ধনকুবেররা ‘রাষ্ট্র নীতির ভুলের’ ফসল? নাকি পৃথিবী বদলে দেওয়া ‘স্বনির্মিত উদ্ভাবক’?
Published : 02 Aug 2024, 09:15 AM
এক বিলিয়ন মানে আসলে কত! যদি সময়ের নিরিখেই বিবেচনা করা হয়- এক মিলিয়ন সেকেন্ড মানে ১১ দিন, কিন্তু এক বিলিয়ন সেকেন্ড মিলে হয় ৩২ বছর!
অর্থ-বাণিজ্যের সাময়িকী ফোর্বসের হিসাবে, অন্তত এক বিলিয়ন ডলারের মলিক হতে পেরেছেন, বিশ্বে এমন মানুষের সংখ্যা এখন ২ হাজার ৮০০ জন।
কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ৮১৩ জন বিলিয়নেয়ার আছেন, যেখানে (হংকংসহ) চীনে এই সংখ্যা ৪৭৩। আর ভারতে আছেন ২০০ বিলিয়নেয়ার।
অক্সফামের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, বিশ্বে ৮১ জন শীর্ষ ধনীর কাছে যে সম্পদ আছে তা বিশ্বের ৪০০ কোটি মানুষের কাছেও নেই।
২০২৩ সালের ওই প্রতিবেদনের উপসংহারে এক একজন বিলিয়নেয়ারকে ‘রাষ্ট্র নীতির ভুলের’ ফসল হিসেবে বর্ণনা করেছে অক্সফাম।
সেখানে বলা হয়েছে, “যখন বেশিরভাগ মানুষকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হচ্ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তখন বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং রেকর্ড মুনাফা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রমাণ- যা মানবতাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।”
এই বৈষম্য ঘোচাতে অনেক দেশে সম্পদের ওপর কর আরোপের জোর দাবি উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির সেনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন ৫ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের ওপর ২ শতাংশ এবং ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের ওপর ৩ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন।
অবশ্য পাল্টা যুক্তিও দেন কেউ কেউ। তাদের দাবি, পুঞ্জিভূত সম্পদই নতুন কিছু সৃষ্টি ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে, যা লাখ লাখ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
এই মতের সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ মাইকেল স্ট্রেইনের ভাষ্য, “আমাদের আরও বিলিয়নেয়ার দরকার।”
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলিয়াম নর্ডহাউসের গবেষণা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন থেকে যে আয় হয়, তার মাত্র ২ শতাংশ যায় প্রতিষ্ঠাতা বা উদ্ভাবকদের পকেটে; বাকিটি সমাজই পায়।
স্ট্রেইন বলেন, “বিলিয়নেয়ারদের মোটাদাগে স্বনির্মিত উদ্ভাবক বলা যায়, যারা আমাদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি বদলে দেন।”
এ প্রসঙ্গে বিল গেটস ও স্টিভ বালমারের মত ধনকুবেরদের উদাহরণ টানছেন স্ট্রেইন। তিনি বলেন, “তারা ব্যক্তিগত কম্পিউটিংয়ে বিপ্লব ঘটিয়েছেন; বিখ্যাত বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট, জেফ বেজোস খুচরা ব্যবসায় বিপ্লব এনেছেন। আর ইলন মাস্ক অটোমেটিভ ইন্ডাস্ট্রি এবং মহাকাশ বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
"এগুলোর কোনোটিকে ‘ভুল রাষ্ট্রনীতির ফসল’ বলা যাবে না। তাদের ছাড়া একটা পৃথিবী কামনা করার চাইতে বরং তারা যা করেছেন, তা ভেবে আমাদের রোমাঞ্চিত হওয়া উচিত।”
অনেক বিলিয়নেয়ার বড় অংকের টাকা দান খয়রাত করেন। বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট তাদের সারাজীবনে উপার্জিত সম্পদের অর্ধেক দান করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
সম্পদের অর্ধেক দান করার প্রতিশ্রুতি না দিলেও র্যাপার, ব্যবসায়িক মুঘল বিলিয়নেয়ার জে-জেড বলেছেন, "আমি যদি নিজেই গরিব হই, তাহলে তাদের সাহায্য করতে পারব না। তাই আমি ধনী হয়েছি এবং ফেরত দিয়েছি। এটাই সবার জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করি।”
বিবিসি লিখেছে, বিলিয়নেয়াররা এমনি এমনি ধনী হয়ে ওঠেন না। তাদের সাফল্য অন্যদের সম্পর্কেও কিছু বলে।
অনেক বেশি সম্পদ অর্জন করা খুবই খুবই কঠিন, যদি না এমন কিছু বিক্রি করতে পারেন- যা মানুষের প্রয়োজন, বা যা মানুষ চায় কিংবা উপভোগ করে।
বিলিয়নেয়ার বললেই যাদের নাম আমাদের মনে আসে, তারা প্রত্যেকে এই পৃথিবীকে কোনো না কোনোভাবে বদলে দিয়েছেন, হয়ত মাত্রার দিক দিয়ে কেউ কম, কেউ বেশি। আর যেভাবে তারা সেটা করেছে, সেই গল্পগুলোও অনন্য।
যেমন গুগলের প্রতিষ্ঠাতারা তাদের সার্চ ইঞ্জিনের শুরুর সংস্করণটি ১০ লাখ ডলারে বিক্রি করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো ক্রেতা পাননি। সেই গুগলের সম্পদের পরিমাণ এখন ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এর সহপ্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ এখন ১৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা মরক্কোর জিডিপির প্রায় সমান।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাডার প্রধান নকশাবিদ, ইতালির বিলিয়নেয়ার মারিয়া বিয়ানচি ষাটের দশকে যখন থিয়েটার স্কুলে মূকাভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করতেন, তখন তিনি ছিলেন সাচ্চা কমিউনিস্ট।
ভারতের প্রথম আত্মপ্রতিষ্ঠিত নারী বিলিয়নেয়ার কিরণ মজুমদার-শ শুরুতে বিয়ার তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন এবং পরে এশিয়ার বৃহত্তম ইনসুলিন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
জেরি সেইনফিল্ডের বাবা-মা দুজনেই অনাথ ছিলেন এবং তার বাবা কখনও তাকে জড়িয়ে ধরেননি। সেই কারণে হয়ত তার ও ল্যারি ডেভিডের জনপ্রিয় কমেডি সিরিজ সিনফেল্ডের চরিত্রগুলোর জন্য একটি নিয়ম ছিল: ‘আলিঙ্গন নেই তো শিক্ষাও নেই।’
এই বিলিয়নেয়ারদের ব্যক্তিগত সাফল্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আরো বড় পরিসরে কোনো ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক বা প্রযুক্তিগত প্রবণতার কথা বলে।
খুচরা বিক্রির অনলাইন মার্কেটপ্লেসের জন্ম আর চীনের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছেন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা জ্যাক মা।
শুল্কমুক্ত কেনাকাটার পদ্ধতি চালু করে বিলিয়নেয়ার বনে গেছেন চাক ফিনি। এই ব্যবসার বদৌলতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপানি পর্যটনে একটি ঢেউ উঠেছিল।
বিবিসি লিখেছে, বিলিয়নেয়ারদের অনেকের গল্পে ভাগ্যেরও হাত দেখা যায়।
ষাটের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে হাতে গোনা যে কটি স্কুলে কম্পিউটার ছিল, তার একটিতে পড়তে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের।
বার্বাডোসে ছুটি কাটাতে আসা এক রেকর্ড প্রযোজকের কাছে অডিশনের সুযোগ পেয়ে ভাগ্য বদলে যায় গায়িকা ও ব্যবসায়ী রিয়ানার।
বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে অনেক সময় অভিভাবকদেরও ভূমিকা থাকে।
টেইলর সুইফটের পরিবার তাদের কিশোরী মেয়ের ক্যারিয়ারকে আরও এগিয়ে নিতে পেনসিলভেনিয়া থেকে ন্যাশভিলে চলে গিয়েছিল।
মাইকেল জর্ডানের মা পরামর্শ দিয়েছিলেন, অ্যাডিডাস বা কনভার্সের সঙ্গে চুক্তি করার আগে তিনি যেন নাইকির প্রস্তাবও শোনেন। আর তার ফলেই ইতিহাসের সবচেয়ে লাভজনক ক্রীড়া চুক্তিটির পথ প্রশস্ত হয়েছিল।
বিবিসি লিখেছে, এই গল্পগুলোতে এমন কিছু মুহূর্ত আছে যাকে বলা যেতে পারে এক একটি দরজা, যা তাদের জীবন ও ভাগ্য বদলের পথে নিয়ে গেছে।
কিন্তু কেবল সেই দরজার দেখা পেলেই হবে না, সেই পথ ধরে হেঁটে যেতে হবে, সেই অচেনা পথে যাত্রার সাহস, চেষ্টা এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর অটল বিশ্বাস থাকতে হবে। তাকে চলতে হবে আকাঙ্ক্ষা পূরণের স্বপ্ন নিয়ে।