১. কাজে আসেনি ব্রেক্সিটের নেতিবাচক অর্থনৈতিক হুঁশিয়ারি
যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে অর্থনৈতিক হুমকির মুখে পড়বে এই নেতিবাচক প্রচারণা আর হুঁশিয়ারি মানুষকে এত বেশি দেওয়া হয়েছে যে মানুষ তা বিশ্বাস করেনি।
ভোট ইইউ’য়ে থাকার বিপক্ষে গেলে এর পরিণতিতে মানুষ আরও গরিব হয়ে যাবে, এমন হুঁশিয়ারি মানুষ ক্রমাগত শুনেছে।
বিশ্বের বড় বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সিবিআই,আইএমএফ, ওইসিডি, আইএফএস সহ শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ার করেছেন- ইইউ ছাড়লে প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়বে, বেকারত্ব বাড়বে, পাউন্ডের দরপতন হবে। এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও।
কিন্তু বোমা বর্ষণের মত এই বাড়াবাড়ি রকমের হুঁশিয়ারতে মানুষ কান দেয়নি। যার কারণে ফল হয়েছে উল্টো।
বিপক্ষে ভোট দিয়ে মানুষ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে কেবল বিদ্রোহের পরিচয় দিয়েছে তাই নয়, এখানে আরেকটি সত্য বেরিয়ে এসেছে যে, মানুষ নিজেদেরকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ভেবেছে। আর যে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে এত ঢোল পেটানো হল, ৫ দশক ধরে ইইউ’য়ের সঙ্গে জড়িত থাকার তেমন কোনও অর্থনৈতিক সুবিধাই মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি।
২. স্বাস্থ্যখাতে ৩৫ কোটি পাউন্ডের প্রতিশ্রুতি
ইইউ ছাড়ার পক্ষের শিবিরের স্লোগান ছিল, ইইউ ছাড়লে সপ্তাহে ৩৫ কোটি পাউন্ড খরচ বাঁচবে। আর তখন তা স্বাস্থ্যসেবা খাতে (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এনএইচএস) বরাদ্দ করা যাবে।
তাদের যুক্তি ছিল, ব্রিটেন প্রতি সপ্তাহে ইইউ’কে ৩৫ কোটি পাউন্ড দেয়। যে অর্থ দিয়ে প্রতি সপ্তাহে দুটো করে হাসপাতাল বানানো সম্ভব।
এমন আকর্ষণীয় স্লোগান সব বয়সের, সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
যদিও ইইউয়ে থাকার পক্ষের শিবির বারবারই এ হিসাবকে ভুল বলে এসেছে। তারা বলার চেষ্টা করেছে, কতটুকু অর্থ ইইউ’য়ের সদস্যপদের জন্য ব্রিটেনকে দিতে হয়। তার কতটুকু ব্রিটেন ফেরত পেতে পারবে আর সেই অর্থের ওপর ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণই বা কতটুকু থাকবে।
কিন্তু মানুষ ইইউ এর বিপক্ষের শিবিরের বলা অর্থের অঙ্কটাকেই মনে রেখেছে এবং বিশ্বাস করেছে যে, ইইউ কে সদস্যপদের জন্য দেওয়া অর্থ নিজ দেশেই কাজে লাগানো উচিত।
৩. অভিবাসন ইস্যুটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
‘ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি’ (ইউকিপ) নেতা নাইজেল ফারাজের অভিবাসন-বিরোধী বক্তব্য গণভোটের প্রচারে ইইউ’র বিপক্ষের শিবিরের জন্য হয়ে উঠেছিল ট্রাম্প কার্ড।
জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিষয়টি, বিশেষ করে, নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
গত ১০ বছরে ব্রিটেনে বিপুল সংখ্রক অভিবাসী আগমন নিয়ে উদ্বেগ, সমাজে এর প্রভাব এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী ২০ বছরে কী হবে - এসব তুলে ধরে সফল প্রচার চালিয়েছে ইইউ ছাড়ার পক্ষের শিবির। এর ফলে ইইউ এর বিপক্ষে জনমত গড়ে উঠেছে।
অভিবাসনের বিরুদ্ধে কটৈার প্রচারণা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও ভোটারদের ইইউ ছাড়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে এ প্রচারাভিযান।
৪. জনগণ প্রধানমন্ত্রীর কথায় কান দেয়নি
ডেভিড ক্যামেরন সাধারণ নির্বাচনে দু’বার এবং অতীতে দুটো গণভোটে জয়ের সাফল্য পেলেও এবার তার ভাগ্য বিফলে গেছে।
রাজনৈতিক ভবিষ্যত আর ব্যক্তিগত সম্মানের ঝুঁকি নিয়ে তিনি ইইউয়ে থাকার পক্ষের শিবিরের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন আনতে নয় মাস ধরে আলোচনা চালানোর পরও তা নাকচ করেন তার দলেরই ইইউবিরোধীরা। গোটা প্রক্রিয়াতেই তিনি এমন বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন।
ফলে শেষ পর্যন্ত ক্যামেরন ভোটারদেরও আর দলে টানতে পারেননি।
৫. লেবার পার্টি ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি
যুক্তরাজ্যের বিরোধীদল লেবার পার্টি ইইউয়ে থাকার পক্ষে যথেষ্ট প্রচারণা চালায়নি বলে অভিযোগ আছে।
গণভোটে জয়ের জন্য ইইউ’য়ে যুক্তরাজ্যের থাকার পক্ষের শিবিরের দরকার ছিল লেবার ভোটারদের।
কিন্তু লেবার পার্টির ৯০ শতাংশ এমপি ইইউ এর পক্ষে হওয়ার পরও তারা সমর্থকদের মনোভাব ঠিকমত বুঝতে পারেনি। শুধু তাই নয়, প্রচারে কোনও ভুল হচ্ছে বোঝার পরও তারা তা ঠিক করার তেমন উদ্যোগ নেয়নি।
ব্রিটেনের ইইউ’তে থাকার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে কিছু প্রচার চালালেও লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ভোটারদের যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি বলে তার নিজ দল থেকেই অভিযোগ উঠেছে।
৬. প্রচারে জনসন এবং মাইকেল গভের মতো বড় মাপের নেতা
কনজারভেটিভ পার্টির কয়েকজন মন্ত্রী ‘ব্রেক্সিট’ অর্থাৎ, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে সেটি সবাই জানত।
কিন্তু বড় মাপের দুই নেতা লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন এবং মাইকেল গভ ব্রেক্সিট শিবিরে যোগ দেওয়ায় `লিভ ক্যাম্পেইন` নতুন মাত্রা পায়।
জনগণের কাছে বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভত হন মাইকেল গভ আর বরিস জনসন আবির্ভত হন তারকা হিসাবে।
৭. বয়স্ক মানুষরা বেশি ভোট দিয়েছে
বয়স্ক মানুষদের ভোটই ইইউ ছাড়ার পক্ষকে জয় এনে দিয়েছে। বয়স্ক মানুষদের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবণতা সাধারণত বেশি দেখা যায়।
২০১৫ সালের ভোটেও ৬৫ বা তার ওপরের বয়সী মানুষদের ৭৮ শতাংশই ভোট দিয়েছে। যেখানে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটারদের মাত্র ৪৩ শতাংশ ভোট দিয়েছে। আর ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ভোট দিয়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ।
এবারের গণভোটে দেখা গেছে, ৫৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যেই ব্রেক্সিট সমর্থকের সংখ্যা বেশি। ৬৫’র বেশি বয়সী ভোটারদের প্রতি ৫ জনের ৩ জনই বলেছেন, তারা ইইউ’য়ে থাকার বিপক্ষে।
৮. ইউরোপ ব্রিটিশদের কাছে সবসময়ই ছিল ভিনদেশের মত
ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কখনই সহজ কিংবা একইরকম ছিল না।
ইউরোপীয় কমিউনিটিতে যোগ দিতে ব্রিটেনের অনেক বছর লেগেছিল। ১৯৭৫ সালে এ নিয়ে গণভোটের সময়ও অনেকেই একে সমর্থন জানিয়েছিল কেবল কিছু অর্থনৈতিক লাভের আশায়।
তরুণ প্রজন্ম ইইউ-পন্থি বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ভোটের ফল পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ না করা পর্যন্ত বোঝা যাবে না কত শতাংশ বয়স্ক আর কত শতাংশ তরুণ পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।