ব্রেক্সিট: ঐতিহাসিক বিচ্ছেদপঞ্জি

পাল্টে যাওয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় দিকে দিকে যখন ঐক্যের জয়গান, ঠিক তখনই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চার দশকের বন্ধন ছেঁড়ার পক্ষে রায় এসেছে যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক গণভোটে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2016, 10:47 AM
Updated : 25 June 2016, 09:09 AM

ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর যুক্তরাজ্যই প্রথম দেশ, যারা ২৮ জাতির এই জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘ব্রেক্সিট’।

বলা হচ্ছে, এই গণভোটের ফল কেবল যুক্তরাজ্যের ভাগ্য বদলাবে না, বদলে দেবে ইউরোপকে এবং আগামী প্রজন্মের রাজনীতিকে। প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়েই। 

ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তের প্রথম বলি হলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। বিচ্ছেদের বিরোধিতা করে আসা ক্যামেরন ইতোমধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

ভোটের হিসাব

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ৪ কোটি ৬৫ লাখ ভোটারের ৭২.২% এই গণভোটে নিজেদের মত দিয়েছেন।

>> ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট পড়েছে ৫১.৯%

>> ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৮.১%

যেভাবে বিচ্ছেদ

গণভোটের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইইউর সঙ্গে বিচ্ছেদ হচ্ছে না যুক্তরাজ্যের। বিবিসি বলছে, পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।

২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া লিসবন চুক্তিকে বলা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম সাংবিধানিক ভিত্তি। তারই আর্টিকেল-ফিফটিতে বলা হয়েছে এই জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তরিকা।

# ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্টিকেল-ফিফটি অনুযায়ী জোট ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তারপর অন্তত দুই বছর বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আলোচনা চলতে পারে। ওই আলোচনাতেই ঠিক হবে, যুক্তরাজ্য কোন প্রক্রিয়ায় ইইউ ছাড়বে। এর আগে এ ধরনের নজির না থাকায় ইইউ আর যুক্তরাজ্যকেই লিখতে হবে বিচ্ছেদের রীতিনীতি। 

# পদত্যাগের ঘোষণায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী অক্টোবরে কনজারভেটিভ পার্টির কনফারেন্স পর্যন্ত তিনি ডাউনিং স্ট্রিটে থাকছেন। তারপর তার উত্তরসূরি হিসেবে দল যাকে মনোনীত করবে, তার জন্যই আর্টিকেল-ফিফটি কার্যকর করার দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

# ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী, আর্টিকেল-ফিফটি চালু করা দেশ এরপর আবারও কখনও জোটে ফিরতে চাইলে সব সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন হবে।

# অবশ্য গণভোটের রায় মানার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। গার্ডিয়ান লিখেছে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যেহেতু সার্বভৌম, সেহেতু সরকার গণভোটের রায় বিচারের সিদ্ধান্ত পার্লামেন্টের হাতে দিতে পারে। আর পার্লামেন্ট চাইলে আর্টিকেল-ফিফটি চালু না করার সিদ্ধান্ত দিতে পারে। সেক্ষেত্রে বিচ্ছেদও ঘটবে না।

বিচ্ছেদের পর

শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংবিধানিক ও কূটনৈতিকভাবে দীর্ঘ সময়জুড়ে বড় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে যুক্তরাজ্যকে।

>> বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে যুক্তরাজ্যকে আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক করে দেখানো হবে না। একইভাবে ব্রিটিশ রাজনীতির দাবার ছকেও নতুন করে সাজাতে হবে ঘুঁটি। ডাউনিং স্ট্রিট, ব্যবসা, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং পররাষ্ট্রনীতির কাঠামোতেও ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসবে। 

>> যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, ইইউ বাজারে সব ধরনের ব্রিটিশ পণ্যের ওপর শুল্ক বসবে।

>> যুক্তরাজ্য অন্যান্য দেশের সঙ্গে কোন শুল্ক কাঠামোতে বাণিজ্য করবে- তাও নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে, কেননা এতদিন তারা ইইউর নিয়মই অনুসরণ করে আসছিল।

>> বিচ্ছেদের পর ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকরা আর যুক্তরাজ্যে এসে অবাধে বসবাস বা কাজের সুযোগ পাবেন না। এখন যে ইইউ নাগরিকরা যুক্তরাজ্যে কাজ করছেন, তাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে। একই কথা প্রযোজ্য হবে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের ক্ষেত্রেও।

>> ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাজ্য জোট ছেড়ে গেলে অভিবাসন সঙ্কট মোকাবিলা ও গ্রিসের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। পাশাপাশি ইইউ ছাড়ার জিগির উঠতে পারে অন্য দেশেও।

বাজারে ধাক্কা

রয়টার্স বলেছে, ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার পর আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছে এই গণভোটের ফল। বড় ধাক্কা লেগেছে ইউরোপ ও এশিয়ার শেয়ার বাজারেও।

>> পাউন্ডের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে একদিনে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে এদিন। এক পর্যায়ে পাউন্ডের এর দর ১০ শতাংশ কমে ১ দশমিক ৩৩০৫ ডলারে নেমে আসে, যা ১৯৮৫ সালের পর সর্বনিম্ন।

>> এর ফলে আন্তর্জাতিক ঋণমান সূচকে ব্রিটেনের ‘এএএ’ রেটিং হারাতে হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে স্টান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর ও জেপি মরাগান।

>> ব্রিটেনের এফটিএসই ফিউচার্স ও জার্মানির ড্যাক্স ফিউচার্স প্রায় ৯% দর হারিয়েছে। ইউরো জোনের ইউরো স্টক্স ৫০ ফিউচার্সের দর ১১% এ বেশি পড়েছে।

>> জাপানের স্টক এক্সচেঞ্জ সূচক নিক্কেই ৭.৭%, দক্ষিণ কোরিয়ায় কোসপি সূচক ৩.৯%, অস্ট্রেলিয়ার এএসএক্স ৩.৪%, চীনের সাংহাই কম্পোজিট সূচক ১.২%, হংকংয়ের হ্যাং স্যাং ৪.৭% আর ভারতের সেনসেক্স সূচক ৩.৪% শতাংশ কমেছে বেক্সিটের ধাক্কায়।

>> এদিকে বাজারে অমঙ্গলের হাওয়া বইলেই ঝুঁকির বিনিয়োগ বিক্রি করে দিয়ে ‘সেইফ হেভেন’ অর্থাৎ নিরাপদ খাতে টাকা লগ্নি বেড়ে যায়। এবারও তাই হয়েছে। ২০০৮ সালের পর থেকে এক দিনে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সোনার দাম। জ্বালানি তেল ও তামার বাজারেও লেগেছে অস্থিরতার ঢেউ।

>>  বাজারের লাগাম ধরতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড তৈরি রাখার কথা বলেছে।

অম্ল-মধুর ৪১ বছর

# ৪১ বছর আগে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) যোগ দেওয়ার প্রশ্নে গণভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যবাসী। তাতে ৬৭ শতাংশ ইইসির পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ওই ইইসিই পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউতে রূপ নেয়।

# যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় জোট থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে কিছু ডানপন্থি রাজনীতিবিদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালে গঠিত হয় ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি। ২০১৩ সালে নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বে দলটি জনপ্রতিনিধিত্বের বিচারে যুক্তরাজ্যের চতুর্থ শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।

# এই অবস্থায় কনজারভেটিভ সমর্থকদের অনেকেই ইনডিপেনডেন্স পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়েন। এমনকি একজন এমপিও এক পর্যায়ে দল বদলে ইনডিপেনডেন্স পার্টিতে যোগ দেন । সাধারণ ভোটারদের মধ্যে কনজারভেটিভদের প্রতি সমর্থনের ঘাটতি দেখা যায়।

# ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে অনেকটা চাপের মুখে ইইউ প্রশ্নে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন কনজারভেটিভ নেতা ডেভিড ক্যামেরন, যদিও তিনি নিজে ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করে এসেছেন। ওই ঘটনাকে তখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছিলেন ডেভিড ক্যামেরনের রাজনৈতিক জীবনের ‘সবচেয়ে বড় জুয়া’, যাতে শেষ পর্যন্ত তাকে হারতে হল, করতে হল পদত্যাগ।

# গণভোটের রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে ইইউ ছাড়ার পক্ষে জোর প্রচারকারী ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির নেতা মাইকেল ফারাজ বলছেন, জনগণ ‘স্বাধীনতার’ পক্ষে রায় দিয়েছে।

# আর পদত্যাগের ঘোষণায় ক্যামেরন বলেছেন, “কখনও কখনও সময় আসে জনগণকে জিজ্ঞেস করার, তারা কী চায়... তাদের ইচ্ছার প্রতি অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে।”