জরিপে এগিয়ে বাইডেন, এরপরও ট্রাম্প যেভাবে জিততে পারেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে হওয়া সর্বশেষ সব জরিপেই রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনকে বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2020, 05:47 AM
Updated : 17 Oct 2020, 05:47 AM

কেবল জাতীয় পর্যায়ের জরিপে নয়, ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ কিংবা ‘সুইং স্টেট’গুলোতেও তার অবস্থান তুলনামূলক ভালো।

ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, কোনো কোনো ‘দোদুল্যমান রাজ্যে’ সাবেক এ মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের অবস্থান আরও শক্তিশালী হচ্ছে বলে বেশ কয়েকটি জরিপে ইঙ্গিত মিলেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

তাহলে কি বাইডেনই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? ৩ নভেম্বরের আগে তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও বিভিন্ন জরিপের ফল, আগাম ভোট এবং নির্বাচনী তহবিলে বিপুল পরিমাণ অর্থ,ডেমোক্র্যাট শিবিরের কর্মকর্তাদের স্বস্তি দিচ্ছে।

ডেমোক্র্যাটরা এবার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বিপুল পরিমাণ চাঁদা তুলেছে। আর্থিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকায় ভোটের ঠিক আগের সপ্তাহগুলোয় বাইডেন তার প্রচারণা ও বার্তা দিয়ে রেডিও-টিভি ছেয়ে ফেলতে পারবেন।

নির্বাচনী বিশ্লেষকদের বেশিরভাগেরই বাজি ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর পক্ষে। নেট সিলভারের ফাইভথার্টিএইট ডট কম ব্লগ বাইডেনের জয়ের সম্ভাবনা দেখছে ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে ডিসিশন ডেস্ক এইচ কিউ বলছে, এ সম্ভাবনা ৮৩.৫ শতাংশ।

অনেকের কাছেই এ সব যেন চার বছর আগের পুনরাবৃত্তি, যার শেষটা হয়েছিল ডেমোক্র্যাটদের ‘আশাভঙ্গের’ ভেতর দিয়ে। 

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সপ্তাহ দুয়েক আগেও হিলারি ক্লিনটনের জয়ের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। অথচ শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পই শেষ হাসি হেসেছিলেন।

ট্রাম্পের আরেকটি ‘ওভার ট্রাম্পের’মধ্যে দিয়ে কি এবারও তাই ঘটতে যাচ্ছে?

তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বাইডেন এরপরও যে ৫টি সম্ভাব্য কারণে হেরে যেতে পারেন, সেগুলো হচ্ছে-

আরেকটি অক্টোবর বিস্ময়

এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালক জেমস কোমি। ছবি: রয়টার্স

চার বছর আগে নির্বাচনের ঠিক ১১ দিন আগে মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের পরিচালক জেমস কোমি অনেকটা হুট করেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় হিলারির ব্যক্তিগত ইমেইল সার্ভার ব্যবহারের ঘটনাটির তদন্ত নতুন করে শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

এর পরের এক সপ্তাহ এ ঘটনা এবং এর সম্পর্কিত নানান বিষয় ছিল সংবাদ মাধ্যমে বড় খবর; যা ট্রাম্পের প্রচারাভিযানকেও দম ফেলার একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল।

চলতি বছরের নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ১৭ দিন; এবারও যদি কাছাকাছি ধরনের একটি রাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটে যায়, তাহলে ট্রাম্পের কপাল খুলেও যেতে পারে। 

অবশ্য এখন পর্যন্ত এ মাসের সব বড় বড় চমকই ট্রাম্পের বিপক্ষে গেছে। যেমন, তার কর সংক্রান্ত খবর ফাঁস, এবং কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।

রিপাবলিকান শিবির অবশ্য অন্য একটি ঘটনাকে তাদের প্রচারে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।

নিউ ইয়র্ক পোস্ট সম্প্রতি একটি রহস্যময় ল্যাপটপ এবং তাতে পাওয়া একটি ইমেইল নিয়ে এক নাটকীয় খবর প্রকাশ করেছে । ওই ইমেইলে জো বাইডেনের ছেলে হান্টারের একটি ইউক্রেইনীয় গ্যাস কোম্পানির হয়ে লবিংয়ের চেষ্টা সংক্রান্ত কিছু তথ্য আছে বলে জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো।

রিপাবলিকানরা এবার এ  ইমেইলের মাধ্যমে বাইডেনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন; যদিও ইমেইলটির উৎস প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে এটা হয়তো খুব বেশি ভোটারের মত পরিবর্তন করতে পারবে না।

ট্রাম্প অবশ্য বলেছেন, এটা কেবল শুরু, আরো অনেক কিছুই আসছে। যদি তাই হয়, এবং বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে কোনো অন্যায় করার প্রমাণ পাওয়া যায় - তাহলে তা একটা ভিন্ন এবং বড় ঘটনায় পরিণত হতে পারে।

কিংবা কে জানে, হয়তো এর চেয়েও বড় কোনো ঘটনা অপেক্ষা করে আছে।

কী সেই ঘটনা? যদি আগে থেকে অনুমানই করা যায়, তাহলে কী আর তা বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে?

জনমত জরিপে ভুল

যেদিন থেকে জো বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন - সেদিন থেকেই জাতীয় জনমত জরিপগুলোয় তাকে ট্রাম্পের চাইতে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে।

দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান খুবই সামান্য এমন ‘সুইং স্টেট’ বা ‘দোদুল্যমান রাজ্য’গুলোতেও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী খানিকটা এগিয়ে আছেন। জনমত জরিপগুলোতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। এর কারণে ফলাফলে সাধারণত ৩ থেকে ৫ শতাংশ ওলট-পালট হতে পারে।

কিন্তু ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটের’ কোনো কোনোটিতে বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে ৫ শতাংশের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। 

যদিও ২০১৬ সালের নির্বাচনে দেখা গেছে, জাতীয় পর্যায়ের জরিপে কে এগিয়ে আছেন, শেষ পর্যন্ত তা অপ্রাসঙ্গিক। আর অঙ্গরাজ্য স্তরের জরিপেগুলোও ভুল প্রমাণিত হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেমন হবে, শেষ পর্যন্ত কত লোক ভোট দিতে যাবেন- এসবের পূর্বাভাস দেয়া প্রতি নির্বাচনের আগেই জরিপকারীদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জরিপকারীরা এক্ষেত্রে বড় ধরনের ভুল করেছিল। তারা শ্বেতাঙ্গ এবং কলেজে পড়েনি এমন ভোটারদের সংখ্যা কম ধরেছিল, পরে যারা বেশি সংখ্যায় ট্রাম্পকে ভোট দেয়।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, বাইডেন এখন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের জরিপে যে ব্যবধানে এগিয়ে আছেন, তাতে জরিপকারীরা ২০১৬-র মত ভুল করলেও তিনি জিতে যাবেন।

অবশ্য জরিপকারীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জও আছে। কেননা এবার বহু আমেরিকানই ডাকযোগে ভোট দেবার পরিকল্পনা করছেন। রিপাবলিকানরা ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে যে তারা ডাকযোগে দেয়া ভোটকে জোরালভাবে চ্যালেঞ্জ করবে। তাদের মতে, এখানে ব্যাপক জালিয়াতির সম্ভাবনা রয়েছে, যা ঠেকানো প্রয়োজন।

অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা বলছে, এটা আসলে ভোটারদের দমন করার একটা প্রয়াস।

ভোটাররা যদি তাদের ফর্মগুলো ভুলভাবে পূরণ করে অথবা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, কিংবা যদি ডাকযোগে ভোট পাঠানোর ক্ষেত্রে কোন বিঘ্ন বা বিলম্ব হয় - তাহলে এমন পরিস্থিতি হতে পারে যে সঠিকভাবে পূরণ করা ভোটও বাতিল হয়ে যেতে পারে।

ভোটকেন্দ্রেগুলোর সংখ্যা কম হলে, বা তাতে যদি কর্মকর্তা কম থাকে - তাহলেও ৩ নভেম্বর ভোট দিতে গিয়ে অনেকে অসুবিধায় পড়তে পারেন। এতে জরিপকারীরা যাদের ‘সম্ভাব্য ভোটার’ বলে চিহ্নিত করছে, তাদের অনেকেই ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে পারে।

বিতর্কে ট্রাম্প ভালো করলে

ট্রাম্প ও বাইডেনের প্রথম টিভি বিতর্ক নিয়ে হৈচৈ থেমে গেছে, কারণ ইতিমধ্যেই দুই সপ্তাহ সময় পার হয়ে গেছে। ওই বিতর্কে ট্রাম্পই ছিলেন সবচেয়ে আক্রমণাত্মক।

জনমত জরিপগুলো বলছে, ট্রাম্পের ওই আক্রমণাত্মক ভাব, বাইডেনের কথায় বার বার বাধা দেয়া মফস্বলের নারীদের একদমই ভালো লাগেনি । এবারের নির্বাচনে মফস্বলের নারী ভোটারদের অংশকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে বাইডেন ছিলেন আক্রমণের মুখেও অবিচল। যে কারণে রিপাবলিকানরা ভোটারদের মনে বাইডেনের বয়স নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তাও কেটে গেছে।

ট্রাম্প তাকে নিয়ে প্রথম বিতর্কে তৈরি হওয়া ধারণা পরিবর্তনের শেষ সুযোগ পাচ্ছেন ২২ অক্টোবর।

সেদিন যদি তিনি অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং প্রেসিডেন্ট-সুলভ ভাব তুলে ধরতে পারেন, এবং বাইডেন যদি কোনো নাটকীয় ভুল করে বসেন - তাহলেই পোয়াবারো।

দোদুল্যমান রাজ্যে জয়

বেশিরভাগ ‘সুইং স্টেটে’ বাইডেন এগিয়ে আছেন বলে জনমত জরিপগুলোতে দেখা গেলেও এমন কয়েকটি রাজ্য আছে, যেখানে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন, বা দু’জনের মধ্যে ব্যবধান খুবই কম।

এখানে সামান্য কিছু এদিক-ওদিক হলেই ইলেকটোরাল কলেজের ভোটগুলো ট্রাম্প ব্যাগে ভরে ফেলতে পারবেন।

২০১৬ সালের নির্বাচনে যেমনটা হয়েছিল, পপুলার ভোট ট্রাম্প কম পেয়েছিলেন, কিন্তু ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে তিনি হিলারিকে ভালোভাবেই টেক্কা দেন।

সেবার যে ‘সুইং স্টেট’গুলোতে ট্রাম্প জিতেছিলেন, তার মধ্যে মিশিগান ও উইসকিনসনের মতো কয়েকটি এবার তার নাগালের বাইরে বলেই মনে হচ্ছে।

কিন্তু বাকিগুলোতে যদি ট্রাম্প সামান্য ব্যবধানেও জিতে যান এবং পেনসিলভানিয়া ও ফ্লোরিডার মতো গুরুত্বপূর্ণ ‘ব্যাটলগ্রাউন্ডে’ শ্বেতাঙ্গ, কলেজে-না-পড়া ভোটারদের আরো বেশি সংখ্যায় ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারেন - তাহলে তিনি হয়তো এবারও ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করে ফেলতে পারেন।

ট্রাম্প-বাইডেন দুজনেই যদি সমান ২৬৯টি করে ইলেকটোরাল ভোট পান, তাহলেও পাল্লা ট্রাম্পের দিকেই ভারি থাকবে।

ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে কোনো প্রার্থী ২৭০ এর মার্জিন না ছুঁতে পারলে, ফল নির্ধারিত হবে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের দ্বারা। ওই প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

বাইডেনের ভুল

ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তার নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন।

হয়তো এটা পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলেছে, কিংবা করোনাভাইরাস মহামারী তাকে এ সুবিধা করে দিয়েছে।

বাইডেন এমন একজন প্রার্থী - যিনি কখনো কখনো বেফাঁস কথা বলে ফেলতে পারেন বলে মনে করা হয় । তারপরও এখন পর্যন্ত তিনি মোটামুটি উৎরে গেছেন, তার মুখের কথার কারণে ডেমোক্র্যাট শিবিরকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।

এখন জোরেশোরে প্রচারভিযান শুরু হওয়ায় অনেক বেশি সভা-সমাবেশ হচ্ছে; এ কারণে সাবেক এ মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হুট করে কোনো বেফাঁস কথা বলে ফেলেন কিনা, সে ঝুঁকিও বেড়ে গেছে।

ডেমোক্র্যাটদের এবারের নির্বাচনী জোটে নানান ধরনের লোক আছে। এখানে মফস্বলের মধ্যপন্থিরা যেমন আছেন, আছেন ক্ষুব্ধ রিপাবলিকানরা, সংখ্যালঘুরা। শ্রমজীবী ঐতিহ্যগত ডেমোক্র্যাট ও উদারনৈতিকরা তো আছেনই।

বাইডেন যদি এদের কোনো একটি গোষ্ঠীর অসন্তুষ্ট হওয়ার মত কিছু করে বসেন তাহলেও পাশার দান উল্টে যেতে পারে।

আবার প্রচারণাজনিত ক্লান্তির কারণে বাইডেনের যে অনেক বয়স হয়েছে, সেটাও দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে; তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করার উপযুক্ত কিনা- তখন সে উদ্বেগও দেখা দিতে পারে।

এরকম কিছু হলে ট্রাম্পশিবির তার সুযোগ নিতে দ্বিধা করবে না।

ডেমোক্র্যাট শিবিরের কর্মকর্তারা হয়তো ভাবছেন, এই তো, আর কয়েকটা দিন। এটা পার হতে পারলেই হোয়াইট হাউস তাদের কব্জায় এসে যাবে।

কিন্তু এখন যদি তারা বড় ধরনের কোনো হোঁচট খায়, তাহলেই বিপদ। হতে পারে, এর মাধ্যমেই তারা ‘নিশ্চিত জয়ের মুখে’ থেকেও পরাজিত হওয়ার আরেকটি উদাহরণ সৃষ্টি করবে।