এর মধ্য দিয়ে ২৮ জাতির জোট ইইউতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠগুলোর একটির বিদায় ঘটলে তা ইউরোপের নীতি-নির্ধারণীতে ওয়াশিংটনের প্রভাব কমাবেও বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
শুক্রবার যুক্তরাজ্যজুড়ে গণভোটের ফলে ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে দেশটির চার দশকের বেশি সময়ের সম্পর্ক ছিন্নের খবরে বিশ্ব অর্থ বাজার বড় ধরনের ঝাঁকুনি খায়।
ফলাফলে ইইউ থেকে বিচ্ছেদের পক্ষ ৫২ শতাংশ ভোটে জয়ী হওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের নাটকীয় দরপতন ঘটে।
রয়টার্স বলেছে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি দিল এই গণভোট। এটা এমন সময় ঘটলো যখন বিশ্বজুড়ে সুদের হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।
এ ঘটনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ার বাজারের সূচকও কমেছে বলে গণমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে। লন্ডনের শেয়ারবাজার এটিএক্স-এর প্রধান জো রান্ডেল রয়টার্সকে বলেন, “বাজার এখন খুবই অস্থির।”
যুক্তরাজ্যবাসীর এই সিদ্ধান্ত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে বিনিয়োগে ধাক্কা, বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে লন্ডনের ভূমিকা হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে বলে রয়টার্সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
স্কটল্যান্ডের নেতা নিকোলা স্টার্জেন স্বাধীনতা প্রশ্নে নতুন গণভোটের সম্ভাবনার কথা বলায় যুক্তরাজ্যই এখন ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। পুরো যুক্তরাজ্যে ভোটে ইইউ ছাড়ার পক্ষে রায় এলেও স্কটল্যান্ডের দুই তৃতীয়াংশ নাগরিক থাকার পক্ষে ভোট দেয়।
ইইউতে থাকার পক্ষে প্রচার চালানো প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন বলেছেন, অক্টোবর নাগাদ পদত্যাগ করবেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর যুক্তরাজ্যই প্রথম দেশ, যারা ২৮ জাতির এই জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই ভোটের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগেই বিচ্ছেদপন্থিদের জয় স্পষ্ট হয়ে যায়। ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট পড়েছে ৫২ শতাংশ, আর থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন সাড়ে ৪ কোটি ভোটারের ৪৮ শতাংশ।
ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির গণভোটের রায় ইইউর বাকি ২৭ সদস্য দেশের রাষ্ট্রনেতার কপালেও ভাঁজ ফেলেছে।
অভিবাসী ও গ্রিসকে উদ্ধারের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নিজ নিজ দেশেও ইইউ ছাড়ার জিগির উঠতে পারে বলে শঙ্কা করছেন অন্য দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়করা। এরইমধ্যে ফ্রান্স, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সে এ আওয়াজ তোলা হয়েছে।
কী হবে ব্রেক্সিটে?
ভোটের এ ফল যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য দেশের সম্পর্কে বাঁকবদল হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ইইউ ছাড়ার কারণে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোতে অবাধ যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হবে; ইউরোপভুক্ত অন্য দেশের নাগরিকরাও দেশটিতে আগের মত সহজে ঢুকতে পারবে না।
আগের মতো চলাচল অবাধ করতে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যকে আবার চুক্তি করতে হবে।
‘ভোট লিভ’ এর প্রচারকরা বারবার বলে আসছিল, অভিবাসীদের ব্রিটেনে আসা বন্ধ করতেই মনোযোগ তাদের। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে কেউ যাতে অবাধে যুক্তরাজ্যে এসে বসবাস করতে না পারে।
এর ফলে গ্রিসকে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে ইইউর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে; সিরিয়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়েও জোটটি বিপদে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে গণভোটের ফল ঘোষণার পরপরই ইইউর সঙ্গে বিচ্ছেদ হচ্ছে না যুক্তরাজ্যের। পুরো প্রক্রিয়া ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে সম্পন্ন হবে না বলে জানিয়েছে বিবিসি।
লিসবন চুক্তির আর্টিকেল-ফিফটি‘তে স্বাক্ষরের পরও অন্তত দুই বছর ‘বিচ্ছেদ’ সংক্রান্ত আলোচনা চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই আলোচনাতেই ‘যুক্তরাজ্য কোন প্রক্রিয়ায় ইইউ ছাড়বে’ তা ঠিক হবে।
ইইউ’র নিয়ম অনুযায়ী, আর্টিকেল-ফিফটি চালু করা দেশ এরপর আবারও সংস্থায় ফিরতে চাইলে সদস্য সব রাষ্ট্রের সমর্থন লাগবে।
৪১ বছর আগে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) যোগ দেওয়ার প্রশ্নে গণভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যবাসী। তাতে ৬৭ শতাংশ ইইসির পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ওই ইইসিই পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউতে রূপ নেয়।
‘স্বাধীনতার জন্য জয়’
গণভোটের রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে ইইউ ছাড়ার পক্ষে জোর প্রচারকারী ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির নেতা মাইকেল ফারাজ বলছেন, জনগণ ‘স্বাধীনতার’ পক্ষে রায় দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় জোট থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে কিছু ডানপন্থি রাজনীতিবিদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালে গঠিত হয় ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি। দলটি ২০১৩ সালে স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে সাফল্য পায় এবং প্রতিনিধিত্বের বিচারে যুক্তরাজ্যের চতুর্থ শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।
এদিকে ভোটের ফল প্রকাশের পর শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে স্ত্রী সামান্থাকে নিয়ে এসে এক টেলিভিশন ভাষণে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ক্যামেরন।
তিনি বলেন, “কখনও কখনও সময় আসে জনগণকে জিজ্ঞেস করার, তারা কী চায়? তাদের ইচ্ছার প্রতি অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে।
“ব্রিটিশ জনগণ একটি ভিন্ন পথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সে কারণে আমি মনে করি, এই পথে পরিচালনার জন্য দেশের নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন।”
দুই লেবার এমপি করবিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন। আগামী সোমবারের পার্লামেন্ট অধিবেশনে দলের পার্লামেন্ট প্রতিনিধি হিসাবে তার নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক আহ্বান করেছেন তারা।
স্পষ্ট দ্বিধাবিভক্তি
ভোটের আগেই ধারণা করা হয়েছিল যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি, ফলাফলেও তার প্রতিফলনই ঘটেছে।
ভোট মানচিত্রে দেখা যায়, গোটা যুক্তরাজ্যের উত্তর অংশ ইইউতে থাকার পক্ষে অব্স্থান নিয়েছে, বিপরীতে দেশের দক্ষিণের প্রায় পুরো অংশ এই জোট ছাড়ার পক্ষে।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে বিচ্ছেদপন্থিরা জয়ী হলেও স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। তবে সবখানেই ব্যবধান খুবই কম।
ইংল্যান্ডে ১ কোটি ৫২ লাখ ইইউ ছাড়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। বিপরীতে থাকার পক্ষে ভোট পড়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ। এখানে ভোটের হার ৭৩ শতাংশ।
ওয়েলসেও রায় গেছে ইইউ ছাড়ার পক্ষে। মোট ভোটারের ৭২ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট সাড়ে ৮ লাখ, থাকার পক্ষে পৌনে ৮ লাখ।
একইভাবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাড়ে ৪ লাখ ভোটার ইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। সাড়ে ৩ লাখ ভোট দিয়েছেন ছাড়ার পক্ষে। এখানে ৬৩ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন।
রাজধানী লন্ডনের বেশিরভাগ ভোটার ইইউতে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এখানে ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে থাকার পক্ষে, বাকি ৪০ শতাংশ বিপক্ষে।
মোট ভোটের হার ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যালটে ‘লিভ’ অর্থাৎ ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১ কোটি ৭৪ লাখ ১০ হাজার ৭৪২ জন। ‘রিমেইন’ অর্থাৎ থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১ কোটি ৬১ লাখ ৪১ হাজার ২৪১ জন।
গণভোটে ভোটের হার গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের চেয়েও বেশি বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৯৯ হাজার ৫৩৭ ভোটার ৪০ হাজারটি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেন। এরপর ব্যালট বাক্সগুলো ৩৮২টি কেন্দ্রে নিয়ে শুরু হয় গণনা।
১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে একযোগে ফল ঘোষণা শুরু হয়। সব ফল যোগ করে ম্যানচেস্টার টাউন হল থেকে পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা হয়।