ২০০৭ সালে তার আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’ প্রকাশিত হয়। ২০১১-র নভেম্বর থেকে পরের বছর জানুয়ারি পর্যন্ত পত্রিকায় ফিদেলের কলাম না পেয়ে তার স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। তবে জানুয়ারিতেই সেই নীরবতা ভেঙে আবারও জ্বলে উঠেন ফিদেল।

আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বে না থাকলেও দেশ এবং দেশের বাইরে ফিদেলের প্রভাব ছিল আগের মতোই। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে ধারাবাহিক সাক্ষাৎ করে যাচ্ছিলেন ফিদেল।

ভেনিজুয়েলার উগো চাবেস (প্রয়াত), নিকোলাস মাদুরো, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসসহ লাতিন আমেরিকায় কিউবাঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।

২০০১ সালে নেলসন ম‌্যান্ডেলার সঙ্গে- ছবি: রয়টার্স

২০০৫ সালে দিয়াগো ম‌্যারাদোনার সঙ্গে- ছবি: রয়টার্স

ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে পোপ বেনেডিক্ট এবং পোপ ফ্রান্সিস কিউবার এ কিংবদন্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। ফুটবল কিংবদন্তি দিয়াগো মারাদোনাও ছুটে যেতেন এই কমিউনিস্ট নেতার সংস্পর্শ পেতে।

তবে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম দেশটি সফর করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে সাক্ষাৎ দেননি এ বিপ্লবী। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থাকায় ওই সাক্ষাৎ হয়নি বলে পরে ফিদেল কাস্ত্রো জানান। বলেন- “সাম্রাজ্যের কাছ থেকে কোনো উপহার আমাদের দরকার নেই।”

২০০৮ সালে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর প্রকাশ‌্যে খুব একটা আসতেন না ফিদেল। এ বছর দুই বার প্রকাশ‌্যে দেখা গিয়েছিল তাকে। গত এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে ভাষণে তিনি নিজের শারীরিক অবস্থার কথা তুলে সমর্থকদের প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন- “কিছু দিনের মধ‌্যে ৯০ পার করব, এটা আমি ভাবিনি।”

বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্টদের দুর্দিনের মধ‌্যে কংগ্রেসে ভাষণে তিনি কিউবাবাসীদের উদ্দীপ্ত করে বলেছিলেন, “কমিউনিজম এখনও প্রাসঙ্গিক, কিউবা বিজয়ীই থাকবে।”

[সূত্র: বিবিসি, বায়োগ্রাফি ডটকম, নোটেবল বায়োগ্রাফি, রয়টার্স]