ঘুষ, যোগসাজশ আর বাজার ধসিয়ে শীর্ষে উবার

ব্যবসা বাড়াতে জনসংযোগের নামে ঘুষ, বেআইনি সখ্য, নিজের সুবিধামতো বাজার পাল্টে দেওয়া বা ডিজরাপশনের অভিযোগ উঠেছে বিশ্বের শীর্ষ রাইড হেইলিং কোম্পানি উবারের বিরুদ্ধে।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2022, 09:35 AM
Updated : 11 July 2022, 03:52 PM

ফাঁস হয়ে গেছে রাইড শেয়ারিং সেবা উবারের বিশাল সংখ্যক অভ্যন্তরীণ নথিপত্র। আর ফাঁস হওয়া নথিপত্র বলছে, বিশ্ববাজারে ব্যবসা প্রসারের জন্য জেনেশুনেই বেআইনি পথে হেঁটেছে কোম্পানিটি; ড্রাউভারদের উপর সহিংস হামলার ঘটনাগুলোকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করেছে উবার।

বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, বছরে অন্তত নয় কোটি ডলার উবার ব্যবহার করেছে রাজনীতিবিদসহ প্রভাবশালীদের নিজের পক্ষে রাখতে যার ফলে ইউরোপের ট্যাক্সি বাজার সাফল্যের সঙ্গে ধসিয়ে দিয়েছে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ট্রাভিস কালানিকের প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি।

ফাঁস হওয়া এক লাখ ২৪ হাজার নথিপত্রকে একযোগে ‘উবার ফাইলস’ নামে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে সধ্যে কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, শিল্প খাতের শীর্ষ ব্যক্তি এবং মিডিয়া মুগলদের টেক্সট মেসেজ, ইমেইল আলাপাচারিতা, এমনকি চিঠিও আছে ফাঁস হওয়া নথিপত্রের মধ্যে।

ফ্রান্সে উবারকে ব্যবসা করতে দিতে প্রয়োজনে আইন সংশোধনেও রাজি ছিলেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ– উঠে এসেছে ফাঁস হওয়া টেক্সট মেসেজ থেকে।

উবারের বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের হাতে এসেছে, পরে যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে)’সহ কয়েক ডজন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ভাগাভাগি হয়েছে।

প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমগুলো উবারের বেআইনি ব্যবসা কৌশল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোম্পানিটি নিজস্ব ওয়েবসাইটে এক পোস্টে বলেছে, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠাতা ট্রাভিস কালানিক ইস্তফা দেওয়ার পর বর্তমান প্রধান নির্বাহী দারা খোসরোশাহীর নেতৃত্ব কোম্পানিটি “বিরোধিতার যুগ থেকে সরে এসে সহযোগিতামুখী যুগে পা দিয়েছে।”

কিন্তু ফাঁস হওয়া নথিপত্র বিশ্লেষণ করে গার্ডিয়ান বলছে, “প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, শতকোটিপতি, ওলিগার্ক এবং মিডিয়া ব্যারনদের সমর্থন পেতে সতর্কতার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল উবার।”

ফাঁস হওয়া নথিপত্রে উবারের অভ্যন্তরীণ মেমো, প্রেজেন্টেশন, নোটবুক ছাড়াও ‘ইমেইল, আইমেসেজ, এবং সিলিকন ভ্যালির কোম্পনিটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে চালচালি হওয়া হোয়াটাসঅ্যাপ মেসেজও ছিল’।

উবার ফাইলস নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নিজস্ব কম্পিউটার সিস্টেম তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দিতে ‘কিল সুইচ’ ব্যবহার করেছে উবার। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, “কোম্পানির ব্যবসা কৌশল যে বৈশ্বিক ট্যাক্সি ব্যবসাকে অস্থিতিশীল করে তুলছে, সে প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্তের পথ বন্ধ করা।”

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে কোম্পানিটি ‘ড্রাইভারদের ওপর সহিংসা হামলাকে’ ব্যবহার করেছে বলে উঠে এসেছে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে। কর্মীদের জন্য ‘ডন রেইড ম্যানুয়াল’ নামের একটি নির্দশনা বানিয়ে রেখেছিল উবার; যাতে বুলেট পয়েন্টে লেখা ছিল, “নিয়ন্ত্রকদের কখনোই একা থাকতে দেওয়া যাবে না।”

উবারের সঙ্গে ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সম্পর্কেই বেশি জোর দিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। সে সময়ে দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন ম্যাক্রোঁ, উবারের সুবিধার্থে দেশের আইন পাল্টাতেও রাজি ছিলেন তিনি। বিবিসির প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার নিলি ক্রোয়েস তার পদ ছাড়ার অনেক আগে থেকেই উবারের পক্ষ নিয়ে ডাচ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের কাছে ধর্না দিয়েছেন।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে বিশ্ববাজারে ব্যবসা প্রসারে বেআইনি কৌশল অবলম্বনের বিষয়টি ভালোভাবেই জানতেন উবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এক কর্মকর্তা নিজেদের ‘পাইরেট’ বা জলদস্যু বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে এক সহকর্মীকে পাঠানো মেসেজে উবারের বৈশ্বিক গণযোগাযোগ বিভাগের সাবেক প্রধান নাইরি হোর্ডিজান বলেছিলেন, “মাঝেমাঝে আমাদের কিছু সমস্যা হয়, কারণ, আমরা আসলে বেআইনি।”

অন্যদিকে, উবারের বর্তমান কর্মীরা সাবেক প্রধান নির্বাহী ট্রাভিস কালানিকের অধীনে থাকা অবস্থায় কোম্পানির কর্মকাণ্ডের দায় নিতে চান না বলে ইঙ্গিত মিলছে তাদের বক্তব্য থেকে। এ প্রসঙ্গে কোম্পানির বিপণন ও জনসংযোগ বিভাগের বর্তমান সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জিল হাজেলবেকার বলেছেন, “অতীত কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে আমরা কখনো কোনো অজুহাত দেইনি আর দেবও না। আমাদের বর্তমান মূলবোধের সঙ্গে (অতীতের কর্মকাণ্ড) সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”

“তার বদলে আমরা জনসাধারণকে বলছি আমাদের গত পাঁচ বছরের কাজ আর ভবিষ্যতের বছরগুলোতে যা করবো তার ভিত্তিতে বিচার করতে,” যোগ করেন তিনি।

ফাঁস হওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে গেছেন উবারের সাবেক প্রধান ট্রাভিস কালানিকের মুখপাত্র ডেভন স্পার্জেন।

“কালানিক কখনোই রাশিয়ায় উবারের ব্যবসা প্রসারে কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেননি বা পরিচালনা করেননি এবং ওই ব্যবসা প্রসারণ পরিকল্পনার সঙ্গে খুবই কম সংশ্লিষ্টতা ছিল তার। উবারকে ড্রাউভারদের ওপর সহিংস হামলার সুযোগ নিতেও কখনো বলেননি কালানিক,” আইসিআইজির কাছে পাঠানো আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে লিখেছেন স্পার্জেন।

কিন্তু, ২০১৬ সালের ২৯ জানুয়ারিতে কালানিকের পাঠানো এক টেক্সট মেসেজের বক্তব্য ছিল, “সহিংসতা সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয়।”