বৃহস্পতিবার সাহিত্যে ১১৩তম নোবেল বিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেন রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব সারা দানিউস।
সুইডিশ অ্যাকাডেমি বলছে, ‘আমেরিকার সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক মূর্চ্ছনা সৃষ্টির’ জন্য ৭৫ বছর বয়সী রক, ফোক, ফোক-রক, আরবান ফোকের এই কিংবদন্তিকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে তারা।
ডিলান তথাকথিত সাহিত্যিক নন। তবে এখন তার নাম উচ্চারিত হবে টমাস মান, রুডইয়ার্ড কিপলিং, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, বার্ট্রান্ড রাসেলদের সঙ্গে। নোবেলের ১১২ বছরের ইতিহাসে এ পুরস্কারজয়ী প্রথম সংগীত শিল্পী ও গীতিকার তিনি।
গার্ডিয়ান লিখেছে, এর আগে বহুবার নোবেলের মনোনয়নের তালিকায় নাম এলেও সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক এ পুরস্কারের ঘোষণায় ডিলানের নাম যে বিস্ময় হয়েই এসেছে।
ডিলানকে তিনি বর্ণনা করেন ইংরেজি বাচন রীতির ‘এক মহান কবি’ হিসেবে, নোবেল পুরস্কার যার ‘প্রাপ্য’।
“৫৪ বছর ধরে চলছে তার এই অভিযাত্রা, প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে চলেছেন, সৃষ্টি করছেন নতুন পরিচয়।”
ডিলানের ‘দ্য টাইমস দে আর আ-চেইঞ্জিং’ গানটিকে দানিউস তুলনা করেছেন গ্রিক কবি হোমার আর শ্যাফোর সঙ্গে।
“আমরা যদি ৫০০০ বছর পিছনে ফিরে যাই, আমরা হোমার আর শ্যাফোকে পাব। তাদের গীতিকবিতা লেখাই হত গেয়ে শোনানোর জন্য। বব ডিলান একই কাজ করেছেন।”
১৯৯৩ সালে ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের পর বব ডিলান প্রথম আমেরিকান, যিনি সাহিত্যে নোবেল পেলেন। তবে নোবেল জয়ের খবরে ডিলান কী ভাবছেন, চমকে যাওয়া বিশ্ব তাৎক্ষণিকভাবে তা জানতে পারেনি।
রয়টার্স জানিয়েছে, ডিলানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার মুখপাত্র এলিয়ট মিনৎজ কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান । নিউ ইয়র্কে তখন রাত ৩টা। তাছাড়া কয়েক ঘণ্টা পর লাস ভেগাসে ডিলানের কনসার্ট রয়েছে।
গান লেখা আর গাওয়া ছাড়াও ডিলান ছবি এঁকেছেন, অভিনয় করেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন। ১৯৭১ সালে তার লেখা গদ্য আর পদ্য নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘ট্যারেন্টুলা’, ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘রাইটিংস অ্যান্ড ড্রইংস’, আর ২০০৪ সালে তার স্মৃতিকথা ‘ক্রনিকলস’।
ওয়ান্ডার্স বয়েজ চলচ্চিত্রে ডিলানের ‘থিংকস হ্যাভ চেইঞ্জড’ গানটি ২০০১ সালে অস্কার জিতে নেয়। ২০০৮ সালে পুলিৎজার পুরস্কারের জুরি বোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য তাকে বিশেষ সম্মাননা জানায়। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১২ সালে ডিলানের গলায় পরিয়ে দেন ‘মেডাল অব ফ্রিডম’।
১৯৪১ সালের ২৪ মে মিনেসোটার ডুলুথে এক ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া রবার্ট অ্যালেন জিমারের হাতে প্রথম গিটার আসে ১২ বছর বয়সে। দুই বছরের মাথায় তিনি স্কুলের ব্যান্ডে বাজাতে শুরু করেন।
উডি গুথরির গান অল্প বয়সেই সেই কিশোরকে টেনে নিয়েছিল লোকসংগীতের পথে। আর বব ডিলান নামটি তিনি নিয়েছেন ইংরেজ কবি ডিলন টমাসের নাম থেকে।
বব ডিলানের সংগীত ক্যারিয়ারের সূচনা হয় ১৯৫৯ সালে মিনেসোটার এক কফি হাউজে। ঠিকানা বদলে ১৯৬১ সালে নিউ ইয়র্কে যাওয়ার পরের বছরই তার প্রথম অ্যালবাম ‘বব ডিলান’ বাজারে আসে।
এই শিল্পী, গীতিকার খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছান গত শতকের ষাটের দশকে। হাতে গিটার আর গলায় ঝোলানো হারমোনিকা হয়ে ওঠে তার ট্রেডমার্ক।
সে সময় তার ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ আর ‘দ্য টাইমস দে আর আ-চেইঞ্জিং’ এর মত গানগুলো পরিণত হয়েছিল যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের গণসঙ্গীতে।
বব ডিলানের তারুণ্যের গানগুলো হয়ে উঠেছিল আমেরিকান অস্থিরতার প্রতীক। সেখানে এসেছে রাজনীতি, সমাজ আর দর্শনের ছায়া।
ষাটের দশকে যাদের গান আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে, তাদের মধ্যে বব ডিলান একজন। ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্টিন লুথার কিংয়ের বক্তৃতার সময় ডিলান ছিলেন পিট সিগার, জোয়ান বায়েজদের সঙ্গে মিছিলের সামনের সারিতে।
>> বব ডিলানের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেছে নানা দেশে, নানা ভাষায়। বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছেন তিনি। ডিলানের ‘এভরিবডি মাস্ট গেট স্টোনড’ গানটিও তেমনই এক বিতর্কের বিষয় হয়ে রয়েছে বহু বছর ধরে। এক পক্ষ বলে আসছে ডিলান সেখানে ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত পাথর ছুঁড়ে শাস্তির রূপক ব্যবহার করেছেন। কিন্তু জনপ্রিয় মত হচ্ছে, নেশায় বুঁদ ডিলান সেখানে স্রেফ গাঁজারই জয়গান গেয়েছেন। আবার কারও কারও মতে, দুটোই হয়তো সত্যি।
>> ১৯৬৫ সালে রোড আইল্যান্ডের ফোক ফেস্টিভালে অ্যাকুইস্টিক গিটার নামিয়ে রেখে ডিলান হাতে তুলে নেন ইলেক্ট্রিক গিটার। সেই গিটার বাজিয়েই একে একে তিনটি গান গেয়ে শোনান, যা সে সময় ফোন আন্দোলনের শিল্পীদের মধ্যে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। সনাতনীদের কেউ কেউ ওই ঘটনাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বর্ণনা করেন।
>> ১৯৬৬ সালে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পর অনেকটাই অন্তরালে চলে যান বব ডিলান। সেই ঘটনা নিয়ে খুব কম তথ্যই এ পর্যন্ত জানা গেছে। তবে বলা হয়, ওই ঘটনা তাকে পাহাড়সম খ্যাতির চাপ থেকে কয়েক বছরের জন্য পালিয়ে থাকতে সহযোগিতা করেছিল।
>> ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া বব ডিলান ১৯৭৯ সালে খ্রিস্ট ধর্ম নেন। পরে ধর্মীয় সংগীত নিয়ে তার তিনটি অ্যালবামও প্রকাশিত হয়। এরপর দীর্ঘদিন তার গানে কোনো ধর্মের প্রভাব দেখা না গেলেও ২০০৯ সালে ভক্তদের সামনে হাজির করেন বড় দিনের অ্যালবাম।
>> একসময় ডিলান আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন বক্সিং নিয়ে। নিজেকে একবার তিনি বর্ণনা করেছিলেন একজন সার্কাসের দড়াবাজিকর হিসেবে। রোলিং স্টোন ম্যাগজিনকে একবার তিনি বলেছিলেন, “আমি আমার স্বপ্নে বাঁচি। আমি আসলে বাস্তব দুনিয়ায় থাকি না।”
>> ডিলানের সবচেয়ে বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে সাবটেরিয়ান হোমসিক ব্লুজ, মিস্টার ট্যাম্বুরিন ম্যান, জাস্ট লাইক আ ওম্যান, লে লেডি লে, ট্যাঙ্গেলড আপ ইন দ্য ব্লু অন্যতম।
সমসাময়িক বাংলা জীবনমুখী গানের ধারাতেও রয়েছে বব ডিলানের বিপুল প্রভাব। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী কবীর সুমন ও অঞ্জন দত্ত বিভিন্ন সময়ে ডিলানের ঋণ স্বীকার করেছেন। ডিলানের গানের কথা আর সুর নিয়ে তারা যে গান করেছেন, তাও দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে।
নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ডিলান একজন আইকন। সমকালীন সংগীতের ওপর তার প্রভাব অসাধারণ। এবং তিনি হয়ে উঠেছেন বিকল্প সাহিত্যের ধারাবাহিক উৎস।”
আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে ডিলানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হবে পুরস্কারের ৮০ লাখ ক্রোনার।
গত বছর সাহিত্যে নোবেল পান বেলারুশের লেখক, অনুসন্ধানী সাংবাদিক সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ, যার ‘বহুস্বরের’ গদ্যকে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অভিহিত করে ‘সমকালীন যাতনা আর সাহসিকতার সৌধ’ হিসেবে।
সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের শেষ ইচ্ছা অনুসারে গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবতার কল্যাণে অবদানের জন্য প্রতি বছর চিকিৎসা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।