ফিজিওলজি বা মেডিসিন বিভাগে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা হবে সোমবার। এর পর মঙ্গলবার ও বুধবার যথাক্রমে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিভাগের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবে নোবেল কর্তৃপক্ষ।
Published : 06 Oct 2024, 04:34 PM
পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান খাতে অবদান রাখার জন্য শিগগিরই ঘোষণা করা হবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম, যেখানে বিজ্ঞান জগতের সেরা গবেষকরা চলে আসবেন স্পটলাইটে।
এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে, সুইডিশ শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেলের নামে প্রতিষ্ঠিত এই পুরস্কারটি বিভিন্ন এমন যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতি দেয়, যেগুলোর পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই থাকে কয়েক দশকের শ্রম।
বিজ্ঞান খাতে এ শীর্ষ সম্মাননা কে জিতবে, সেটি অনুমান করা একটু জটিল। এমনকি এতে মনোনীত প্রার্থীদের নামের সংক্ষিপ্ত তালিকাও গোপন রাখা হয়, যেখানে এর বাছাই প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্যের নথিও ৫০ বছর ধরে জনসমক্ষে আসেনি।
এদিকে, নোবেল পাওয়ার যোগ্য উদ্ভাবনের সংখ্যাও প্রচুর। এর মধ্য থেকেই পাঁচটি এমন যুগান্তকারী উদ্ভাবন, যেগুলো নোবেল পায়নি, তার বিস্তারিত উঠে এসেছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন’র প্রতিবেদনে।
প্রথম মানব জিনোম
নোবেল পুরস্কারের যোগ্য প্রার্থী হিসেবে প্রায়শই মানব জিনোমের ম্যাপিংয়ের কথা উঠে আসে। এ সাহসী প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে ও এর সমাপ্তি ঘটে ২০০৩ সালে।
মানব জীবনের জেনেটিক কোড ক্র্যাক করা এ উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও চীনের হাজার হাজার গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক দল।
এই প্রচেষ্টা জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এ প্রকল্প এখনও নোবেল না পাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এ কৃতিত্বের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা।
১৮৯৫ সালে আলফ্রেড নোবেলের নিজের নির্ধারণ করা নীতিমালা অনুসারে, পুরস্কার প্রতি সর্বোচ্চ তিন জনকে সম্মানিত করা যাবে, যা এ ধরনের সমন্বিত গবেষণার ক্ষেত্রে একটি ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সিএনএন।
মেদ চিকিৎসায় বিপ্লব
ওজন কমানোর ওষুধের বিকাশ, যেখানে গ্লুকাগন-জাতীয় ‘পেপটাইড ১’ বা ‘জিএলপি-১’ নামের হরমোন অনুকরণ করা হয়। যুগান্তকারী আবিষ্কারটি গত কয়েক বছরে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা খাতকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি আটজনের একজন মেদ সংশ্লিষ্ট রোগে আক্রান্ত, যা ১৯৯০ সালের পর থেকে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আর এর ওষুধ, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ ও ক্ষুধা কমিয়ে দেয়, তা স্থূলতা ও ‘টাইপ ২’ ডায়াবেটিসের মতো রোগ নিরাময়ে নতুন যুগ শুরুর সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
সেমাগ্লুটাইড নামে পরিচিত এ ওষুধ বিকাশে কাজ করেছেন তিন বিজ্ঞানী, যাদের নাম এসভেতলানা মোজসভ, ড. জোয়েল হ্যাবেনের ও লোটে বিয়েরে নুডসেন। এমনকি এ বছরের ‘লাসকার-ডিব্যাকে ক্লিনিকাল মেডিকাল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ও পেয়েছেন তারা, যা কোনো বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন নোবেল পুরস্কার জিতবে কি না, তার একটি লক্ষণ বলে বিবেচিত।
এর মধ্যে মোজসভ পেশায় একজন বায়োকেমিস্ট ও নিউ ইয়র্কের ‘রকেফেলার ইউনিভার্সিটি’র সহকারী অধ্যাপক। এ ছাড়া, হ্যাবেনের পেশায় একজন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ও হার্ভার্ড মেডিকাল স্কুলের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক, যিনি ‘জিএলপি-১’ শনাক্ত ও সমন্বিত করতে সাহায্য করেছেন।
অন্যদিকে, নুডসেন হলেন বহুজাতিক ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি ‘নভো নর্ডিস্ক-এর প্রাথমিক বিকাশে কাজ করার পাশাপাশি কোম্পানিটির গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টাও। এমনকি লাখ লাখ লোকের কাছে এই কার্যকর মেদ কমানোর ওষুধের প্রচারেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে কোম্পানিটি।
ট্রান্সফর্মেটিভ এআই
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি খুব দ্রুতই মানুষের জীবন খোলনলচে পাল্টে দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্টিফিক ইনফর্মেশন’-এর প্রধান গবেষণা বিশ্লেষক ডেভিড পেন্ডলবুরি’র মতে, এটি এমন এক খাত, যেখানে দুটি নাম উঠে আসে, তারা হলেন ডেমিস হাসাবিস ও জন জাম্পার, যারা গুগল ডিপমাইন্ডের ‘আলফাফোল্ড প্রোটিন স্ট্রাকচার ডেটাবেজ’-এর উদ্ভাবক।
এটি এমন এক এআই প্রকল্প, যা অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে প্রোটিনের ৩ডি কাঠামো ডিকোড করে। সারা বিশ্বের অন্তত ২০ লাখ গবেষক এটি ব্যবহার করেছেন।
আলফা ফোল্ড বিভিন্ন প্রোটিন কাঠামোর বেলায় অনেকটা ‘গুগল সার্চ’-এর মতোই কাজ করে, যেখানে অনুমান করা বিভিন্ন প্রোটিন মডেলে তাৎক্ষণিক প্রবেশের সুযোগ মেলে। এতে করে মৌলিক জীববিজ্ঞান ও এ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে দ্রুত অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
এ যুগলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পেয়েছিল ২০২১ সালে, যার উদ্ধৃতি বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে ১৩ হাজারের বেশিবার। আর একে ‘বিশেষ সংখ্যা’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন পেন্ডলবুরি।
তিনি বলেন, গোটা বিশ্বের সর্বমোট ছয় কোটি ১০ লাখ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি উদ্ধৃতি পেয়েছে প্রায় পাঁচশটি।
এরইমধ্যে ২০২৩ সালের লাসকার’সহ অন্যান্য বেশ কিছু পুরস্কার জিতেছেন জাম্পার ও হাসাবিস। পেন্ডলবুরি বলেছেন, রসায়ন খাতে অবদান রাখার জন্য ভবিষ্যতে তাদের নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। এ ছাড়া, আলফাফোল্ডের ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে তোলা ‘ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন স্কুল অফ মেডিসিন’-এর ‘ইনস্টিটিউট ফর প্রোটিন ডিজাইন’ বিভাগের পরিচালক ও এ গবেষণার তৃতীয় গবেষক ডেভিড বেকারের নামও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে পেন্ডলবুরি’র ধারণা বলছে, গতানুগতিকভাবে রক্ষণশীল নোবেল কমিটি এত দ্রুত এ খাতের কাউকে সম্মাননা দেবে, এমন সম্ভাবনা কম।
“কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছেন, এমন পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে এ খাত এখনও প্রস্তুত নয়। কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এআই প্রয়োগের বিষয়টি একেবারেই নতুন,” বলেন তিনি।
অন্ত্রের অণুজীব সম্পর্কে ধারণা
মানবদেহে অন্য কোনো জীবের অস্তিত্ব নেই, বিষয়টি এমন নয়। এতে বসবাস করে বেশ কয়েক ট্রিলিয়ন মাইক্রোব, ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাক, যেগুলো সমন্বিতভাবে ‘হিউম্যান মাইক্রোবায়োম’ বা মানব অণুজীব নামে পরিচিত।
এইসব মাইক্রোব আসলে কী করে, এরা কীভাবে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে এবং মানব কোষ, বিশেষ করে অন্ত্রে থাকা কোষগুলোর সঙ্গে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া ঘটায়, গত দুই দশকে জেনেটিক সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির অগ্রগতি বিজ্ঞানীদেরকে এ বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে।
পেন্ডলবুরি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এই খাত নোবেল সম্মাননার যোগ্য দাবিদার।
এ খাতের পথিকৃৎ হলেন জীববিজ্ঞানী ড. জেফ্রি গর্ডন ও সেন্ট লুইসে অবস্থিত ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি’র বিশিষ্ট অধ্যাপক রবার্ট জে. গ্লেসার।
মানুষের অন্ত্রে থাকা মাইক্রোবায়োম কীভাবে মানব স্বাস্থের সংজ্ঞা তৈরি করে, সে সম্পর্কে ধারণা পেতে গর্ডন গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে এ গবেষণায় দেখা গেছে, অন্ত্রে থাকা মাইক্রোবায়োম অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে ভূমিকা রাখে, যার ভুক্তভোগী বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি শিশু। এখন তিনি এমন গবেষণা নিয়ে কাজ করছেন, যার লক্ষ্য, মানুষের খাদ্যাভাস থেকে অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করা।
ক্যান্সার সংক্রামক জিন
৭০’র দশকে প্রচলিত ধারণা ছিল, ক্যান্সার কখনও কখনও উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসে। তবে, স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে তৎকালীন মূলধারার চিন্তাভাবনায় এমন আলামত মেলেনি।
মানুষ ও শিম্পাঞ্জীর মধ্যে জেনেটিক পার্থক্য নিয়ে গবেষণা করা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের স্কুল অফ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ম্যারি-ক্লেয়ার কিং এক্ষেত্রে নতুন এক পন্থা অবলম্বন করেছেন।
যে কোনো ধরনের মানব জিনোম ম্যাপিং শুরুর অনেক আগে থেকে কাজ করা কিং ১৭ বছর কাটিয়েছেন স্তন এবং ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে ‘বিআরসিএ ১’ জিনের ভূমিকা শনাক্ত করার পেছনে।
এ আবিষ্কার এমন জেনেটিক পরীক্ষার সুযোগ তৈরি করেছে, যা স্তন ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা নারীদেরকে শনাক্ত করার পাশাপাশি এ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে কী কী ধাপ নেওয়া উচিৎ, সে সম্পর্কে ধারণা দেয়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, অতিরিক্ত স্ক্রিনিং বা প্রতিরোধমূলক অস্ত্রোপচার করানো।
ফিজিওলজি বা মেডিসিন বিভাগে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা হবে সোমবার। এর পর মঙ্গলবার ও বুধবার যথাক্রমে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিভাগের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবে নোবেল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া, বৃহস্পতিবার শিক্ষাখাত এবং শুক্রবার শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সিএনএন।