পানামা পেপার্স: অফশোর লেনদেনে জড়িত ১২ নেতার নাম

পানামার ল’ ফার্ম মোস্যাক ফনসেকার ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিতে এখন পর্যন্ত ১২ জন বিশ্ব নেতার নাম উঠে এসেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2016, 07:27 PM
Updated : 5 April 2016, 07:42 PM

এদের কেউ কেউ অফশোর লেনদেনে সরাসরি জড়িত, আবার অনেকের ঘনিষ্ঠ স্বজনদেরও নাম উঠে এসেছে।

যদিও এসব বিশ্ব নেতাদের সবাই কোনও ধরনের অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। নথিতে নাম থাকা অনেকের বিরুদ্ধে কোনও অবৈধ বা অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কোনও প্রমাণও নেই।

‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট’ (আইসিআইজে) পানামা নথি প্রকাশ করে।

তাদের দাবি, এ নথিতে বিশ্বের ১৪০ জন রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের গোপন অফশোর সেবার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রাখার গোপন তথ্য আছে।

মোস্যাক ফনসেকা ‘অফশোর’ সেবায় বিশ্বের চতুর্থ বড় প্রতিষ্ঠান। বলা হচ্ছে, অফশোরে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের মধ্য দিয়ে মোস্যাক ফনসেকা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের করফাঁকিতে সহায়তা করেছে।

সাবেক ও বরতমান বিশ্ব নেতা মিলিয়ে নথিতে আছে আইসল্যান্ড ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নামসহ ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট এবং সৌদি আরবের বাদশাহও।

নিচে বিশ্বের সাবেক ও বরতমান ওইসব নেতা কিংবা তাদের স্বজনদের নামের তালিকা এবং নথিতে তাদের সম্পরকে উল্লিখিত তথ্য দেওয়া হল:

ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো:

পানামা নথিতে বলা হয়, “২০১৪ সালের অগাস্টে যখন রুশ বাহিনী পূর্ব ইউক্রেইনে প্রবেশ শুরু করে তখন ‘প্রাইম এসেটস পার্টনারস লিমিটেড’র একমাত্র শেয়ারহোল্ডার ছিলেন পোরোশেঙ্কো। মোস্যাক ফনসেকার নথি অনুযায়ী, যেটি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এ অবস্থিত।”

“সাইপ্রাসের একটি ল’ ফার্ম নতুন করে কেনা ওই কোম্পানিটিকে ‘হোল্ডিং কোম্পানি অব সাইপ্রাস অ্যান্ড ইউক্রেইন কোম্পানিস অব দ্য রোশেন গ্রুপ’ বলে বর্ণনা করে। রোশেন গ্রুপ ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ কনফেকশনারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।”

“২০১৫ সালে পোরোশেঙ্কোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় সাইপ্রাসের ল’ ফার্মটি লেখে,  প্রাইম এসেটস পার্টানারস ‘রাজনীতিতে জড়িত এক ব্যক্তির’ কোম্পানি হলেও ‘তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই’।  ওই সময় পোরোশেঙ্কো তার বেশিরভাগ সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; ওই অর্থের পুরোটাই প্রাইম এসেটস ক্যাপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”

আলা মুবারক (মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ছেলে)

পানামা নথিতে বলা হয়, “২০১১ সালে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের ফার্ম ‘প্যান ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট ইনকর্পোরেশন’র মালিক হন আলা মুবারক। ওই বছরই ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে তার বাবা হোসনি মুবারক ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন এবং আলা, তার ভাই জামাল ও হোসনি মুবারক নিজে গ্রেপ্তার হন। তখন ইইউ’র একটি আইন বলে মোস্যাক ফনসেকা আলার কোম্পানিটি বন্ধ ঘোষণা করে। ক্লায়েন্টের বিষয়ে ‍ঠিকঠাক মত খোঁজ না নেওয়ায় মোস্যাক ফনসেকাকে সেবার সাড়ে ৩১ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা গুণতে হয়।

ইরাকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলাওয়ি

নথি অনুযায়ী “মোস্যাক ফনসেকার মাধ্যমে ১৯৮৫ সালে পানামা ভিত্তিক কোম্পানি আই.এম.এফ. হোল্ডিং ইনকর্পোরেশন’র মালিক হন আয়াদ আলাওয়ি।

২০০০ সালে তিনি কোম্পানিটির একমাত্র শেয়ারহোল্ডার হিসেবে তালিকাভূক্ত হন।

২০১৩ সালে কোম্পানিটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তার আগে কিংসটনে টেমস নদীর তীরে আই.এম.এফ. এর নামে একটি বাড়ি ক্রয় করা হয়।

২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ওই বাড়িটি আলাওয়ির নামে ছিল, যার আর্থিক মূল্য ১৫ লাখ মার্কিন ডলার।

আলাওয়ির অন্য অফশোর কোম্পানির নাম ‘মুনলাইট এসটেটস লিমিটেড’র নামে লন্ডনে তার আরও একটি বাড়ি ছিল।

সৌদি বাদশাহ সালমান

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সৌদি বাদশাহ হন সালমান বিন আব্দুল আজিজ বিন আব্দুলরহমান আল সৌদ।

পানামা নথি অনুযায়ী, “লুক্সেমবার্গের কোম্পানি সাফাসন কর্পোরেশন এসপিএফ এস.এ. তে বাদশাহ সালমানের অনুল্লেখিত ভূমিকা রয়েছে।

 কোম্পানিটি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডেস এ ১৯৯৯ সালে নিবন্ধিত ‘ভার্সি ডেভেপলমেন্ট কর্পোরেশন’ এবং ২০০২ সালে নিবন্ধিত ‘ইনরো কর্পোরেশন’র শেয়ারহোল্ডার।

২০০৯ সালে ইনরো কোম্পানিকে দুই কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে এবং ভার্সিকে ৮০ লাখের বেশি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়। ওই অর্থ দিয়ে সেন্ট্রাল লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয় করা হয়।

যদিও উভয় কোম্পানিতে বাদশাহ সালমানের ভূমিকা নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।

এছাড়া ‘এরগা’ নামের একটি ইয়োটের মূল ব্যবহারকারী হিসেবে সালমানের নাম আছে। লন্ডনে নিবন্ধিত অন্য একটি কোম্পানির সঙ্গেও তার নাম জড়িত।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ও আবু ধাবির আমির শেখ খলিফা বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান

পানামা নথিতে বলা হয়, “ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এ মোস্যাক ফনসেকা প্রতিষ্ঠিত অন্তত ৩০টি কোম্পানির সুবিধাভোগী মালিক ছিলেন শেখ খলিফার।

সেইসেঙ্গ কেনসিংটন ও মেফেয়ারের মত লন্ডনের বিলাসবহুল এলাকায় তার কয়েকটি বাণিজ্যিক ও আবাসিক সম্পত্তি রয়েছে, যেগুলোর আর্থিক মূল্য প্রায় ১৭০ কোটি (১.৭ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার।

আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন

সিগমুন্ড গুনলাগসনের স্ত্রী অ্যানা সিগুরলাউগ পালসডটটির দেশটির একজন ধনকুবেরের কন্যা।

পানামা নথিতে বলা হয়, “গুনলাগসন ও পালসডটটির ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যন্ডস এর ‘উইনটরিস ইনকর্পোরেশন’র মালিক। আইসল্যান্ডের তিনটি বড় ব্যাংকে কোম্পানিটির নামে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের বন্ড কেনা আছে।

গুনলাগসন ২০০৯ সালে সংসদসদস্য নির্বাচিত হন। সেবার তিনি উইন্টরিসের মালিকানা ঘোষণা করতে ব্যর্থ হন। ২০০৯ সালের শেষ দিন তিনি এক ডলারের বিনিময়ে উইন্টরিসের ৫০ শতাংশ শেয়ার তার স্ত্রীর কাছে বিক্রি করে দেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সার্গেই রলডুগিন

সার্গেই রলডুগিন একজন বিশ্বমানের পেশাদার বাদ্যযন্ত্র শিল্পী। নথিতে বলা হয়, “সার্গেই রলডুগিন তিনটি অফশোর কোম্পানির মালিক।”

যদিও ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রলডুগিন বলছিলেন, “আমি একটি অ্যাপার্টমেন্ট, একটি গাড়ি ও একটি কটেজের মালিক। আমার কাছে মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ নেই।”

কাতারের সাবেক আমির শেখ হামদ বিন খলিফা আল থানি

১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কাতার শাসন করেন।

নথি অনুযায়ী, “২০১৪ সালের মার্চ মাসে লুক্সেমবার্গের একজন আইজীবী মোস্যাক ফনসেকার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, আল থানি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি ক্রয় করতে আগ্রহী। তিনি পরে অ্যাফ্রোডিলে এস.এ. কোম্পানিটি ক্রয় করেন। এছাড়া লুক্সেমবার্গে তার একটি ব্যাংক একাউন্ট আছে এবং তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার দুইটি কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ারের মালিক।

চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি পেং এর কন্যা লি জিয়াওলিন

নথি অনুযায়ী, “লি জিয়াও লিন এবং তার স্বামী লিউ ঝিউয়ান ‘ফনডাশন সিলো’র লভ্যাংশের মালিক। এই ফাউন্ডেশনটি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যন্ডস এর ‘কফিক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের’ একমাত্র শেয়ারহোল্ডার।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের জ্ঞাতি ভাই রামি ও হাফিজ মাখলুফ

নথিতে পাওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, “২০০২ সালে সিরিয়ার মোবাইল টেলিকম কোম্পানি সিরিয়াটেলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রামি মাখলুফ। কোম্পানিটির ১০ শতাংশ শেয়ার তার নিজের নামে এবং বাকি ৬৩ শতাংশ শেয়ার তার ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস ভিত্তিক কোম্পানি রেক্স টেকনলজিস এস.এ. এর নামে। রেক্সের নামে সুইজারল্যান্ডে একটি ব্যাংক একাউন্টও খুলেছেন তিনি।

রামি ও তার ভাই হাফিজের যৌথ মালিকানাধীন একটি কোম্পানি ও হাফিজের একক মালিকানাধীন একটি কোম্পানির আর্থিক লেনদেনও সুইজার‌ল্যান্ডের ওই ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে হত। 

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার ভাইপো ক্লিভ খুলুবুস জুমা

‘খুলুবুস জুমা ‘ক্যাপরিকাত লিমিটেড’র অনুমোদিত প্রতিনিধি। যে দুইটি অফশোর কোম্পানি ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর তেল ক্ষেত্রের বিতর্কিত মালিক এটি তার একটি।

২০১০ সালে ওই দুইটি কোম্পানির তেল ক্ষেত্রের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস কর্তৃপক্ষ মোস্যাক ফনসেকাকে জুমার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ওই বছরই মোস্যাক ফনসেকা কোম্পানি দুইটির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ইতি ঘোষণা করে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের তিন সন্তান মারিয়াম সফদর, হাসান নওয়াজ ও হুসাইন নওয়াজ

নওয়াজ শরীফের পরিবার পাকিস্তানের চতুর্থ ধনী পরিবার। যা নিয়ে দেশটিতে প্রায়ই সমালোচনা হয়।

নথিতে বলা হয়, “মারিয়াম সফদর ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস ভিত্তিক ফার্ম নেইলসেন এন্টারপ্রাইস লিমিটেড এবং নেসকল লিমিটেডের মালিক। কোম্পানি দুইটি যথাক্রমে ১৯৯৪ ও ১৯৯৩ সালে নিবন্ধিত হয়। কোম্পানি দুইটির নামে যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি ক্রয় করা আছে।

এছাড়া, ২০০৭ সালের জুনে হুসাইন ও মারিয়াম ডয়েচ ব্যাংক জেনেভা থেকে নেসকল, নেইলসেন ও অন্যান্য কোম্পানির নামে প্রায় এক কোটি ৩৮ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ করেছে। ওই সময় তারা তাদের লন্ডনের সম্পত্তি ডিপোজিট হিসেবে রাখে।

২০১৪ সালের জুলাইয়ে অন্য কোম্পানি দুইটি অন্য একটি এজেন্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

হাসান নওয়াজ ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের হ্যানগন প্রপার্টি হোল্ডিং লিমিটেডের একমাত্র পরিচালক।

‘রাজনৈতিক ভাবে পরিচিত’ ব্যক্তি হওয়ায় মোস্যাক ফনসেকা এক পর্যায়ে হাসান নওয়াজের এজেন্ট না থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।